পাহাড়ি আম রপ্তানির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে
ড. মো. জামাল উদ্দিন
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল গঠিত। উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের জন্য এ অঞ্চলের খ্যাতি রয়েছে। পাহাড়ের বিভিন্ন জাতের আম স্বাদে-গুণে অনন্য, তাই চাহিদাও থাকে বেশি। এটা ভৌগোলিক কারণে বা মাটির গুণগত কারণে অথবা আবহাওয়াগত কারণে হয়ে থাকতে পারে। এখানে আমের উৎপাদনও তুলনামূলক বেশি।
অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (রাঙামাটি অঞ্চল) তথ্যমতে, ২০২০-২০২১ সালে তিন পার্বত্য জেলায় ১৪ হাজার ৪৪১ হেক্টর এলাকায় আমের মোট উৎপাদন ছিল ১,৬২,১৫৪ টন। খাগড়াছড়ির আমবাগান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি দিবাকর চাকমার হিসাবমতে, একই বছরে শুধু তাদের সমিতিভুক্ত ১৫০ জন বড় বাগানির প্রায় ৫০০০ টন আম উৎপাদন হয়েছিল।
এ আম দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়েছে। এ অঞ্চলে দেশি-বিদেশি হরেক রকমের আম উৎপাদন হয়। তবে রপ্তানিযোগ্য আম কোনগুলো, সেটি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা দরকার। সেভাবে তাদের কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে যাওয়া উচিত। বারি আম-৩ (আম্রপালি), বারি আম-৪ এবং ব্যানানা ম্যাংগো এ অঞ্চলের রপ্তানিযোগ্য আম বলে বিবেচিত।
বিদেশে বারি আম-৩-এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে বলে জানা যায়। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক আম রপ্তানির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। চলতি বছরের ১৮ আগস্ট পর্যন্ত ২৩টি দেশে ১ হাজার ৬২২ টন আম রপ্তানি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়।
বিগত দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আমের নীরব বিপ্লব ঘটছে। সেখানে শত শত আমবাগান গড়ে উঠেছে। আমের উৎপাদন দেখে সেখানকার আমচাষিরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন। এ আমবাগানের ওপর ভিত্তি করে অনেকের জীবন চলে। তবে মাঝে মাঝে আমের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে তাদের মন খারাপ হতেও দেখা যায়।
অনেক ভালো আমবাগানি মানসম্মত আম বিদেশে রপ্তানি করার স্বপ্ন দেখে। একসময় দিবাকর চাকমা হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের সহায়তায় তার বাগানের আম যুক্তরাজ্যের ওয়ালমার্টে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পাঠানো আমে মাছি পোকা ও এনথ্রাকনোজ পাওয়ার কারণে ওয়ালমার্ট পরবর্তী সময়ে আম নেওয়া বন্ধ করে দেয়। সে কারণটির পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত। তাতে সেখানে আবার রপ্তানির সুযোগ তৈরি হতে পারে।
শুধু দিবাকর চাকমা নন, বান্দরবানের মেরিডিয়ান এগ্রো-ফার্মের কামাল পাশা, মহালছড়ির হ্লাশিং মং চৌধুরীর মতো অগ্রগামী অনেক চাষি আম রপ্তানির জন্য আগ্রহ নিয়ে প্রহর গুনছেন। তবে শুধু প্রহর গুনলেই হবে না, রপ্তানি করার জন্য যা যা কাজ করা দরকার তা করতে হবে।
যেমন: রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, তাদের নিয়ে বাগান পরিদর্শন করা, তাদের সহায়তায় তারা যেমনটি চায় সেভাবে কনট্রাক্ট ফার্মিং করা, তাদের দেওয়া প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা, উত্তম কৃষিচর্চার যথাযথ প্রয়োগ এবং মনিটরিং টিম গঠন করে বাগান নিয়মিত পরিদর্শন করা এবং রপ্তানিকারকসহ কৃষি বা কৃষি বিপণন বিভাগের কর্মকর্তার সহায়তায় রপ্তানিযোগ্য আমের ন্যায্যমূল্য ঠিক করা।
এসব কাজ সঠিকভাবে করতে পারলে মানসম্মত আম রপ্তানি করা সহজ হবে। বিদেশি কোনো আমদানিকারকের সঙ্গে পরিচয় থাকলে, তাদের বাগান পরিদর্শনে নিয়ে আসতে পারলে আমি রপ্তানির চেষ্টা আরও ফলপ্রসূ হবে। যেসব দেশ যে শর্তে আমাদের দেশ থেকে আম নিতে ইচ্ছুক, তাদের সেভাবে দেওয়া উচিত। ইদানীং রাশিয়াও আমাদের দেশ থেকে আম নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে।
রপ্তানিযোগ্য আম মানসম্মত হতেই হবে। আমের ফ্রুট ব্যাগিং একটি উল্লেখযোগ্য কৃষি উপকরণ, যার সঠিক ব্যবহারে আমের মাছি পোকা শতভাগ দমন করা যায়। আম আকর্ষণীয় হয়, পোকামুক্ত থাকে। এ ব্যাগটি চীন থেকে আমদানি করতে হয় অন্য পণ্য হিসাবে। ফলে আমদানি বাবদ শুল্ক খরচ বেশি হয়। এ কারণে কৃষক পর্যায়ে প্রতিটি ব্যাগের দাম ৪/৫ টাকা পড়ে যায়। এটা কৃষকের জন্য বেশি হয়ে যায়।
এর খরচ কমানোর জন্য ব্যাগটিকে কৃষি উপকরণ হিসাবে বিবেচনা করে আমদানি করা হলে শুল্ক খরচ অনেক কমে যাবে। ফলে আমদানিকারকদের খরচ কমবে। সেই সঙ্গে কৃষক কম মূল্যে এটি পাবে। তাছাড়া দেশে এটি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
কৃষকদের আম সংগ্রহের পর থেকেই বাগানের পরিচর্যার কাজে নেমে পড়তে হবে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের লোকবল দিয়ে বাগানে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তবেই মানসম্মত আম উৎপাদন সম্ভব হবে। সব জায়গায় পাহাড়ি এলাকার আম বললে আলাদা একটা ইমেজ তৈরি হয়। এ ইমেজটাকে ধরে রাখার জন্য পরিমাণগত আম রপ্তানির চেয়ে গুণগত মানসম্পন্ন আম রপ্তানির দিকে নজর দিতে হবে বেশি।
শুধু মানসম্মত আম উৎপাদন করলেই হবে না, এর ভ্যালু এডিশন কার্যক্রম যেমন: ধৌতকরণ, বাছাইকরণ, গ্রেডিং, হটওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্রয়োগ অথবা ভ্যাপোর/ভাপ হিট ট্রিটমেন্ট (ভিএইচটি), কোলিং, আকর্ষণীয় প্যাকেজিং ও লেবেলিং দরকার। প্যাক-হাউজে এসব কাজ সহজে করা যায়। তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদন এলাকার ব্যাপকতা অনুসারে প্যাক-হাউজ স্থাপন এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাতকারী সংস্থা বা উন্নয়ন সংস্থাগুলো এগিয়ে আসতে পারে।
রপ্তানিযোগ্য আম পরিবহণের জন্য আলাদা পরিবহণ ব্যবস্থা থাকা ভালো। পরিবহণের সময় সড়কে চাঁদাসংক্রান্ত কোনো ঝামেলা যাতে পোহাতে না হয়, সেদিকটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখা দরকার। নয়তো রপ্তানিকারকরা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। কোয়ারেন্টিন এবং বিমানবন্দরে বা কার্গোতে কৃষিপণ্য পরিবহণে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেসব স্বল্প সময়ে দূর করা জরুরি। আম পচনশীল দ্রব্য হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিমানবন্দরে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়।
দেশীয় এসব মূল্যবান কৃষিপণ্যকে সন্তান সমতুল্য ভাবতে হবে। এজন্য আমাদের মাইন্ডসেটের পরিবর্তন দরকার। পাহাড়ি আম রপ্তানি করতে চাইলে রপ্তানির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা অত্যাবশ্যক। তেমনি গ্লোবাল গ্যাপ সার্টিফিকেশন প্রাপ্তির নিশ্চয়তাও দরকার। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) শক্তিশালীকরণের মধ্য দিয়ে পার্বত্য এলাকা থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আম রপ্তানি হোক, এ প্রত্যাশাই করি।
ড. মো. জামাল উদ্দিন : জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট; ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম
jamaluddin1971@yahoo.com