মিঠে কড়া সংলাপ
জনপ্রতিনিধি ও আমলার কার্যক্ষমতায় ভারসাম্য প্রয়োজন
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইউএনওর বাসায় হামলার ছবি
বরিশালে ঘটে যাওয়া ইউএনও এবং সিটি মেয়রের দ্বন্দ্বের আপাত সমাধান হয়েছে। কিন্তু ঘটনাটি আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলেছে বলেই আমার ধারণা। কারণ এতদিন যা মনে মনে বা আড়ালে-আবডালে ছিল, বরিশালের ঘটনার মাধ্যমে তা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। প্রশাসনিক ক্যাডার এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কে বা কারা বেশি শক্তিশালী বা কার ক্ষমতা বেশি তা নিয়ে এতদিন যে ঠান্ডা লড়াইটি অব্যাহত ছিল, বরিশাল সদরের ইউএনও অফিস কম্পাউন্ডের ঘটনায় তার বাস্তব রূপ উন্মোচিত হয়েছে। অর্থাৎ রাজশক্তির উভয় শিবিরের মুখোমুখি অবস্থান জনসমক্ষে চলে এসেছে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমজনতা। বরিশাল শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করায় জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিঘ্নিত হয়েছে। সেখানকার রাস্তাঘাটে ময়লা-আবর্জনা জমিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়াসহ বাস-লঞ্চ প্রভৃতি চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে নিঃসন্দেহে জনসাধারণের ভোগান্তি হয়েছে। অথচ ঘটনাটি এতদূর গড়ানোর কথা ছিল না। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের দক্ষিণাঞ্চলীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেছেন, ‘একটি ছোটখাটো আঞ্চলিক ঘটনাকে জাতীয় ইস্যুতে রূপান্তরিত করা হয়েছে।’ কিন্তু তিনি বা তারা বিষয়টির গোড়া খুঁজে বের করে সেখানে হাত দিয়েছেন কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ বহুদিন থেকেই দেশে আমলাতন্ত্র এবং জনপ্রতিধিদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলে আসছে। বিশেষ করে দেশের সব উপজেলায়ই এ দ্বন্দ্ব খুব বেশি দৃশ্যমান। সেখানে উপজেলা চেয়ারম্যান বড়, না উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বড়-বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে প্রশ্নটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। কারণ ইউএনও সাহেবরা এখন সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ উপজেলা কম্পাউন্ডে বাংলো বাড়িতে অবস্থান করায় নিজেদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাতারে নিয়ে এসেছেন। আর সে তুলনায় উপজেলা চেয়ারম্যানদের সুযোগ-সুবিধা, অফিশিয়াল কার্যপরিধি বা ক্ষমতা উপজেলার জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে উপজেলাগুলোয় একজন ইউএনও বড়, না উপজেলা চেয়ারম্যান বড়, ইউএনও বেশি ক্ষমতাপ্রাপ্ত না উপজেলা চেয়ারম্যান বেশি ক্ষমতাপ্রাপ্ত-সে বিষয়ে প্রকাশ্যেই দ্বন্দ্ব দেখা যায়। আর এ কারণেই বলছিলাম যে, আফজাল সাহেবরা গোড়ায় গলদটি দেখতে, বুঝতে বা ধরতে পেরেছেন কি না। বরিশালের ঘটনায় একজন সিটি মেয়রকে যেভাবে লজ্জায় ফেলা হলো, তা দেখে বোঝা গেল না একজন সিটি মেয়রের মান-মর্যাদা কতটুকু? সেদিন সন্ধ্যা বা রাতে উপজেলা কম্পাউন্ডে গিয়ে তিনি কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছেন বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমন কোনো খবরও কিন্তু পাওয়া যায়নি। হতে পারে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজন কর্তৃক দাঙ্গা-হাঙ্গামার মুহূর্তে তার সেখানে উপস্থিত থাকা ঠিক হয়নি, হতে পারে দলীয় কোন্দলের কারণে তিনি তার অপর কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণের কাজে অতি উৎসাহী হিসাবে কিছুটা ভুল করেছিলেন। কিন্তু এসব বিষয় তো আর এ দেশে নতুন কিছু নয়। তাই বলছিলাম, তার বাসভবন পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনের ঘটনায় তাকে মামলার প্রধান আসামি করা ইত্যাদি ঘটনায় আরও একটু সংযত হলেই বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সুযোগ পেলে এ দেশে সবাই তো ক্ষমতা দেখাতে চায়। মেয়র সেরনিয়াবত সাদিক আব্দুল্লাহও তো দলবল নিয়ে সেখানে গিয়ে এক্ষেত্রে ভুলই করেছেন। আর ইউএনও সাহেবও একজন নির্বাচিত মেয়রের বিরুদ্ধে সমানতালে লড়তে গিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করায় ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। পরে তার বিরুদ্ধেও আদালতে মামলা হয়েছে। ফলে বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যু হিসাবে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে।
এসব কথা কাউকে বড় বা কাউকে খাটো করার জন্য বলা হলো না। বলা হলো এ কারণে যে, সরকারি কর্মকর্তা এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কোনো পক্ষই বরিশালের ঘটনায় বিচক্ষণতা দেখাতে পারেননি। ফলে সরকারকে একধরনের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। রেষারেষির কারণে মেয়র সেরনিয়াবত সাদিক আব্দুল্লাহ ব্যানার, ফেস্টুন অপসারণে যেমন ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলেন, তেমনই তার কাজে বাধা দিতে গিয়ে উপজেলা প্রশাসনও সঠিক কাজটি করেছেন, তেমনটি বলা চলে না। উপজেলা প্রশাসনের লোকজন নিজেরা সে কাজে বাধা না দিয়ে প্রথমেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলতে পারতেন বা প্রথমেই পুলিশ প্রশাসনকে বলতে পারতেন। কিন্তু তা না করে নিজেরাই সে কাজে বাধা দিতে গেলে হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং এ অবস্থায় বলা চলে, তারা নিজেরা পানি ঘোলা করে পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছেন।
যাক সে কথা। বরিশালের ঘটনাটি নিয়ে যে জন্য আজকের লেখাটি লিখতে বসেছি সে প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আর তা হলো, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা বা আমলাতন্ত্রের মধ্যে ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করতে হবে। অন্যথায় একই কাজ বা একই বিষয়ে উভয় পক্ষেরই নাক গলানোর সুযোগ থাকলে ভবিষ্যতে আবারও জটিলতা দেখা দেবে। ঠিক বরিশালের মতো ঘটনা না ঘটলেও অন্য কোনো নতুন ঘটনায় আবারও উভয় পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। বর্তমান অবস্থায়, দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয়ে জনপ্রতিনিধিরা একধরনের দুর্বল বা কোণঠাসা অবস্থানে চলে গেছেন। সারা দেশের গৃহহীন প্রকল্পগুলো ইউএনও সাহেবদের কর্তৃত্বে করানো হয়েছে। যদিও সে ক্ষেত্রে ফল ভালো হয়েছে বলা চলে না। তাছাড়া করোনাকালীন ত্রাণ বিতরণসহ বেশকিছু কাজে সরকার আমলানির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তার পায়াভারী হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিদের তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। ইতঃপূর্বে আমার একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, আমার জেলার পৌর এলাকার জনৈক ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আমাকে বলেছিলেন, ইউএনও দপ্তরে তার উপস্থিতিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তার অন্য একজন অফিসারের উদ্দেশে বলছেন, ‘চেয়ারম্যানের সাহস কত, আমাদের মতো প্রসাশনিক ক্যাডার অফিসারের সঙ্গে লাগতে আসে।’
লেখাটির কলেবর আর বৃদ্ধি না করে এখানেই শেষ করতে চাই। তবে তার আগে আবারও বলতে চাই, প্রশাসনিক ক্যাডার এবং জনপ্রতিনিধিদের কার্যপরিধি ও ক্ষমতার সুষম সীমারেখা নির্ধারণ করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে এখনই একটি কমিশন গঠন বা এ ধরনের একটা কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে। আর যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সরকারের উপরিউক্ত দুটি স্তম্ভকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকায় ফেরাতে না পারলে ভবিষ্যতে আবারও ভুল বোঝাবুঝির ফলে সরকারের জন্য আরও বড় ধরনের বিড়ম্বনা সৃষ্টি হতে পারে। অনেকে বলতে পারেন, আগে থেকেই যার যার কার্যক্ষমতা ও পরিধি ভাগ করে দেওয়া আছে। তবুও বলব, সে কাজটি হয়তো সুষ্ঠু হয়নি। এ বিষয়ে এখানে আর বেশি কিছু বলার সুযোগ না থাকায় আমার কলামে যতটুকু সম্ভব ততটুকুই বলার চেষ্টা করলাম। কারণ আমাদের কলমের ক্ষমতা অতটুকুই। আমরা রাষ্ট্রের উল্লিখিত দুটি স্তম্ভের কর্মক্ষমতার ভারসাম্য দেখতে চাই।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট