আফগান সংকটের সমাধান বৈশ্বিক অংশীদারত্ব

আতাহার খান
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের দ্বিতীয় সপ্তাহ গত হলেও তালেবানরা সরকার গঠনের কাজ এখনো সম্পন্ন করেনি। এ নিয়ে এত দেরি কেন হচ্ছে, এর জবাব এসেছে তালেবানের পক্ষ থেকে-তারা বলেছে, একটি দায়িত্বশীল সরকার গঠনের চেষ্টা চলছে। এর মাঝেই ২৩ আগস্ট দুজন মন্ত্রীর নাম ঘোষণা করা হয়। নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী পদে গুল আগা আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে সদর ইব্রাহিমকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাপ্রধান হিসাবে নাজিবুল্লাহকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ২৫ আগস্ট আরও একজন মন্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়া হয়- ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় মোল্লা জাকিরকে। এই মোল্লা জাকির একজন পরীক্ষিত নেতা। তিনি মার্কিন বাহিনীর হাতে আটক হয়ে গুয়ানতানামো বে কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। যাক সে প্রসঙ্গ।
আসল কথা হলো, পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিপরিষদ এখনো গঠিত হয়নি। এ কাজ সম্পন্ন করতে হয়তো আরও কিছুদিন সময় লাগবে। এমনটাই মনে করেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিভিন্ন সম্প্রদায় আর গোষ্ঠীর সঙ্গে তালেবানের আলোচনা চলছে। সরকার গঠনে উজবেক, তাজিক, হাজারাসহ প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ চায় তারা। সম্ভবত অংশীদারত্বমূলক সরকার গঠনের দিকেই এগোচ্ছে আফগানিস্তান। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, আফগানিস্তানের সবখানেই বিরাজ করছে অজানা আতঙ্ক। নানা উৎকণ্ঠা, ভয় আর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে রাজধানী কাবুলের ব্যস্ত সময়।
এ দুর্বিষহ পরিবেশ থেকে বাঁচার জন্য নিরাপদ জায়গার খোঁজে সব শ্রেণির মানুষ ভিড় জমাচ্ছে কাবুল বিমানবন্দরে। কাঁটাতারে ঘেরা উঁচু দেওয়াল টপকে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকতে পারলেই যেন মুক্তি! অনেকের কোলে বাচ্চা, পিঠে ব্যাকপ্যাক। পুরো বিমানবন্দরই লোকে লোকারণ্য। দেশ ছেড়ে যেতে প্রাণের মায়া করছেন না সাধারণ মানুষ। এরকম প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে ২৬ আগস্ট রাতে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চত্বর। স্থানীয়, বিদেশি মিলিয়ে নিহত ১৭০ জন, আহত আরও বেশি। এত বড় ঘটনার পরও সব ভয় বুকে চেপে রেখেই সাধারণ মানুষের দেশ ছাড়ার মরিয়া চেষ্টা থেমে নেই।
কাবুলের রাজপথে এখন টহল দিচ্ছে তালেবানের বিশেষ বাহিনী। অথচ রাজধানীতে তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘটনাটি ছিল অভিনব ও চমকপ্রদ। মাত্র ৪৫ মিনিটের আলোচনা। ১৫ আগস্টের ওই আলোচনার পরই পদত্যাগ করেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। ক্ষমতার এ পালাবদলের পর ১৬ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় কাবুলে তালেবানি রাজত্বের প্রথম সকালটি ছিল ভয়, শঙ্কা আর উদ্বেগে ভরা। প্রায় দু’দশক পর আফগানিস্তানে শুরু হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় দফায় তালেবানি রাজত্ব। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর- কাবুলে হামলা হবে না এই শর্তে তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল বিদায়ী প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির।
ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্টের বাসভবনে গিয়েছিল তালেবান সংগঠনের একটি প্রতিনিধি দল। সে দলের নেতৃত্বে ছিলেন তালেবানের অন্যতম প্রধান মোল্লা আবদুল গনি বরাদার। কাতার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কূটনীতিবিদরাও ছিলেন সেখানে। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে বৈঠক হয়। সমঝোতা অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের হাত থেকে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতা গ্রহণ করবে তালেবান।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভবনের দখল নেওয়ার পর তালেবানরা পরিষ্কার জানিয়ে দেয়- যুদ্ধ শেষ। আরও বলা হয়, ‘বিদেশিরা চাইলে কাবুল ছাড়তে পারেন। তবে আগামী দিনে কাবুলে থাকতে গেলে তালেবান প্রশাসনের কাছে তাদের সব নথিপত্র জমা দিতে হবে।’
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ২০ বছরের শাসন কেন হঠাৎ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল? এর উত্তর খুঁজতে এ দুদশকের সময়কে সামনে নিয়ে এলে পরিষ্কার দেখা যাবে, আশরাফ ঘানি কিংবা তার আগে হামিদ কারজাইয়ের আমল- প্রত্যেক প্রশাসনই ছিল ভীষণ দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা কেউই সাধারণ মানুষের উন্নতি নিয়ে ভাবেনি, ভেবেছে নিজেদের উন্নতির কথা।
ফলে আফগান সরকার নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না, বরং ছিল ক্ষোভ। এই ক্ষোভ গাঢ় হওয়ার পেছনে আরও একটি কারণ ছিল, সেটি হলো- মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় আফগানিস্তানের কোনো সরকারই ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়নি। ঘানি সরকারও নয়। যুক্তরাষ্ট্র বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করে ঘানিকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়েছিল। এ নিয়ে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব তৈরি হয় আফগানদের ভেতরে। মার্কিনিদের অত্যধিক খবরদারিও পছন্দ করত না তারা। এর ওপর আবার বেপরোয়া বিমান হামলায় প্রাণ হারাতে হয়েছে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। রেড ক্রসের হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায়।
২০১৩ সাল থেকে আফগানিস্তানে বিমান হামলার মাধ্যমে প্রায় ২৭ হাজার বোমা নিক্ষেপ করে আমেরিকা। শুধু গত বছরই ৭ হাজার ৪০০ বোমা নিক্ষেপ করা হয়। নির্বিচার বোমা হামলা থেকে আফগানদের হামিদ কারজাই কিংবা আশরাফ ঘানি কেউই নিরাপত্তা দিতে পারেননি। ফলে ক্ষমতায় কে এলো আর কে ক্ষমতাচ্যুত হলো এ নিয়ে কেউই মোটেও আগ্রহ দেখাত না। বরং আফগানরা বেশি গুরুত্ব দিত দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিবারণের সংগ্রামকে।
আফগানিস্তান অত্যন্ত দরিদ্র একটি দেশ। এ দারিদ্র্য আর পশ্চাৎপদ অবস্থার সুযোগ নিয়েছে বিদেশি শক্তিগুলো। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যের নির্মম অভিশাপে জর্জরিত। এ করুণ দুর্দশা পালটানোর কোনো সদিচ্ছাই দেখায়নি আশরাফ ঘানি আর হামিদ কারজাইয়ের প্রশাসন। সেখানকার ৫৩ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, আর বেকারত্বের হার হলো ৪০ শতাংশ। দেশটি একমাত্র বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।
বলা বাহুল্য, এ দারিদ্র্যকে আরও উসকে দিয়েছে সেখানকার দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে শত শত, হাজার হাজার মাইল পাহাড়-পর্বত ঘেরা; মারাÍক রুক্ষ পরিবেশ। আফগানিস্তানের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই অনুন্নত যে, কোথাও কোথাও হেঁটে বিপজ্জনক পথ পেরোতে হয়। এসব দুর্গম এলাকায় সরকারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক শিক্ষা ও চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হতো না। ফলে কেন্দ্রীয় শাসনের আওতার বাইরে থাকা এলাকাগুলোর গোত্রপ্রধানরাই সবকিছু। তারাই সেখানকার হর্তাকর্তা-বিধাতা। বিচার-আচার সবই তারা করে থাকেন।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, আশরাফ ঘানি আর হামিদ কারজাইয়ের জমানায় এ দুরবস্থার বিষয়গুলো কখনোই সামনে আসেনি। কারণ তাদের হাত-পা ছিল বাঁধা। আমেরিকার টাকায় ক্ষমতায় বসেছিলেন। সেই অবস্থানে থেকে আমেরিকার বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে হামিদ কারজাই তার শাসনামলের শেষদিকে মার্কিন যথেচ্ছাচারের বিরোধিতা করেছিলেন। তাতে ফল ভালো হয়নি। উলটো তাকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছিল।
তাছাড়া আফগানিস্তানের আরও একটি বাস্তবতা হলো বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা। এ বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থাই আফগানিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসনকে সংহত হতে দেয়নি। ২০০৩ সালে মার্কিন ব্যবস্থাপনায় আফগান ইতিহাসে তথাকথিত প্রথম নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই গণতন্ত্র তৃণমূলে পৌঁছতে পারেনি। আসলে গণতন্ত্রের ধারণা আফগানদের কাছে একেবারে নতুন। সেখানে আছে অনেক নৃগোষ্ঠী, প্রান্তিক শ্রেণি এবং অন্যান্য স্থানীয় সম্প্রদায়।
বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার জন্যই তারা আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। নিরাপত্তা, বিচারব্যবস্থা ও অন্যান্য সেবামূলক কাজকর্ম সব ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে এসেছে স্থানীয় জনগণ। কারণ হলো, একেকটি প্রদেশ একেকটি জাতি বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এর ফলে কেন্দ্রীয় শাসন দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারেনি।
ক্ষমতাসীনরা কখনো খোঁজ নিত না কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতি কেন আঞ্চলিক জনগোষ্ঠীর অনাস্থা রয়েছে। সে কারণেই আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো দ্রুত বিচারের বন্দোবস্ত নিজেরাই করে নিত। এটি তাদের পুরোনো রীতি। তাই ছোট থেকে বড়- যে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে স্থানীয় মানুষ তাদের আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর কাছে বিচারের আবেদন জানাত। এভাবেই গড়ে উঠেছে সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা, যার সঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসনের দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থাকা আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো নিজেদের পরিচয় নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছে। কখনো কখনো তারা পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ত, কখনো সংঘর্ষ বেধেছে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে। একেকটি জনগোষ্ঠীর স্বার্থ একেকরকম। এ ভিন্নতার বৈচিত্র্যকে পুঁজি করেই অঞ্চলভিত্তিক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটেছে।
পৃথক আত্মপরিচয় খোঁজা ও কেন্দ্রীয় শাসনের ঐক্যের অভাবই বছরের পর বছর জন্ম দিয়েছে দ্বন্দ্ব, যা রূপ নিয়েছে গৃহযুদ্ধে। এ অনৈক্য, অবিশ্বাস, গৃহযুদ্ধ এবং মার্কিনবিরোধী মনোভাব- এ সবকিছু কাজে লাগিয়ে তালেবান তার শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে নিয়েছে।
আজ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তালেবান অনেক মিত্র খুঁজে পেয়েছে। ১৯৯৬ সালের তালেবান সরকারকে মাত্র তিনটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল। এবারের দৃশ্য ভিন্ন। ২০ বছরের ব্যবধানে এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অনেক নতুন মুখ উঠে এসেছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এরই মধ্যে পরিষ্কার বলেছেন, ‘তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নিজেদের মতামত আফগানিস্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।’ মূল কথা, দু-দুটি সুপার পাওয়ার রাশিয়া ও চীন প্রচ্ছন্নভাবে তাদের পাশে রয়েছে।
মানতেই হবে, এটি তালেবানদের একটি বড় প্লাস পয়েন্ট। কারণ বিশ্বশক্তি বলয়ের একপাশে আমেরিকা থাকলে অন্য পাশে অবশ্যই আছে চীন। কাবুলের পতনের মধ্য দিয়ে পরাশক্তি আমেরিকার এক ধরনের পরাজয় হয়েছে। আমেরিকা যুদ্ধ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিজয় অর্জন করতে চেয়েছিল, পারেনি। ইরাকে হয়েছে ব্যর্থ। আফগানিস্তানেও তথৈবচ। তালেবানবিরোধী অবস্থানে থাকার পরও যুক্তরাজ্য তালেবান প্রসঙ্গে মুখ খুলেছে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, আফগানিস্তানের সমস্যা কূটনৈতিকভাবেই সমাধানের চেষ্টা করা হবে। প্রয়োজনে তালেবানের সঙ্গে কাজ করতেও রাজি তার সরকার। গত ২০ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে এ কথাই বলেন তিনি। আফগানিস্তানের পাশের দেশ ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বলেছে, কাবুলে তাদের দূতাবাস এখনো খোলা। আফগানিস্তানে তালেবান কর্তৃত্বকে সমর্থন করেছে পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের সঙ্গ তো বরাবরই পেয়ে এসেছে তালেবান।
আসলে আফগানিস্তানে আমেরিকা যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা সন্দেহ নেই আফগানদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। মার্কিনবিরোধী সাধারণ মানুষের এই মনোভাবই ধীরে ধীরে তালেবানের পক্ষে চলে আসে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট আশরাফ ঘানি আর তার প্রশাসন হালে বিন্দুমাত্র পানি পায়নি। জনসমর্থনহীন আশরাফ ঘানির অনিবার্য পতন তাই কিছুতেই রোখা যায়নি।
হ্যাঁ, আফগানিস্তানের সবখানেই এখন বিরাজ করছে আতঙ্ক ও অস্থিরতা। সরকার গঠন প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত রূপ নেয়নি। তবে তালেবানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা তত্ত্বাবধায়ক ধরনের সরকার গঠনের চিন্তাভাবনা করছেন। সরকারে একজন আমির-উল-মোমিনিন থাকবেন। তিনিই ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তানের নেতৃত্ব দেবেন। তাছাড়া একটি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদ থাকবে, যারা সরকারের নানা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের মনোনয়ন দেবেন। সেখানে থাকবে দেশের সব নৃগোষ্ঠী ও উপজাতির প্রতিনিধিত্ব।
বর্তমান পরিস্থিতিতে তালেবানই দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। আমেরিকা-পরবর্তী আফগানিস্তানকে তারাই চালাচ্ছে। অথচ অনেক উন্নত দেশই তালেবানকে জঙ্গি সংগঠন মনে করে। তাই যেসব আফগান এখন দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে বা যারা আগে থেকেই বিদেশে বসবাস করছে, কৌশলগতভাবে তাদের তালেবানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না, এ ধারণাও অমূলক নয়।
কারণ জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশই আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি দেবে না। সেক্ষেত্রে এই বৈরিতা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নয়, মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই কালবিলম্ব না করে প্রয়োজন আফগানিস্তানের মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট দূর করা। কোনো একক দেশের পক্ষে এ সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, দরকার বৈশ্বিক অংশীদারত্ব।
উন্নত দেশগুলো যদি সেখানে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাহলে মানতেই হবে তারা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, তালেবানরা চায় নতুন সরকারে সব নৃগোষ্ঠী ও উপজাতির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে। সেই সদিচ্ছাকে সফল করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। তালেবানদের বিশ্বাস, ২০ বছর আগেকার পথ নয়, পরিবর্তিত অবস্থাকে মেনে নিয়ে নতুন পথে এগোতে হবে তাদের- তাহলেই আফগানিস্তানে ফিরে আসবে কাক্সিক্ষত শান্তি ও সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থা। এজন্য শুধু দূরদৃষ্টির পরিচয় দিলে চলবে না, বেছে নিতে হবে সঠিক পথও। অবশ্য সময়ই বলে দেবে তালেবান ব্যর্থ না সফল হবে।
আতাহার খান : কবি ও সাংবাদিক