Logo
Logo
×

বাতায়ন

মেডিকেল অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা প্রাপ্যতা ও করণীয়

Icon

ডা. আয়শা আকতার

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মেডিকেল অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা প্রাপ্যতা ও করণীয়

কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে মেডিকেল অক্সিজেন একটি জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা অনুষঙ্গ। করোনা আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই মৃদু লক্ষণ-উপসর্গ দেখা গেলেও কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ মারাত্মক হতে পারে এবং সেসব ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি, আইসিইউ সেবা ও কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন পড়ে।

গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে গেলে ফুসফুসে প্রদাহ (নিউমোনিয়া), হাইপক্সিমিয়া (রক্তে অক্সিজেনের স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া) ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয়। এসব ক্ষেত্রে বাইরে থেকে মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেনের সঠিক মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমরা জানি, শরীরের প্রতিটি কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অক্সিজেন একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।

করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে যদি কোনো কারণে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদে তা চিকিৎসাহীন অবস্থায় থাকে, তাহলে দীর্ঘস্থায়ী অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে শরীরের কোষগুলো ক্রমেই কর্মক্ষমতা হারায় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে একেবারেই অকার্যকর, এমন কী মৃতকোষে পরিণত হয়। মানবদেহের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন- হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি এবং মস্তিষ্ক অক্সিজেনের অভাবে ক্রমান্বয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে বিকল হয়ে যেতে পারে, এমন কী রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

এ কারণেই অক্সিজেন করোনা চিকিৎসায় একটি জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা। সম্প্রতি ভারতে অক্সিজেনের তীব্র ঘাটতির কারণে সহস্রাধিক রোগীর মৃত্যুর ঘটনা এ অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটির উৎপাদন ও সরবরাহের প্রয়োজনীয়তাকে বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।

মেডিকেল অক্সিজেন কী?

প্রাকৃতিক বাতাস থেকে সংগৃহীত অক্সিজেনকে বিশেষ পদ্ধতিতে (প্রেশার সুইং এবসরপশন) কয়েকটি ধাপে আলাদা করে সংকুচিত করার পর বিশুদ্ধ (৮২ শতাংশ) মেডিকেল অক্সিজেন তৈরি হয়। সাধারণত উৎপাদনের পর তরল (বৃহদাকার ট্যাংক) কিংবা বায়বীয় (উচ্চ চাপসম্পন্ন গ্যাস সিলিন্ডার) উভয় অবস্থাতেই অক্সিজেন পরিবহণ ও সংরক্ষণ করা যায়, যা পরবর্তী সময়ে রোগীর শরীরে অক্সিজেন মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা হাসপাতালগুলোয় ব্যবহার করে থাকি।

আমাদের দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে বায়বীয় বা গ্যাসীয় অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়, কারণ এটি মূল্যসাশ্রয়ী এবং সহজে সংরক্ষণ করা যায়। অপরদিকে, তরলীকৃত অক্সিজেনের প্রক্রিয়াজাতকরণ কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও এর সুবিধা হলো নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাংকে গ্যাসীয় অক্সিজেনের তুলনায় এটি বেশি পরিমাণে সংরক্ষণ করা যায়।

প্রাকৃতিক বাতাসের প্রাচুর্য সত্ত্বেও অক্সিজেনের অপ্রতুলতা কেন?

প্রকৃতিতে বাতাসের প্রাচুর্য (আমাদের প্রাকৃতিক বাতাসের প্রায় ২১ শতাংশ হচ্ছে অক্সিজেন) থাকলেও ব্যবহার উপযোগী বিশুদ্ধ মেডিকেল অক্সিজেন প্রস্তুত করতে বিশেষায়িত প্রযুক্তির ব্যবহার প্রয়োজন। প্রযুক্তিগত অপ্রতুলতা তাই মেডিকেল অক্সিজেন প্রাপ্যতা ও সরবরাহে প্রধান প্রতিবন্ধক। দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, প্রস্তুতকৃত অক্সিজেনের সঠিক বণ্টন ও বিতরণ ব্যবস্থার ঘাটতি, যা অক্সিজেনের যথাযথ উৎপাদন এবং বণ্টন সত্ত্বেও প্রয়োজনসাপেক্ষে রোগীর অক্সিজেন প্রাপ্যতার অন্তরায়। তৃতীয় সমস্যাটি হচ্ছে, মেডিকেল অক্সিজেন ব্যবহারের নিয়ম তথা উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণের সম্যক ধারণার অভাব।

বাংলাদেশে অক্সিজেনের বর্তমান জোগান ও চাহিদা

বাংলাদেশে বিগত কয়েক মাসে করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারে মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে দেশে গড়ে প্রতিদিন ৯০-১০০ টন মেডিকেল অক্সিজেন ব্যবহার হয়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে মার্চের শুরুর দিকে দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে, যা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে (দ্বিতীয় ঢেউয়ের শীর্ষে) সর্বোচ্চ ১৪০ টন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে সাম্প্রতিক করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে বিগত কয়েক সপ্তাহে অক্সিজেনের দৈনিক চাহিদা মার্চের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি (বর্তমানে ৩০০ থেকে ৫০০ টন পর্যন্ত)। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে দেশের প্রধান অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডা বাংলাদেশ লিমিটেড এবং স্পেক্ট্রা অক্সিজেন লিমিটেডের পাশাপাশি তৃতীয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড সম্মিলিতভাবে দৈনিক ১৮০ টন বা ১,২৬,০০০ ঘনমিটার অক্সিজেন সরবরাহ করছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের গ্রুপ অক্সিজেনের বাড়তি চাহিদা মেটাতে তাদের নিজস্ব প্ল্যান্টে তরল বা লিকুইড অক্সিজেনের উৎপাদন করছে এবং মেডিকেল অক্সিজেন সহায়তা কার্যক্রমের অংশ হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ৩০ টন লিকুইড অক্সিজেন সরবরাহ করছে।

ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার জোগান দিতে দেশের প্রধান অক্সিজেন উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে তাদের নিজস্ব প্ল্যান্টে দৈনিক ২০০ টনের অধিক মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করছে এবং সর্বাধিক সক্ষমতা দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অক্সিজেন সরবরাহ আপাতত স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডা বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিদিন প্রায় ৯৫ টন তরল ও বায়বীয় অক্সিজেন উৎপাদন করে এবং দৈনিক মোট জোগানের প্রায় ৯০ শতাংশ সরবরাহ করছে। অপরদিকে ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের নিজস্ব প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৫৪ টন সত্ত্বেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে এবং যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বর্তমানে দৈনিক মাত্র ৩৩ টন অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে।

স্পেক্ট্রা অক্সিজেন লিমিটেডের বর্তমান মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহের পরিমাণ দৈনিক গড়ে ৫০ টন, যা মার্চের আগে ছিল মাত্র ৩০ টন। কাঁচামাল সংকটের কারণে তাদের এ অতিরিক্ত অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য গ্যাস আমদানি করতে হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে কোনো কারণে ব্যাহত হলে বাড়তি অক্সিজেনের জোগান অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। ২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা আবুল খায়ের গ্রুপের অক্সিজেন প্ল্যান্টটির শুরুতে মাত্র সাত টন অক্সিজেন সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে তা দৈনিক ৩০ টনে উন্নীত করা হয়েছে।

এ ছাড়া আরও অন্তত ছয়টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অক্সিজেন উৎপাদক প্ল্যান্ট মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সম্প্রতি প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং লিন্ডা বাংলাদেশের উদ্যোগে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে প্রায় দুই হাজার টন তরল অক্সিজেন স্থলপথ ও রেলযোগে বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে দেশে পৌঁছেছে। এখন থেকে নিয়মিতভাবে ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করা সম্ভব বলেও সরবরাহ সূত্রে জানা গেছে।

সম্ভাব্য করণীয়

প্রতিদিনই হুহু করে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। করোনা হাসপাতালগুলোতে ইতোমধ্যে ধারণক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে, যাদের বৃহদাংশেরই অক্সিজেন স্যাচুরেশনের মাত্রা অস্বাভাবিক কম। এ অবস্থায় এসব রোগীকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। করোনা মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের বাড়তি চাহিদার জোগান দেওয়ার লক্ষ্যে আপাতত দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো অক্সিজেনের বাণিজ্যিক ব্যবহার সীমিত বা প্রয়োজনসাপেক্ষে বন্ধ রাখা যেতে পারে।

এ ছাড়া যেসব প্ল্যান্টে বর্তমানে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন হচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠানে নির্বিঘ্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ, সুষ্ঠু বিপণন ও বণ্টন নিশ্চিত করা জরুরি। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বেসরকারি পর্যায়ে যেসব কোম্পানি অক্সিজেন সরবরাহ করছে, তাদের পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক অক্সিজেন প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ভবিষ্যতে দেশকে একটি অক্সিজেন স্বনির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থা উপহার দিতে পারে।

করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে এর সহযোগী সংস্থাগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় ১৪৮টি দেশে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন প্রাপ্তি নিশ্চিতে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা প্রদান করেছে। সংস্থাটি অক্সিজেন উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি নিজ নিজ দেশের অক্সিজেন ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছ মূল্যায়ন করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। কেননা, বর্তমান অক্সিজেন ব্যবস্থাপনার সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা, উন্নতির ক্ষেত্র, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ইত্যাদি শনাক্ত করা গেলে এ খাতে বিনিয়োগ দেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্য খাতকে আগামীতে একটি শক্তিশালী এবং টেকসই অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা উপহার দিতে পারবে।

ডা. আয়শা আকতার : জীবাণুবিদ, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম