
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ভোরবেলা, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ সেলে আমার ঘুম ভাঙে শ্রমিকনেতা রুহুল আমিন ভুঁইয়ার ডাকে। তিনি বললেন, উঠুন উঠুন, মনে হয় দেশে কিছু ঘটেছে। বিছানা থেকে নেমে বাইরে সেলের বারান্দায় আসি, অন্যরাও সেল থেকে বের হয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে মশিউর রহমান যাদু মিয়া ও অলি আহাদ ছিলেন। আকাশে দুটি ফাইটার জেট উড়ে গেল। খবর পেলাম রেডিওতে ঘোষণা হচ্ছে, দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। নতুন যে সিপাই ডিউটিতে এসেছেন তিনিও শুনে এসেছেন। আর আমাদের মেট, একজন সিনিয়র কয়েদি, যিনি আমাদের সেলের দায়িত্বে নিয়োগপ্রাপ্ত, একটু পর পর জেলগেটে (জেল অফিস) গিয়ে খবর নিয়ে আসেন। তখনই মনে এলো একজনের ভবিষ্যদ্বাণী। তাহলে তার খবর ঠিক ছিল। ১৯৭৫ সালের জুলাইয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক যুবক ইসলামি বক্তা গ্রেফতার হয়ে এসেছেন। আমি তখন ‘দশ সেলে’। এই সেল ব্লকে দশটা সেল আছে তাই নাম ‘দশ সেল’। এ সেলটি জেলের সবজি বাগানের প্রাঙ্গণে। এই সেলে দালাল আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন কয়েদিও ছিলেন। একদিন দালাল আইনে শাস্তিপ্রাপ্ত কয়েদিদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য। জেলার খবর পাঠিয়েছেন দশ সেলে এক হুজুরকে পাঠানো হবে। তাই একটা সেলে ডাবলিং করা হবে। এমনিতেই অনেক সেলেই দুজন করে থাকে। দুপুরে এক শ্মশ্রুমণ্ডিত সৌম্যকান্তি যুবক হুজুর এলেন। শুনলাম তিনি প্রবল জনিপ্রয় ইসলামি বক্তা। নাম দেলোয়ার হোসেন, ডাক নাম দিলু। তবে এখন সাঈদী নামে লোকে চেনে। আমি তাকেও জানি না, শুনে অবাক হন আমার সেলমেটরা। নবাগত ডিভিশনপ্রাপ্ত না হলেও ডিভিশন বন্দিদের সঙ্গে থাকবেন তিনি। প্রথম দিন বিকালবেলা সবার সঙ্গে হাঁটতে বের হলেন। খুব দামি জামা-কাপড়। পরের দিন সকালে তিনি এলেন পরিচিত হতে। আমার বইপত্র নেড়েচেরে দেখলেন, টুকটাক কথা বললেন। তারপর থেকে নিয়মিত আসতেন আমার সেলে। লক্ষ করলাম দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্তদের সঙ্গে দলবেধে ঘোরাফেরা তিনি আর করেন না। তার ডিটেনশন অর্ডার এক মাসের। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এরপর কী হবে? আমি বললাম, প্রথমে তাই দেয়, পরে আনটিল ফার্দার অর্ডার দেয়। মানে অনির্দিষ্টকালের আটকাদেশ। উনি আমার কথা শুনে আঁতকে উঠলেন, আনটিল ফার্দার অর্ডার দিতে পারে নাকি? আমি বললাম আমার বেলায় তাই ঘটেছে। এ রকম প্রায় সবার। উনি বললেন, এক বিশেষ মহলে তার লোক আছে, তাই তার কোনো পরবর্তী আটকাদেশ আসবে না। আমার কাছ থেকে সমরেশ বসুর একটি বই চেয়ে নিয়ে গেলেন। পড়া শেষে ফেরত দিতে দিতে বললেন, চমৎকার বাংলা। বললেন, আমাদের মাওলানা সাহেবরা ভালো বাংলা জানেন না। আরবি ও উর্দু মিশিয়ে বাংলায় বয়ান করেন। তাই শ্রোতারা সব বুঝেন না।
জেলে আমাদের বই বা মুদ্রিত কিছু নেওয়ার আগে এসবি পুলিশের অনুমতি নিতে হতো। আর যদি জেল অফিসে এসবি পুলিশ তখন উপিস্থত না থাকতেন, তাহলে জেল কর্তৃপক্ষ এসবি অফিসে বই পাঠিয়ে দিতেন। তাদের অনুমোদনের পর ডেপুটি জেলার সিল মেরে লিখে দিতেন সেনসরড অ্যান্ড পাসড। রাজনৈতিক বা প্রবন্ধের বই হলে এসবি অফিসের ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দেখানোর জন্য নিয়ে যেতেন এসবির ইনস্পেকটররা। অনেক সময় তিন-চার মাস লেগে যেত ফিরে পেতে। এসবে বিরক্ত হয়ে আমার মা রাজনৈতিক প্রবন্ধের বইয়ে চমৎকার ছবিওয়ালা অন্য বইয়ের জ্যাকেট লাগিয়ে দিতেন। যেমন ধরুন, ডায়ালেকটিকাল ম্যাটিরয়ালিজম বইয়ে হ্যারল্ড রবিন্স বা সিডিন সেলডেনের বইয়ের জ্যাকেট। দেখা করার সময় আমার মা বইগুলো দেওয়ার আগে উপস্থিত এসবিকে দেখিয়ে আমাকে দিতেন এবং আমি উপস্থিত ডেপুটি জেলারকে দিতাম। এসবির ইনস্পেকটর বইটা হাতে নিয়ে দেখতেও চাইতেন না। বইয়ের কাভারের দিকে সুন্দর মহিলার ছবি নিরাসক্ত দৃষ্টিতে এসবিরা তাকাতেন। ডেপুটি জেলার সিল মেরে পাসড লিখে দিতেন। তখন বাংলা বইয়ের জ্যাকেট থাকার প্রচলন তেমন ছিল না। অধিকাংশই বোর্ডে পেস্টিং করা প্রচ্ছদ। ডেপুটি জেলার রউফ ছিলেন আমার এক বন্ধুর বন্ধু। সে হিসাবে আমারও বন্ধু। তার দায়িত্বে ছিল রাজনৈতিক বন্দিরা। সে বইয়ের বিষয়টি লক্ষ করে থাকতেও পারে, কারণ সেনসরড অ্যান্ড পাসড কথাটা বইয়ের ভেতরের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখতে হতো তাকে।
একদিন সেরকম একটা বই হুজুর সাহেব আমার কাছ থেকে নিয়ে গেলেন। আমাকে কিছু বলে ওঠার কোনো সুযোগ না দিয়েই। পরের দিন ফেরত দিতে দিতে বললেন, তিনি ভুল বই নিয়ে গেছেন। বইটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস আর জ্যাকেট ছিল অন্য একটি বইয়ের। বইটা ছিল হার্ড বাউন্ড। আমি মনে মনে হাসলাম। তিনি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিলেন কি না জানি না। তার সঙ্গে কথাবার্তা সাবধানে বলতাম, কারণ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য বারবার সরকারি লোকেরা আসত। জেল অফিসে কাজ করে এক কয়েদি সাবধান করেছিলেন আমাকে। ব্যক্তিগত কথাবার্তা তার সঙ্গে তেমন না হলেও তিনি আমার বিষয়ে ভালোই জানতেন। খোঁজখবর নিয়েছেন হয়তো। আমাকে একদিন বলেন, আপনি তো এক ছেলে, বোন আছে কয়েকজন, বাবাও নেই, জীবন কি এভাবেই চলবে? আপনারা যে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা করেন তার জন্য কি টাকাপয়সা পান? আমি বললাম, না। বরং সভা করতে গিয়ে সংগঠকদের কিছু টান পড়লে হাতে যা আছে দিয়ে আসতে হয়। তিনি বললেন, হ্যাঁ, জানি আপনাদের কথা। আমি মাহফিলে গেলে কম করেও দশ হাজার টাকা পাই। যাতায়াতের খরচ ও হোটেল ভাড়া তারাই দেয়। ১৯৭৫ সালে দশ হাজার টাকা তো অনেক টাকা। আমি ভাবতেই পারি না কেউ ওয়াজ করে এত টাকা আয় করে। তিনি বললেন, ওয়াজের আয় দিয়ে তিনি খুলনায় বাড়ি করেছেন। তার কার্গো ও লাইটারেজ জাহাজ আছে। গায়ের দামি পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি দেখিয়ে বললেন এগুলো তার ভক্তরা দেয়। তাকে কিছু কিনে পরতে হয় না।
তিনি দিন গুনেন আগস্টে মুক্তি পাওয়ার। ১৮ তারিখ তার ডিটেনশনের মেয়াদ শেষ হবে। তিনি একদিন বললেন, তার ডিটেনশন আর বাড়বে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেন এমন ধারণা করছেন। তিনি বললেন, পরিবর্তনও আসবে দেশে। আমি তার কথাটার গুরুত্ব দিইনি। জেলে এলে অনেকেই এরকম ভেবে থাকে। তবুও একবার জিজ্ঞাসা করলাম কেন ধারণা হচ্ছে পরিবর্তনের কথা। উনি বললেন, তার একজন লোক আছে উচ্চ জায়গায়, তার কাছ থেকে শুনেছেন। আমি মনে মনে হাসলাম। তিনি বললেন, তাকে জেলে আসতে হতো না যদি তার লোকজন সময়মতো খবর পেত। তখন জেলার ছিলেন আমিনুর রহমান। বাড়ি গোপালগঞ্জ। খুব ক্ষমতা দেখাতেন। অবাক হতাম দেখে যে তিনিও তাকে সমীহ করেন। কোনো মহল থেকে নির্দেশ ছিল কি! তার বিষয়ে কনফিউজড ছিলাম। ’৭৪ সালে জেলে যখন ওল্ড হাজতে ছিলাম, সেটা ছিল ওয়ার্ড, একসঙ্গে অনেক লোক থাকতাম। কবি দাউদ হায়দার তার নিরাপত্তার কারণেই ছিলেন সেগ্রেগিটেড সেলে। তখনকার জেলার সামসুর রহমান তাকে সেল থেকে আমাদের এখানে দিয়ে গেলেন। বললেন, এনাকে একটু দেখে রাখবেন। ওল্ড হাজতে প্রায় সবাই জাসদের। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ গ্রেফতার হয়ে এসেছেন। কিছুদিন পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি ও চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মানিক চৌধুরী এক মামলায় গ্রেফতার হয়ে এলেন। তিনি দাউদ হায়দারকে বললেন, যেহেতু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর সঙ্গে তোমাদের পরিবারের ভালো পরিচয়, চেষ্টা করে দ্রুত মুক্তি নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাও। দেশে দক্ষিণপন্থি ক্যু হতে পারে, ওরা তোমাকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে। তার কথায় পরিপূর্ণ বিশ্বাস আনতে না পারলেও দক্ষিণপন্থিরা যে ফিরে আসতে শুরু করেছে, সেটা অনুভব করছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছরের মধ্যে দাউদের কবিতাকে কেন্দ্র করে মাওলানা মৌলবিরা যেভাবে জমায়েত মিছিল করেছে, তা সত্যিই ছিল অকল্পনীয়। এর পরে জেলে বসেই শুনেছি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকায় আগমনকে কেন্দ্র করে বিপুল মানুষের সমাগম, উল্লাস ও সংবর্ধনার খবর।
মেট এসে জানাল, খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। দশ সেলের দিকে তাকিয়ে দেখি খুব চাঞ্চল্য। দালাল আইনে শাস্তিপ্রাপ্তরা জেল অফিসের দিকে উঁকিঝুঁকি করছে। তারা বারবার জেল গেটের দিকে তাকায়, সেখানে জাতীয় পতাকার পরিবর্তন হয়েছে কি না দেখতে। ওখান থেকে সরাসরি জেল অফিস দেখা যায়। খবর পেলাম, জেল অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলেছেন জেলার সাহেব। উৎসাহের সঙ্গে দশ সেলের একজন সেলের গেটের কাছে এসে এ খবরটা জানিয়ে গেলেন। আমি দুদিন আগেও দশ সেলে ছিলাম। দেওয়ালের ওপারে চকবাজারের বাড়ির ছাদে ছাদে মানুষ। আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছে। একটু পরেই সুবেদার এসে আমাদের যার যার সেলে যেতে বললেন। আমাদের সেলে তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো। সুবেদার বললেন, তিন বাহিনীর প্রধান রেডিওতে ভাষণ দিচ্ছেন। পত্রিকাও দিয়ে গেল আমাদের মেট এই অবরুদ্ধ অবস্থায়। যথারীতি পত্রিকায় বাকশালকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানাতে মানুষের ঢলের ছবি। পত্রিকা বিছানার এক পাশে রাখতে রাখতে ভাবলাম এসব আজ থেকেই পালটে যাবে। সাঈদীর কথাগুলো মনে পড়ে। খুবই কনফিডেন্টলি বলেছিলেন তার ডিটেনশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পরিবর্তন আসবে।
সাঈদী তার ডিটেনশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার একদিন আগে ১৭ আগস্ট মুক্তি পান। তার অর্থ তার ডিটেনশন রিভোক বা বাতিল করা হয়েছে। বিষয়টি কোনো সাধারণ ঘটনা মনে হয়নি। তার ডিটেনশনের মেয়াদ তো শেষ হয়ে যেত মাত্র একদিন পরেই। মাত্র একদিনের জন্য আটকাদেশ বাতিল কেন? দশ সেলের দালাল আইনের বন্দিরাও বললেন, হুজুর আগেই জেনেছিলেন।
প্রায় পনেরো-বিশদিন পর তিনি এলেন জেলের সিপাইদের আয়োজিত এক ওয়াজে। জেল কম্পাউন্ডে বাইরের অংশে জেলের কর্মচারীদের আবাসস্থলে ওয়াজ হলো। তার নামের সঙ্গে সাঈদী যোগ করে মাইকে ঘোষণা হলো। খুব ভালো বক্তা। অন্যরা যেমন আরবি-উর্দু মিশিয়ে ওয়াজ করেন, তারটা সেরকম না। তিনি তার জেলযাপনের দিনের কথা বললেন। আমার কথাও উল্লেখ করলেন এভাবে, আমার বামপন্থি বন্ধু। কিন্তু আমরা ভালো কাজটা করি ডান হাতে। কিন্তু ওনার (আমার) রাজনীতি বামদিক। এও বললেন, নিশ্চয়ই আমি তার কথা শুনছি।
১৫ আগস্টের ঘটনার পূর্বাভাস তিনি আদৌ পেয়েছিলেন কি না অনুসন্ধান করেছি। ১৫ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা ৩ নভেম্বের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যারা, তাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেছি। তাদের অনেকেই বন্দি হয়েছিল। কর্নেল সাফায়েত জামিল ছিলেন আমার পাশের সেলে। কুমিল্লা জেলে কর্নেল ফারুককে পেয়েছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে কেউ বলতে পারেননি। ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীদের একজন দাবি করেছিলেন যে, তারা মোশতাকের আগে আরও দুজন সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন তাদের মনোভাব বোঝার জন্য। কিন্তু এই দুই নেতা কি অন্যদের জানিয়েছিলেন? কয়েকদিন পরেই আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে আওয়ামী লীগ নেতারা জেলে এলেন-তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ও অন্যরা। তাদের রাখা হলো নিউ জেলে। এ ব্লকটি বিশেষ প্রিজনারদের জন্য বানানো হয়েছিল। ‘জেলের ভেতরে জেল, তার নাম নিউ জেল’। ২২ আগস্ট মনসুর আলীর নিউ জেল উদ্বোধন করার কথা। ওই আগস্টেই তিনি ও তার সহকর্মীরা বন্দি হয়ে এলেন এবং তাদের নিউ জেলে থাকার মধ্য দিয়েই নিউ জেল চালু হলো। ৩ নভেম্বর চার নেতা নিহত হলেন নিউ জেলে।
লেখক : জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি