জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
শিশুবন্ধু ডা. এম আর খান

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
শিশু চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রবাদপুরুষ, শিশুবন্ধু, সমাজহিতৈষী, শিক্ষাবিদ, দক্ষ চিকিৎসা প্রশাসক ও সফল শিল্পোদ্যোক্তা জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফি খান, যিনি এমআর খান নামেই ছিলেন বেশি পরিচিত-আজ তার জন্মদিন। এই নির্লোভ, প্রচারবিমুখ, সদাহাস্য মানুষটি তার বিভিন্ন জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন সমাজে অসংখ্য মানুষকে সেবা দিয়ে গেছেন।
ডা. এমআর খান সাতক্ষীরা জেলার রসুলপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা (পিরালি বংশখ্যাত) আবদুল বারী খান এবং মা জায়েরা খানম (সংবাদপত্রজগতের পথিকৃৎ মওলানা আকরম খাঁর নিকটাত্মীয়)। তার সহধর্মিণী মরহুম আনোয়ারা খান (কলকাতা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের ছাত্রী) ছিলেন একজন স্বনামধন্য সমাজসেবী। সাতক্ষীরা ধন-ধান্যে, মৎস্যে সমৃদ্ধ বহুকাল আগে থেকেই। এমআর খান প্রায়ই আউড়াতেন এ ছড়াটি-‘দেশের সীমানা, নদীর ঠিকানা যেথায় গিয়েছে হারিয়ে, / সেথা সাতক্ষীরা, রূপময় ঘেরা বনানীর কোলে দাঁড়িয়ে।’
শিশুবন্ধু এমআর খানের জীবনদর্শন ছিল কর্মচাঞ্চল্য আর মহৎ ভাবনার সরোবরে সাঁতার দিয়ে মানবকল্যাণে নিবেদিত হওয়া। নিবেদিতা মেডিকেল ইনস্টিটিউট আর অগণিত শিশু চিকিৎসাসদন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সেই স্বপ্নের ডানা মেলে ফিরেছে সাফল্যের আকাশে। এসবের মাঝেই চিরভাস্বর হয়ে রইবে তার স্মৃতি। ‘উপকার করো এবং উপকৃত হও’-এ মহাজন বাক্য তার জীবন ও কর্মে, মনন ও মেধায় পথচলা ও জীবনসাধনায় স্বতঃসিদ্ধের মতো অর্থবহ হয়েছে এবং কার্যকর ছিল।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এমআর খান মনে করতেন রোগীও একজন মানুষ। আর এ রোগীটি সমাজে আমাদেরই কারও না কারও আত্মীয়, স্বজন-এমনকি আপনজন। রোগী যখন ডাক্তারের কাছে আসেন, তখন সাহায্য প্রার্থী, কখনো কখনো অসহায় বটে। আর রোগীটি যদি শিশু হয়, তাহলে তো কথাই নেই। ডাক্তারের কর্তব্য হবে রোগীর সমস্যা গভীর মনোযোগের সঙ্গে ধৈর্যসহকারে শোনা, রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন রোগীর অভিভাবকদের প্রতি ডাক্তারের সহমর্মিতা প্রদর্শন ও আশ্বস্ত করা। সব রোগীই তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে এমনটিও ঠিক নয়। কারও কারও সুস্থ হতে সময় লাগতে পারে। মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তিনি বলতেন, হায়াত ও মউতের মালিক যেমন আল্লাহতায়ালা; তেমনই রোগ থেকে মুক্তিদাতাও তিনি। তবে রোগীর আপনজন এমন যেন বলতে না পারেন যে ডাক্তার আন্তরিক ছিলেন না, ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
শিশুর সেবার মানসে তিনি ১৯৮৩ সালে শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঢাকার মিরপুরে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ ও শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং যশোরে শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। মানুষের সৃজনশীল সম্ভাবনার সত্তাকে পুষ্টি দিয়ে মননশীল করে সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থভাবে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে-এ সুযোগ লাভ তার অধিকার। ডা. এমআর খান শিশু চিকিৎসার ওপর বিদেশে বড় ডিগ্রি অর্জন করে সেখানে উঁচু মাপের চাকরির সুযোগ-সুবিধা পরিত্যাগ করে চলে এসেছিলেন নিজ দেশে। দেশে শিশু চিকিৎসাব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন পথিকৃতের ভূমিকায়।
শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন ছাড়াও স্থানীয় জনগণ এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় তিনি তার পেনশনের টাকা, পৈতৃক জমিজমা এবং স্ত্রীর সঞ্চয়ের অর্থে ১৯৮৫ সালে সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এ হাসপাতাল বছরে প্রায় ১৮ হাজার শিশুকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে। ডা. খান ১৯৮৮ সালে তার নিজ গ্রাম রসুলপুরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এ স্কুলে প্রায় ৬০০ ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। তার প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য অন্য প্রতিষ্ঠান হচ্ছে-১. ডা. এমআর খান অ্যান্ড আনোয়ারা ট্রাস্ট; ২. উত্তরা মহিলা মেডিকেল কলেজ; ৩. নিবেদিতা চিল্ড্রেন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্স সেন্টার; ৪. সেন্ট্রাল হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেড। ‘নিজের গ্রামকে আগে দারিদ্র্যমুক্ত করি’-এ প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ে দীপ্ত বাংলাদেশের সব সচেতন মানুষ তার মতো কর্মবীরের অনুসরণে একযোগে কাজ করতে পারলে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা আর সুদূরপরাহত থাকবে না। ‘রসুলপুর আদর্শ গ্রাম’ মডেলে তার প্রত্যয় ও প্রত্যাশা ছিল-গড়ে উঠুক বাংলাদেশের আটষট্টি হাজার গ্রাম ও জনপদ।
একজন মহৎপ্রাণ মানুষ নিজের জন্য নয়, অন্যের কল্যাণে নিবেদন করেন নিজের সব ধন ও ধ্যানধারণা। উৎসর্গ করেন নিজের স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ ভাবনাকে। এমআর খান অ্যান্ড আনোয়ারা বেগম ট্রাস্ট ফান্ড এমন এক মহৎ উদ্দেশ্যে নিবেদিত। শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন আর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি উৎসর্গ করেছেন নিজের সঞ্চয়, সম্পদ ও সামর্থ্য। নিজের একমাত্র কন্যাসন্তান ডা. ম্যান্ডি করিম কানাডায় প্রবাসী এবং ২০১১ সালে স্ত্রী আনোয়ারা খানের মৃত্যুর পর নিজের জন্য, পরিবারের জন্য যেন ছিল না তার আর কোনো পিছুটান। তাই একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তার একান্ত প্রত্যাশা ছিল স্থায়িত্ব লাভ করুক জনদরদি এ ফান্ড ও প্রতিষ্ঠান। সাতক্ষীরা তথা দেশের মানুষ পাক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ জীবনযাপনের দিশা। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে তার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দেখেছেন, শিখেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন মানুষের অসহায়ত্বের সহায় হয়ে দাঁড়ানোর অনিবার্যতা। সুদূর পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামায় বোধিছড়া গ্রামে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ কোয়ান্টামেও তিনি রেখেছেন শিশুবিকাশে তার সৃজনশীল হাতের স্পর্শ। ‘দুর্বল মানুষ যদি পার হয় জীবনের অথৈ নদী’, তাতে নিজের কোনো ক্ষতি নেই বরং বিপন্মুক্ত মানুষের কলরবে, সাফল্যে ভরবে দেশ ও জাতি।
চিকিৎসা ও সমাজসেবায় একজন লেখক ও গবেষক হিসাবেও তার ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। চিকিৎসা শাস্ত্রে তার প্রকাশনার তালিকায় রয়েছে-১. আপনার শিশুর জন্য জেনে নিন; ২. মা ও শিশু; ৩. Essence of Pediatrics; ৪. প্রাথমিক চিকিৎসা; ৫. আপনার শিশুকে সুস্থ রাখুন; ৬. Essence of Endoscopy; ৭. Drug Therapy in Children. এছাড়া তার অন্যূন ৩৭টি রিসার্চ পেপার দেশ-বিদেশে স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক ডা. এমআর খান শিশুরোগ চিকিৎসা ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বিভিন্ন সময়ে তার কর্মের স্বীকৃতি পেয়েছেন, হয়েছেন ঈর্ষণীয় সম্মানে ভূষিত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে মনোনীত করে তার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে। তার প্রাপ্ত অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কারের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-১. শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে অসামান্য অবদানের জন্য স্বর্ণপদক, ১৯৮৬; ২. ম্যানিলাভিত্তিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের অ্যাসোসিয়েশন অব পেডিয়েট্রিকস পদক, ১৯৯১; ৩. ওয়ার্ল্ড অ্যাসট্রোলজিক্যাল সোসাইটি সংবর্ধনা ও পদক, ১৯৯২; ৪. শেরেবাংলা জাতীয় স্মৃতি সংসদ স্বর্ণপদক, ১৯৯২; ৫. কবি নজরুল ইসলাম জাতীয় পুরস্কার ও স্বর্ণপদক, ১৯৯৩; ৬. বাংলাদেশ পেডিয়েট্রিক অ্যাসোসিয়েশন সংবর্ধনা ও পদক, ১৯৯৪; ৭. খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা স্বর্ণপদক, ১৯৯৮; ৮. ইবনে সিনা স্বর্ণপদক, ১৯৯৮; ৮. বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজসেবা স্বর্ণপদক, ১৯৯৯; ৯. সমাজসেবা বিষয়ে অবদানের জন্য একুশে পদক, ২০০৯; ১০. বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক, ২০১৬।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান