Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্মরণ

আকাশযোদ্ধার স্থলযুদ্ধ

Icon

কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২১, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আকাশযোদ্ধার স্থলযুদ্ধ

এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার, বীর-উত্তম

আজ ১ সেপ্টেম্বর। দিনটি বাংলার এক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ও মৃত্যুদিবস। তিনি হলেন এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার, বীর-উত্তম, টিবিটি। ১৯৩৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি এ ধরাধামে আগমন করেন; ১৯৫৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসাবে যোগ দেন এবং ১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার ছাতারদিঘি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। বাবার নাম এমএইচ শাহ। ডানপিটে ও চঞ্চল স্বভাবের বাশার ছিলেন পড়াশোনায় অসাধারণ মেধাবী। ‘ডিকেন’ ছিল তার ডাকনাম। কে জানত এ দুরন্ত কিশোর একদিন সুবিখ্যাত বৈমানিক হয়ে দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ‘বীর-উত্তম’ হওয়ার গৌরব অর্জন করবে!

ব্রিটিশদের মতো পাকিস্তানিরাও যখন বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার জন্য ‘নন-মার্শাল রেস’ অপবাদ দিয়ে সামরিক বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করত, সেসময়ে খাদেমুল বাশার তার অসাধারণ যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়। বহু পাঞ্জাবিকে পেছনে ফেলে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কমিশনড র‌্যাংকে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। ১৯৫৩ সালের জুনে পাকিস্তান বিমানবাহিনী একাডেমি রিসালপুরে ফ্লাইং শাখায় ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেন। দীর্ঘ দুই বছর কঠোর প্রশিক্ষণের পর ১৯৫৬ সালের ১৭ জুন তিনি একাডেমি থেকে জিডি (পি) শাখায় পাইলট অফিসার হিসাবে কমিশন লাভ করেন এবং পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফাইটার স্কোয়াড্রনে যোগ দেন। অতঃপর খাদেমুল বাশার বিভিন্ন ফ্লাইট স্কোয়াড্রনে জঙ্গি বিমানের বৈমানিক হিসাবে একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেন। তার পেশাগত দক্ষতা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার কারণে ১৯৬০ সালে তাকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর নবপ্রতিষ্ঠিত তদানীন্তন ঢাকা এয়ার বেস-এর ফ্লাইট সেফটি অফিসার হিসাবে বদলি করা হয়। এরপর তার বদলি হয় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ৮ ও ৪০৬নং স্কোয়াড্রনের অধিনায়ক হিসাবে।

১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধে পাকিস্তানের একটি বোম্বিং স্কোয়াডের নেতৃত্ব দেন তিনি। তার অসাধারণ সাহসিকতা ও সাফল্যের জন্য সরকার বাঙালি এ পাইলটকে পাকিস্তানের গৌরবময় ‘তঘমা-ই-বাসালত’ রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করে। খাদেমুল বাশার কর্মজীবনে একাগ্রতা ও নিষ্ঠার কারণে একজন দক্ষ বৈমানিক হিসাবে সুখ্যাতির শিখরে আরোহণ করেন। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর তিনিই একমাত্র বাঙালি বৈমানিক, যিনি সেসময় পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে বোম্বার স্কোয়াড্রনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; যার বীরত্বগাথা মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি একটি বোম্বিং স্কোয়াড্রনের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি উইং কমান্ডার পদে উন্নীত হন।

মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ও ৬নং সেক্টর কমান্ডার : দেশপ্রেমিক, অতি সাহসী এবং বহু গুণের অধিকারী সমরনায়ক ছিলেন খাদেমুল বাশার। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালায় নিরীহ মানুষের ওপর। এ বর্বর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশবাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুক্ত হন মরণপণ সংগ্রামে। বর্বর এ গণহত্যা নিরীহ মানুষের রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। জ্বলে উঠেছিল বাঙালি জাতি। খাদেমুল বাশারও উপলব্ধি করেছিলেন, পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে। তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। দেশমাতৃকার প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর দায়বদ্ধতা থেকে তিনি সব খ্যাতি ও সমৃদ্ধির মোহ পেছনে ফেলে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ত্যাগ করেন। ঢাকায় কর্মরত আরও কয়েকজনের সঙ্গে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ১৪ মে ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের লক্ষ্যে আগরতলার উদ্দেশে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করেন। বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও ওসমানীর কাছে তিনি স্থলযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার দুঃসাহসী মনোভাব ও চৌকশ যোগ্যতার জন্য জেনারেল ওসমানী জুন থেকে তাকে বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত মুক্তিযুদ্ধের ৬নং সেক্টরের স্থলবাহিনীর স্থলযুদ্ধের কমান্ডার নিয়োগ করেন। স্থলযুদ্ধের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতা, দক্ষতা ও সাহসের সঙ্গে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করেন।

৬নং সেক্টরে কোনো নিয়মিত ব্যাটালিয়ন ছিল না। সেক্টর সদর দপ্তর ছিল পাটগ্রামের নিকটবর্তী বুড়িমারিতে। প্রথমে সেক্টরের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৭০০ এবং ডিসেম্বর নাগাদ সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১১ হাজারে। তাদের মধ্যে নিয়মিত সৈন্য ছিল ২ হাজার এবং গণবাহিনী ৯ হাজার। খাদেমুল বাশারের সুযোগ্য পরিচালনায় ৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে পাকবাহিনী কখনো রংপুর ও দিনাজপুর এলাকায় তেমন আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। তার অসীম বীরত্বে ভুরুঙ্গামারী ও ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীর শত্রুমুক্ত হয়।

ভুরুঙ্গামারীর যুদ্ধ : সেক্টর কমান্ডারের পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী রোজার আগের রাতে ভুরুঙ্গামারীর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। রাত ৯টায় অভিযানে অংশগ্রহণকারী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আবেগময় বক্তৃতা করলেন। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ এবং ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ গানটি টেপ রেকর্ডারে বাজিয়ে শোনানো হলো। অভিযানে অংশগ্রহণকারী দেড়শ মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি হাত মেলালেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আদর করলেন। বড় ও ছোট ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা, অ্যামবুশ ও রেইড ইত্যাদি তিনি নিজেই পরিচালনা করতেন। সফল রণকৌশল, অস্ত্র চালনা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, আত্মবিশ্বাস, সেই সঙ্গে সহকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার গভীর স্নেহ, ভালোবাসা, অনুভূতি ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধাদের মন থেকে কোনো দিন মুছে যাবে না। বিজয় অর্জনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তার নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করেছেন।

স্বাধীনতাযুদ্ধে অসামান্য ও দুঃসাহসী কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর-উত্তম’ রাষ্ট্রীয় খেতাবে সম্মানিত করে। স্বাধীনতার পরপরই এ বিমানবাহিনীর কর্মকর্তার নেতৃত্বে রংপুর সেনানিবাসে ৭২ পদাতিক ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং তিনি এর কমান্ডার নিযুক্ত হন। বিমানবাহিনীর কর্মকর্তার সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার হওয়া সামরিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি লাভ করেন। জুলাইয়ে তিনি বিমানবাহিনীর চাকরিতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির অধিনায়ক নিযুক্ত হন এবং বিমানবাহিনী গঠনে আত্মনিয়োগ করেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনে খাদেমুল বাশারের বিশেষ অবদান ছিল এবং পরবর্তীকালে বিমানবাহিনী পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে তিনি এয়ার কমোডর পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং সহকারী বিমানবাহিনী প্রধান (পরিচালনা ও প্রশিক্ষণ) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালের ৩ মে এয়ার ভাইস মার্শাল পদে পদোন্নতি পেয়ে বিমানবাহিনী প্রধান হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন। অতঃপর ১৯৭৬ সালের ৩ মে তিনি উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে পেট্রোলিয়াম, খাদ্য, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে পালন করেন।

অকাল মৃত্যু : সেদিন ছিল ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬ সাল। ঢাকায় বিমানবাহিনীর উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ স্কুলের উদ্বোধন করেন বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার। জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে উদ্বোধন শেষে তিনি উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ স্কুলের অধিনায়ক স্কোয়াড্রন লিডার মফিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে উদ্বোধনী ফ্লাইটের একটি বিমানে চড়ে আকাশে উড়লেন। উপস্থিত সবার চোখ তখন আকাশে। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। সবাই হতবাক হয়ে দেখছে তেজগাঁও বিমানবন্দরের পাশেই একটি দালানের উপর এসে বিমানটি সজোরে পতিত হলো। উড্ডয়নের পরপরই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ভয়ংকর এক শব্দে স্তব্ধ হয়ে যায় সবকিছু। একই সঙ্গে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় জাতির একজন শ্রেষ্ঠসন্তান অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার ও স্কোয়াড্রন লিডার মফিজুল হকের জীবন। বিমানবাহিনীর যে ঘাঁটিতে তিনি একসময় অধিনায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, মৃত্যুর পর সেই ঘাঁটির নামকরণ করা হয় ‘বিমানবাহিনী ঘাঁটি বাশার’ নামে।

দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে খাদেমুল বাশারের মতো মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখসমরের কমান্ডার তেমন পরিচিত নন। অভাগা জাতি আজ ভুলতে বসেছে খাদেমুল বাশার ও আরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে। মহান আল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের এ বীর সেনানীকে শহিদের মর্যাদা দিয়ে বেহেশত নসিব করুন।

কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সামরিক ইতিহাসবিশারদ

hoque2515@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম