স্বদেশ ভাবনা
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
আবদুল লতিফ মণ্ডল
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ফটো
গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী, কার্যকর ও স্বাবলম্বী করা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম লক্ষ্য।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার বিশ্বাস করে, সংবিধানের আলোকে সব অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করার জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা আবশ্যক।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী, কার্যকর ও স্বাবলম্বী করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী যেসব উদ্যোগের উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-এক. নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক সুবিধা সম্প্রসারণে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ; দুই. দেশের প্রতিটি গ্রামে উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগব্যবস্থা, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা, মানসম্মত শিক্ষা, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ বৃদ্ধি, কম্পিউটার ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ মানসম্পন্ন ভোগ্যপণ্যের সম্প্রসারণের মাধ্যমে আধুনিক শহরের সব সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন; তিন. স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান; চার. স্থানীয় সরকারের পাঁচটি স্তরকে (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন) আরও শক্তিশালী ও স্বাবলম্বী করে অধিক কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিবিড় ভূমিকা পালনে সক্ষম, স্বীয় আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজস্ব ব্যয় নির্বাহ করার সুযোগ সৃষ্টি, স্ব-স্ব এলাকার উন্নয়নে কার্যকর অবদান রাখা এবং আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্থানীয় সরকার সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর পর্যালোচনাপূর্বক যুগোপযোগী করে সংশোধনের প্রস্তাব প্রণয়ন, সংস্কারের উদ্দেশ্যে এর আগে গঠিত বিভিন্ন কমিশন, কমিটির দাখিলকৃত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের জন্য স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাবে নীতিগত সম্মতি প্রদান; পাঁচ. তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেবার মান বৃদ্ধি এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য জানুয়ারি ২০১৭ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত মেয়াদে লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট-৩ (এলজিএসপি-৩) বাস্তবায়ন।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ইতিহাস সুখকর নয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরে গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের (অতঃপর মূল সংবিধান হিসাবে উল্লিখিত) ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’
আর ৫৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ কিন্তু সংবিধানের এসব নির্দেশনা এখনো অনেকটা অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের জায়গায় একদলীয় রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন এবং সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদের ‘এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’ অংশটুকুর বিলুপ্তি।
১১ অনুচ্ছেদের এ সংশোধনীর ফলে স্থানীয় সংস্থা সম্পর্কিত বিধানাবলি অকেজো হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব এবং তার পরিবারের উপস্থিত সব সদস্যকে হত্যা করে। অতঃপর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে চিফ অফ আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের এবং ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল একইসঙ্গে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর মাধ্যমে তিনি তিন ধরনের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা যেমন- ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ ও জেলা পরিষদ প্রবর্তন করেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলে উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরে নির্বাচনের মাধ্যমে এ পদে নিয়মিত হন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন চিফ অফ আর্মি স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচএম এরশাদ। এরশাদের শাসনকালে স্থানীয় সরকার কাঠামোয় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। এরশাদ গঠিত ‘প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি’র সুপারিশের আলোকে থানাকে উপজেলা এবং মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। উপজেলা পদ্ধতির প্রবর্তন ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে ছিল-কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তরটিকে শক্তিশালী করে তৃণমূলে উন্নয়নের গতি সঞ্চার করা, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ভিত্তি রচনা করা। সরকারের বিভিন্ন অফিস ও আদালত স্থাপনের ফলে উপজেলাগুলো প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
মহকুমা জেলায় উন্নীত হওয়ার ফলে জেলার সব সুযোগ-সুবিধা জনগণের অনেকটা কাছে চলে আসে। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের শাসনামলে প্রণীত স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনে জেলার সব এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভা চেয়ারম্যান, মনোনীত সাধারণ ও মহিলা সদস্য এবং কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তাকে জেলা পরিষদের সদস্য করার বিধান করা হয়।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর এ আইনটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠিত হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত ঘোষিত সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল করে, যা বর্তমানেও চালু রয়েছে।
বিএনপি সরকার এরশাদ প্রবর্তিত উপজেলা পদ্ধতি বিলুপ্ত করে, যা ছিল বিএনপির একটি ভুল সিদ্ধান্ত। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার তিন মেয়াদের শাসনামলে উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ পুনরুজ্জীবিত করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার উপজেলা আইন ১৯৯৮ পাশ করলেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
অনুরূপভাবে ২০০০ সালে জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন করলেও আইনটি বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিগত সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) ২০০৮ অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে উপজেলা আইন ১৯৯৮ বাতিল করে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর উপজেলা পরিষদ আইন ২০০৯ জারি করে। এতে কিছু সংশোধনীসহ বাস্তবে উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ পুনরুজ্জীবিত এবং উপজেলা পদ্ধতি আবার চালুর ব্যবস্থা করা হয়।
কিন্তু উপজেলা আইনে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা নিয়োগ এবং পরিষদ কর্তৃক তার পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করার বিধানের কারণে পরিষদের কাজের ওপর সংসদ সদস্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে উপজেলা পরিষদ এক অর্থে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে।
২০০০ সালের জেলা পরিষদ আইনের মাধ্যমে জেলা পরিষদ নির্বাচনে এমন এক পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। ভোট দেবেন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা নির্বাচকমণ্ডলী। এ পদ্ধতি আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনীয়।
২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্বাচন হয় নির্দলীয়ভাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১৪-২০১৮ মেয়াদে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) (সংশোধন) আইন-২০১৫; উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন-২০১৫; স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) আইন-২০১৫ এবং স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) আইন-২০১৫-এর মাধ্যমে কেবল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল মনোনীত এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য ঘোষণা করা হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহী পদে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে নির্বাচনের ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পদে নির্দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের অবসান ঘটে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহী পদে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন সমাজের বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছিলেন, এর ফলে সমাজে, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে হাজার বছরের সামাজিক বন্ধনে ফাটল ধরবে। দলীয় আনুগত্যের কারণে একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সদ্ভাব নষ্ট হয়ে যাবে। তাদের এ উদ্বেগ ইতোমধ্যে বাস্তব রূপ ধারণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংবিধানের আলোকে সব অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এটা নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার উপলব্ধি।
তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, সত্তর ও নব্বইয়ের দশকে প্রায় ৯ বছরসহ ২০০৯ সাল থেকে একটানা এক যুগের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ কেন দেশের সব অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি?
আসলে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করার জন্য দরকার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন-সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। গত প্রায় এক দশক ধরে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদাহরণ খুবই কম।
প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধি বাস্তবায়নে প্রয়োজন জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা।
প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এটা খুব ভালো কথা। বর্তমানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন আইন ও বিধি দ্বারা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। উদাহরণস্বরূপ, জেলা পরিষদের সব কাজের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান। জেলা পরিষদে কী ধরনের কাজ হবে তা সরকারের নির্দেশনার ওপর নির্ভরশীল। কতিপয় শর্তসাপেক্ষে সরকার পরিষদের কার্যক্রম বাতিল করতে পারবে, পরিষদ কর্তৃক গৃহীত কোনো প্রস্তাব অথবা প্রদত্ত কোনো আদেশের বাস্তবায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে পারবে এবং প্রস্তাবিত কোনো কাজকর্ম সম্পাদন নিষিদ্ধ করতে পারবে। তাছাড়া জেলা পরিষদ আইনের ৩০ ধারা মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে এমপিরা জেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োজিত আছেন এবং পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে তারা বাস্তবে জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তদন্তসাপেক্ষে সরকার উপজেলা পরিষদ বাতিল করতে পারে।
তাছাড়া আইনে পরিষদের কার্যাবলির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায়ের বিধান করা হয়েছে। যেহেতু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে ইচ্ছুক নয়। গত বছরের ১৪ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, একদিকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো বলে তারা স্বাধীন, অন্যদিকে আবার টাকা উঠাতে পারে না। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সহায়তা চায়। এ দুটি তো একসঙ্গে চলতে পারে না। তারা যদি স্বাধীন হয়, তাহলে স্বাধীনভাবে চলুক।
সরকারকে এ মনোভাব থেকে সরে এসে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিষদগুলোকে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে এবং কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। সুশীল সমাজসহ অনেকেই অনেক দিন ধরে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে।
সবশেষে বলতে চাই, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী, কার্যকর ও স্বাবলম্বী করার জন্য প্রধানমন্ত্রী যেসব উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন, সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। তৃণমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা হোক।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com