করোনাকালে ডেঙ্গি ও চিকুনগুনিয়া
ডা. মনজুর হোসেন
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিকে বিভিন্ন জ্বরের ব্যাপকতার জন্য এ সময়টা খুবই উদ্বেগজনক। জ্বর কোনো রোগ নয়, কোনো সংক্রমণ বা অন্তর্নিহিত কোনো রোগের উপসর্গ মাত্র।
তবে জ্বরকে কোনোভাবেই অবহেলা করা উচিত নয়। তার ওপর বর্তমানে ভয়াবহ কোভিড-১৯ মহামারির ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ঊর্ধ্বগামী তৃতীয় ঢেউয়ে আমরা সবাই আতঙ্কিত। একে তো ভয়াবহ করোনার নতুন রূপান্তর ডেল্টার দুর্দান্ত সংক্রমণ, এর মধ্যেই ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব। আবার করোনার মতোই চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গির মূল ও প্রথম উপসর্গ হলো জ্বর।
ডেঙ্গির মতো ভাইরাসজনিত এবং মশাবাহিত একটি সংক্রামক রোগ চিকুনগুনিয়া। করোনাভাইরাস সংক্রামক রোগ হলেও বাহক অদৃশ্য এবং ছড়ায় হাঁচি, কাশির মাধ্যমে। রোগ তিনটি একইরকম বা অনুরূপ বিবেচিত হয়ে থাকে, যার ফলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, বিশেষত লক্ষণের সূত্রপাত থেকে প্রথম দুই দিনের মধ্যে। তাই উভয় সংক্রমণের ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
যেমন, ত্বকের র্যাশ বা ফুসকুড়ি, শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা এবং চোখের পেছনে ব্যথা (retro-orbital pain) ডেঙ্গির ইঙ্গিত বহন করে। সাধারণত ডেঙ্গিজ্বরে সর্দি-কাশি থাকে না। বিপরীতে পজিটিভ কেসের সংস্পর্শে আসার প্রমাণসহ গন্ধ না পাওয়া, দেরিতে উপসর্গের প্রকাশ হওয়া অর্থাৎ তিন দিন পর উপসর্গের সূচনা এবং শ্বাসকষ্ট হলো করোনার ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্য।
তবে চিকুনগুনিয়াতেও ডেঙ্গির মতো মূল উপসর্গ হলো জ্বর। চিকুনগুনিয়াতেও ডেঙ্গিজ্বরের মতো মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা করা, ত্বকে লাল র্যাশ বা ফুসকুড়ি হয়। চিকুনগুনিয়াতে জ্বর সেরে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন অনেক রোগীর শরীর ব্যথা করে এবং দুর্বল লাগে। অনেকেই এমন জ্বরকে ডেঙ্গিজ্বর বলে মনে করেন।
ডেঙ্গিজ্বরে আক্রান্ত রোগী সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। অথচ চিকুনগুনিয়া হলে জ্বর চলে যাওয়ার পর রোগী দীর্ঘদিন অসুস্থ ও দুর্বল বোধ করে, শরীরের বিশেষ করে বিভিন্ন গিঁটে ব্যথা থেকে যায়। এটি মূলত আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রোগ হলেও আমাদের দেশেও ইদানীং এ রোগ হচ্ছে।
ডেঙ্গিজ্বর : চার ধরনের ডেঙ্গি ভাইরাসে মূলত দুই ধরনের জ্বর হয়- সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গিজ্বর ও রক্তক্ষরণজনিত (Hemorrhagic) ডেঙ্গিজ্বর। ডেঙ্গিজ্বর অন্যান্য ভাইরাল জ্বরের মতো নিজে থেকেই সাত দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গিজ্বর ভয়াবহ হতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ ১০৪ থেকে ১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে।
এ জ্বর ৩ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়। জ্বরের সঙ্গে শরীরে লাল লাল দাগ দেখা যায়। ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যদি কেউ প্রথমবারের মতো ডেঙ্গি ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তিনি ক্লাসিক্যাল বা সাধারণ ডেঙ্গিজ্বরে ভুগবেন। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গিজ্বর হয়। কেউ প্রথমবার ডেন-১ দিয়ে আক্রান্ত হলে শরীরে ডেন-১-এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় বা প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ফলে সে পরে ডেন-১-এ আর আক্রান্ত হবে না। কিন্তু ডেন-১ ছাড়া অন্য কোনো সেরোটাইপ যেমন- ডেন-২, ডেন-৩ বা ডেন-৪ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
ডেঙ্গিজ্বরে আক্রান্ত রোগীর মূল সমস্যা হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ, যা অনেক সময় খুব ভয়াবহ হতে পারে। ডেঙ্গির বেলায় মনে রাখতে হবে, ভয়ানক লক্ষণ সাধারণত প্রকাশ পায় জ্বর চলে যাওয়ার তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে। এ সময়টাকে বলা হয় ডেঙ্গির জটিল সময়। এ সময় রক্তনালি থেকে রক্তরস (Plasma) বের হয়ে আসে।
রোগী অজ্ঞান বা অচেতন হয়ে যায় (Dengue Shock Syndrome)। তাই জ্বর চলে গেলেই খুশি হওয়ার কিছু নেই। ডেঙ্গিতে ওই সময়টাতে সবারই সতর্ক থাকা উচিত। এ সময়ে জ্বর কমে যায়, কিন্তু রক্তক্ষরণ বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, যা দু-তিন দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। কখনো কখনো শুধু হাতের তালু, পায়ের তালু বা শরীরের ত্বকের নিচে লাল হয়ে যায় এবং চুলকায়।
শরীরের ভেতর রক্তক্ষরণ হওয়ার লক্ষণগুলো হলো- তীব্র এবং একটানা পেট ব্যথা; নাক-মুখ, দাঁতের মাড়ি বা ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ; বারবার বমি এবং সঙ্গে রক্ত যাওয়া; আলকাতরার মতো মল; খুব বেশি পিপাসা পাওয়া বা জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়া; প্রস্রাব কমে যাওয়া; চোখের সাদা অংশে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া; শরীর ঠাণ্ডা বা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া; অতিরিক্ত ঘাম হওয়া।
এসব লক্ষণের যে কোনো একটি দেখা গেলেই শিশুকে দ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে বা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া ফুসফুসে ও পেটে পানি জমতে পারে। উপরোক্ত উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসার দরকার হতে পারে।
চিকুনগুনিয়া : জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা করা, গায়ে লাল দানার মতো র্যাশ, অবসাদ, অনিদ্রা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়, এমনকি ফুলেও যেতে পারে। জ্বর সাধারণত ২ থেকে ৫ দিন থাকে এবং এরপর নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। তবে তীব্র অবসাদ, পেশিতে ব্যথা, অস্থিসন্ধির ব্যথা ইত্যাদি জ্বর চলে যাওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি মাসের পর মাসও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা বা প্রদাহ থাকতে পারে, যা অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে স্বাভাবিক কাজ করতে অক্ষম করে তোলে। রোগী ব্যথায় এতই কাতর হয় যে, হাঁটতে কষ্ট হয়, সামনে বেঁকে হাঁটে। স্থানীয়ভাবে কোথাও কোথাও তাই একে ‘ল্যাংড়া জ্বর’ বলা হয়। দেখা গেছে, রোগীর বয়স যত বেশি তার রোগের তীব্রতাও তত বেশি হয় এবং উপসর্গগুলো বিশেষ করে শরীরের ব্যথাও ততদিন ধরে থাকে।
ডেঙ্গিজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সাধারণত এত দীর্ঘ সময় ধরে শরীর ব্যথা বা অন্য লক্ষণগুলো থাকে না। এ রোগে আক্রান্ত হলে কেউ মারা যায় না, শুধু দীর্ঘদিনের জন্য অনেকেই স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। চিকুনগুনিয়া একবার হলে সাধারণত আর হয় না। কিন্তু চিকুনগুনিয়া জ্বরে ডেঙ্গির মতো রক্তক্ষরণ হয় না এবং রক্তের প্লাটিলেট সাধারণত খুব বেশি কমে না।
রোগ নির্ণয় : অনেক কারণে জ্বর হতে পারে। টেস্ট না করালে আপনি কখনো জানবেন না আপনার ডেঙ্গি আছে কিনা বা কখনো হয়েছিল কিনা। তাই জ্বর আসার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যে টেস্ট দুটি অবশ্যই করাবেন তা হচ্ছে, NS1 for Dengue ও CBC। বেশিরভাগ সময় আমরা জ্বরকে অবহেলা করি, কবে আপনি ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, আপনি নিজেও হয়তো জানেন না।
মনে রাখবেন, দ্বিতীয়বার আপনি ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হলে মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারেন। চিকুনগুনিয়া সন্দেহ হলে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। এক্ষেত্রে রোগীর রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি দেখা হয়। এতে ২ থেকে ১২ দিন লাগতে পারে।
চিকিৎসা ও পরামর্শ : ডেঙ্গির ও চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা প্রায় একইরকম। চিকুনগুনিয়া রোগটি নতুন হলেও এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এতে কেউ মারা যায় না। হয়তোবা কিছুদিন একটু ভোগান্তি বাড়ে। একটু সচেতন হলেই এ রোগ মোকাবিলা করা সম্ভব।
চিকিৎসা মূলত রোগের উপসর্গগুলোকে উপশম করা। রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি বা অন্যান্য তরল খেতে দিতে হবে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ধরনের ওষুধই যথেষ্ট, সেই সঙ্গে পানি দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। তবে এসপিরিন না দেয়াই ভালো। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গিজ্বরে আক্রান্ত রোগীর জ্বর নামার তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে ভয়ানক লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।
করণীয় : যেহেতু ডেঙ্গিজ্বরের টিকা এখনো দেশে অনুমোদিত হয়নি, আর চিকুনগুনিয়ার জন্য কোনো টিকা নেই, তাই প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এডিস মশা প্রতিরোধ। ডেঙ্গিজ্বরের বেলায় স্বচ্ছ, পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে, কিন্তু চিকুনগুনিয়াতে মশা নোংরা-অপরিষ্কার পানিতেও ডিম পাড়তে পারে।
তাই পানি জমে থাকে এমন সব জায়গাই পরিষ্কার রাখতে হবে। বাড়ি, বাড়ির আশপাশ নিজে উদ্যোগে পরিষ্কার করুন, ঝোপঝাড় কেটে ফেলুন। অব্যবহৃত টয়লেট একদিন পরপর ফ্ল্যাশ করুন। পানিতে গাছ রাখলে সেই পানি একদিন পরপর পরিবর্তন করুন। শরীরের উন্মুক্ত অংশে মসকুইটো রিপেলেন্ট লাগান। রাস্তায় চলার পথে ডাবের খোসা, টায়ার, পাত্র পড়ে থাকতে দেখলে তা তুলে ফেলে দিন।
প্রতিদিন অ্যারোসল দিয়ে ঘরের প্রতিটি কোণায় স্প্রে করুন। স্প্রে করার সময় ঘরের পর্দাগুলো ঝেরে নিন। মশারি টানিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। দিনের বেলা ঘুমালেও মশারি টানান। এ ছাড়া বাইরে যাওয়ার সময় ফুলহাতা জামা পরতে হবে, যাতে মশা কামড়াতে না পারে। জেনে রাখা ভালো, এডিস মশা মূলত দিনের বেলায় ঘরে ও ঘরের বাইরে বেশি কামড়ায়।
ডা. মনজুর হোসেন : অধ্যাপক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ; সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি