চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিও আছে
ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান লিটু
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিক্ষাক্রম উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। রাষ্ট্রীয় দর্শন ও আদর্শ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সমকালীন জীবনের চাহিদা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়ন করে শিক্ষাব্যবস্থায় গতি সঞ্চার করতে হয়।
শিক্ষাক্রম উন্নয়নের এ প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক পরিবীক্ষণের মাধ্যমে চলমান শিক্ষাক্রমের সবলতা-দুর্বলতা ও উপযোগিতা নির্ণয় করা হয়।
সময়ের সঙ্গে সমাজের পরিবর্তন ঘটছে, তাছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এসবের ফলে শিখন চাহিদাও পরিবর্তিত হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজনীয় পরিমার্জন ও নবায়নের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী রাখা আবশ্যক। আবার এমন সময় আসে যখন পুরোনো শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে সময়ের চাহিদা পূরণ সম্ভব হয় না, তখন নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হয়। প্রস্তাবিত রূপরেখায় অনেক ভালো বিষয় আছে, আবার রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি।
এই রূপরেখা শিখন কার্যক্রমে ক্লাসরুমের নির্দিষ্ট ছকের সঙ্গে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণের কথা বলেছে। এতে শেখা বা জ্ঞানার্জন আরও আনন্দদায়ক হবে। স্বাধীনতার ৫০তম বছরে আরেকটি নতুন শিক্ষাক্রমের আত্মপ্রকাশ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু গত ৫০ বছরে শিক্ষাক্রমসমূহের অর্জন ও অপ্রাপ্তি দুটোকেই প্রকাশ ও বিবেচনায় আনার প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষাক্রম কাঠামোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পাঠ্যবিষয় নির্বাচন। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি শিখনক্ষেত্র-ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, পরিবেশ ও জলবায়ু, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, জীবন ও জীবিকা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা, শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ১০টি শিখনক্ষেত্র নির্ধারণে যথাযথ যৌক্তিকতার অভাব রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিজ্ঞান, গণিত, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিক্ষার বিশেষ প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এজন্য বর্তমান শিক্ষাক্রম কাঠামো যৌক্তিক আকারে প্রকাশ করা হলেও শিখনক্ষেত্র নির্ধারণে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। শিক্ষাক্রম কাঠামোতে বিবেচিত একটি বিষয় হলো-নবম-দশম শ্রেণিতে পঠিত শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার জন্য আলাদা পঠিত বিষয় হিসাবে বাদ দেওয়া। বর্তমানে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত একীভূত শিক্ষা বিদ্যমান এবং একে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ।
শুধু ধারণা থেকে শিক্ষার স্তর সংযোজন বা বিয়োজন স্বেচ্ছাচারিতার মনোভাব। কী কারণে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সে সম্পর্কে কোনো যুক্তি দেখানো হয়নি। এক্ষেত্রে ২০০৬ সালে কেন একমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি, তা প্রকাশ করা উচিত ছিল। আগের একমুখী শিক্ষাক্রম বাতিল করে একযুগ পর পুনরায় আবার তা চালু করার যুক্তি কী? বরং এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও ব্যর্থতার প্রকাশ মাত্র।
ইতঃপূর্বে শুধু একমুখী শিক্ষাক্রম তৈরি করার জন্য ৬০০ কোটি টাকা অপচয় করা হয়। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করা যেতে পারে; কিন্তু তা শুধু শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে শুরু করা একটি ভুল কৌশল। একমুখী দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা পরিমার্জনকে প্রশাসনিক পরিমার্জন দিয়ে শুরু করতে হবে। অন্যথায় এবারের প্রচেষ্টাও আগের মতো ব্যর্থ হবে।
ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান লিটু : অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়