
প্রিন্ট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১৬ এএম

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সরকারি আমলাদের সম্পৃক্ত করায় দেশের বুকে নতুন এক ধরনের আমলাতন্ত্র জেঁকে বসেছে এবং একশ্রেণির আমলা নিজেদের স্বার্থে তার সদ্ব্যবহার করে চলেছেন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অর্থ নয়-ছয় করে সেসব অর্থ তারা নিজেদের পকেটে ঢুকাচ্ছেন! যেমন সারা দেশের উপজেলাগুলোতে গৃহহীনদের মাঝে গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
আর সেসব দেখেশুনে সরকারি দলের সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শাস্তি গ্রহণের কথা বলে ইতোমধ্যে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি সরকারি ব্যয়ে পুনর্নির্মাণ এবং মেরামত করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, গৃহহীন দরিদ্র মানুষের জন্য নির্মিত এসব ঘরবাড়ি এক বছরও টিকবে না, সেভাবেই বা নির্মাণ করা হলো কেন? আর সারা দেশে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সদ্যনির্মিত এসব ঘরবাড়ি ৬ মাস বা বছর না ঘুরতেই নষ্ট হয়ে যাবে এবং আবার সরকারি খরচে তা মেরামত বা পুনর্নির্মাণ করা হবে সেটাই বা কেমন কথা? নাকি এ ক্ষেত্রেও ‘সরকারকা মাল দরিয়ামে ঢাল’ নীতির সফল প্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে!
এ বিষয়ে আমার এক শিল্পপতি বন্ধু বলে বসলেন, ‘আমরা কষ্ট করে টাকা রোজগার করে সরকারি কোষাগারে ট্যাক্স জমা করি, আমাদের সন্তানরা বিদেশের মাটিতে দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করে দেশে পাঠায়, আর একশ্রেণির সরকারি আমলা বসে বসে বেতন গ্রহণের পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে সরকারি অর্থের শ্রাদ্ধ করেন, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে তারা তা বিদেশে পাচার করেন। আর সরকারও দুহাত খুলে বেতন-ভাতা প্রদান করাসহ তাদের এসব অপকর্মের খেসারত হিসাবে সরকারি ব্যয়ে নির্মিত বাড়িঘর, রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণে অকাতরে অর্থ বরাদ্দ করে প্রকারান্তরে তাদের অপকর্মকে সহায়তা করে।’
আমি যখন রাস্তাঘাটে চলি, তখন সরকারি অর্থ অপচয়ের প্রমাণ স্বচক্ষেই দেখতে পাই। আবার প্রায় ৬ মাস আগে আমার জেলায় কর্মরত একটি উপজেলার জনৈক কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন, তার উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের অর্ধেক টাকাই নাকি লোপাট করা হয়েছে।
বতর্মান অবস্থায় গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের বেহাল দশা দেখে, ছাগল দিয়ে জমি চাষ করার কথাটি বিশেষভাবে মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। আবার ছাগল গ্রেফতার মানসিকতার বিষয়টিও মনে এসে যাচ্ছে! কারণ, ছাগল গ্রেফতারের মানসিকতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের দিয়ে গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহ নির্মাণ করানোর কুফল এখন দেশ ও জাতির সামনে একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। আশা জাগানিয়া এমন একটি সরকারি প্রকল্পের বেহাল দশা দেখে ক্ষুব্ধচিত্তে আমারও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, আবার সরকারি অর্থ ব্যয় না করে ওইসব ঠিকাদার ইউএনওকে ধরা হোক, তাদের দিয়ে তাদের টাকায় নষ্ট হওয়া, ভেঙে পড়া ওইসব ঘরবাড়ি ঠিক করানো হোক।
কারণ আমি নিশ্চিত, গৃহহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পসংক্রান্ত বতর্মান অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র অপেক্ষা বাস্তব অবস্থা আরও ভয়ংকর। কারণ এসব ঘরবাড়িতে গৃহহীন দরিদ্র মানুষজন নিরাপদে বসবাস করতে পারবেন কিনা এবং আগামী পাঁচ বছরে এসব ঘরবাড়ির অস্তিত্ব থাকবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর সে ক্ষেত্রে এসব গৃহহীন মানুষকে আবার রাস্তায় নামতে হবে।
এ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের এ প্রকল্পটিকে দিয়ে যারা স্বার্থসিদ্ধি করেছেন, সেসব ঠিকাদার এবং সরকারি কর্মকর্তাকে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত নয়। সড়ক পরিবহণ এবং সেতুমন্ত্রী সরকারি খরচে এসব ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ করে দেওয়ার কথা না বলে ওইসব ঠিকাদারকে ধরে এনে তাদের দিয়ে কাজটি করিয়ে নিলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সরকারি অর্থ নয়-ছয় করা সরকারি আমলাদের থলের বিড়ালও বেরিয়ে আসত। কারণ কান টানলেই মাথা আসত।
বিভিন্ন উপজেলায় বসে নিজেদের যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করে যা খুশি তাই করছেন, নিজেরাই নিুমানের মালামাল ক্রয় করে জোড়াতালি দিয়ে গৃহহীন প্রকল্পের ঘরবাড়ি তৈরি করে দেশের দরিদ্র অসহায় মানুষের সঙ্গে তামাশা করেছেন, সেসব কর্মকর্তাকে জনতার সামনে আনা এখন সময়ের দাবি বলেই মনে করি। অন্যথায় এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব আছে বলেই মনে করা হবে। আর সেক্ষেত্রে, একশ্রেণির সরকারি আমলা, যারা নিজেরা নিজেদের সর্বেসর্বা মনে করছেন এবং তারাই দেশ চালাচ্ছেন মনে করে দুর্বল রাজনীতির সুযোগ নিয়ে যা খুশি তাই করছেন, ছাগল গ্রেফতার থেকে শুরু করে একজন জুয়েলারি ব্যবসায়ীকে স্যার না বলার অপরাধে শাস্তি দিয়ে অপমাণিত করছেন, অসহায় দরিদ্র গৃহহীন মানুষের ঘর নির্মাণের টাকা ঠিকাদারের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন, তাদের প্রতি নমনীয় হওয়া আর নতজানু হওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।
এ অবস্থায়, অনতিবিলম্বে এই শ্রেণির সরকারি আমলাসহ অপকর্মকারী ঠিকাদারদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি না করে, জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড ফরমুলা গ্রহণ করলে বতর্মান অবস্থায় রাজনৈতিক সরকার সবকিছু আমলাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে আছে মর্মে বাজারে প্রচলিত কথাটিই সত্যি বলে প্রমাণিত হবে।
এসব কথা আর দীর্ঘায়িত না করে এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেই লেখাটি শেষ করতে চাই।
আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রয়াত উপদেষ্টার মধ্যে এক সময় স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হলে একদিন আমি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে দেখা করি। সে সময়ে আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহ-সম্পাদক ছিলাম। তো, আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সুরঞ্জিত বাবুর প্রতি বাকযুদ্ধ থামানোর অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, ‘দেখ, আমি কিন্তু তার অনেক কিছুই জানি, তবুও এতদিন চুপচাপ ছিলাম।’
তার সঙ্গে আমি আর বেশি কথা না বাড়িয়ে যতটুকু অনুনয়-বিনয় করা প্রয়োজন তা করে চলে এলাম এবং তারপর ‘বুমেরাং’ শিরোনামে একটি কলাম লিখলাম। লেখাটি প্রকাশের পরদিন সেই উপদেষ্টা লোক দিয়ে ফোন করে আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং আমি গেলে আমি কোথায় থাকি, আমাকে খুঁজে পাওয়া যায় না ইত্যাদি বললেন। অতঃপর তিনি জানালেন, আমার লেখাটি তার কাছের একজন লোক তাকে দেখিয়েছেন। যাক সে কথা। যে কথাটি বলার জন্য প্রসঙ্গটি টেনে আনলাম, সে কথায় ফিরে আসি।
সেদিন আমি সেই উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে গেলে দুজন বিদেশি তার কক্ষে উপস্থিত থাকায় পিএ সাহেব আমাকে অপেক্ষা করতে বলায় আমি পাশের একজন কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে বসি। আর সেখানে আমাকে বেশ কিছু সময় বসে থাকতে হওয়ায় তার কক্ষে পূর্বেই বসে থাকা অন্য আরও একজন আমলার পরস্পর আলাপচারিতা শুনতে পাই।
সেদিন সেখানে দুজন আমলা সেই উপদেষ্টার সরকারি কাজকর্মের যেসব সমালোচনা করছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত আপত্তিকর। এমনকি আমাকে তারা না চিনলেও আমি কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছি তা জানা সত্ত্বেও সরকারের সমালোচনায় তারা ছিলেন বেপরোয়া। সেক্ষেত্রে তারা সরকারের এমপি-মন্ত্রী কাউকেই বাদ দিচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে আমি কিছু বলতে যাব এমন সময় আমার ডাক পড়ায় সেদিন কিছু বলতে না পারার আফসোসটা এখনো রয়ে গেছে এবং তার আগের এবং পরের অনেক দেখাশোনা ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে এরা সবাই সিজনাল বার্ড। আর এই শ্রেণির সিজনাল বার্ডরা সেয়ানা ঘুঘুর মতো ধান খেয়ে যেতে ওস্তাদ! যেমনটি এখনো ঘটে চলেছে। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে বসে থাকা সিজনাল বার্ড শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারা সরকারের ক্ষতি করে এক সময় ঠিক উড়ে যাবে আর সময়মতো রাজনৈতিক সরকারকে ঠিকই তার খেসারত দিতে হবে।
অতএব এই শ্রেণির সরকারি আমলা, যারা প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরবাড়ি নির্মাণের অর্থ পর্যন্ত অপচয় এবং লুটপাট করেছেন, উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে তাদের চরিত্র জনগণের সামনে উন্মোচিত করে জরুরি ভিত্তিতে বিচারের ব্যবস্থা করে শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর এ কাজটি করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হবে। অন্যথায় নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট