Logo
Logo
×

বাতায়ন

একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপরেখা

Icon

সাইফউদ্দিন মো. শোভন

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপরেখা

আধুনিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্র সামাজিক অগ্রগতির একমাত্র চাবিকাঠি। তাই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য গণতন্ত্রকেই বেছে নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান পৃথিবীতে পুঁজিবাদের জয়জয়কার।

পুঁজিবাদে রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকে, কিন্তু তা থাকে বুর্জোয়াদের জন্য। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থাকে না শোষিত-বঞ্চিতদের জন্য। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করা হয়, কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকে না।

এসব দিক ভেবে আমি কিছু প্রস্তাব তুলে ধরছি, যা একক কোনো মতবাদের ওপর ভিত্তি করে নয়। প্রস্তাবগুলো নেওয়া হয়েছে দেশের বাস্তব পরিস্থিতি ও সমস্যার কথা বিবেচনা করে, যা আধুনিক কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিহিত। পদক্ষেপগুলো সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত।

১. বাংলাদেশের সম্পদ সীমিত। জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে সে তুলনায় সম্পদ বাড়ছে না। তাই একটি সন্তানের বেশি নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে। ২. আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। তন্মধ্যে বর্গা প্রথার উচ্ছেদ অগ্রগণ্য। কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করতে হবে। ৩. প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে সরকারি খাস জমি বিনাশর্তে দিতে হবে।

৪. কৃষির উন্নতি মানেই জাতির উন্নতি। তাই সরকারি উদ্যোগে সমবায় খামার গড়ে তুলতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগেও সমবায় খামারের জন্য উৎসাহ দিতে হবে। ৫. আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় খাত থেকে ব্যয়ভার কমিয়ে শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে।

৬. প্রতিটি গ্রামে একটি করে (ন্যূনতম) প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। বিদ্যমান সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করতে হবে। ৭. মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হওয়ার পর যদি দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ না করাই ভালো, তাহলে তাকে কারিগরি শিক্ষায় উৎসাহিত করতে হবে। তাই প্রতিটি জেলায় কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

৮. মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে অপরাধপ্রবণতা কমে আসে এবং সচেতনভাবে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এতে যৌন হয়রানি কম হবে। ৯. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে ন্যূনতম ১ বছর সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে দেশের স্বার্থে যে কোনো যুদ্ধে জনগণ সরাসরি অংশ নিতে পারে। প্রশিক্ষণকালীন ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।

১০. সেশনজট দূর করে নিয়মিতভাবে কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়া শেষ করে গ্রামে ১ বছর কাজ করতে হবে। বিশেষ করে যারা উপরের স্তর পর্যন্ত পড়বে তাদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। যেহেতু শিক্ষা ফ্রি করা হবে, সেহেতু দেশের প্রতি প্রত্যেকের দায়িত্ব আছে। গ্রামে কাজ করার সময় প্রত্যেককে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের সার্বিক কল্যাণই এর প্রধান লক্ষ্য। বিশেষ করে নিরক্ষরকে অক্ষরজ্ঞান দানসহ গ্রামের উন্নতির জন্য যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাতে পারে।

১১. প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তির চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। তারপরও যদি শিক্ষিত বেকার থাকে, তাহলে তাদের ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি কেউ চাকরি না পায়, তাহলে সার্টিফিকেট জমা দিয়ে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ১২. প্রতিটি জেলায় ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করতে হবে। খেলাধুলার মানোন্নয়নে জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়দের জন্য সরকারি ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।

১৩. শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। বন্ধ কলকারখানা চালু করতে হবে। সম্ভাবনাময় শিল্প খাত সৃষ্টি করতে হবে। শিল্পক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকেও স্বাগত জানাতে হবে। ১৪. সরকারি মালিকানাধীন কিছু প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।

১৫. ঋণ নেওয়া বেসরকারি কারখানা কোনোমতেই বন্ধ করা চলবে না। যদি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সরকারের কাছে তা হস্তান্তর করতে হবে। ১৬. কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। ১৭. গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। ১৮. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

১৯. বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করতে হবে। ২০. কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলাদলি করতে দেওয়া যাবে না। ২১. সংসদ নির্বাচন দলভিত্তিক ভোটাভুটির মাধ্যমে হতে হবে। কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হবে না। যে দল বেশি ভোট পাবে সে দল জয়ী হবে। পরে দল তার সদস্যদের মনোনীত করবে। প্রয়োজনীয় স্থানে সংবিধানের সংশোধনী করে নিতে হবে। এতে করে কোনো ব্যক্তি প্রার্থী না হওয়ায় তার অর্থ খরচ হবে না। ফলে দুর্নীতি কমে আসবে। সারা দেশের মানুষ দলের প্রতীকে ভোট দেনেব। নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ি না থাকলে গণতন্ত্র আরও সুসংহত হবে। আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্য নির্বাচনের ফলে যোগ্য ব্যক্তির সংখ্যা বাড়বে। অনেক দেশেই এ রকম ব্যবস্থা চালু আছে। ২২. বেতার ও বিটিভিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। ২৩. যাতায়াত ব্যবস্থা সহজতর করার জন্য প্রয়োজনীয় সব স্থানে, বিশেষ করে নদীর উপর সেতু নির্মাণ করতে হবে।

২৪. ঢাকার যানজট নিরসনে প্রধান সড়কগুলোতে দ্বিতল রাস্তা তৈরি করতে হবে। দোতলা বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে চাহিদা অনুযায়ী। ২৫. রাজধানীতে মেট্রোরেলের পরিসর বাড়াতে হবে। পাতালরেলের সম্ভাব্যতা যাচাই করে তা নির্মাণের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।

২৬. অযথা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। যেসব সংস্থা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করবে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে পরে রাস্তা কাটতে হবে।

২৭. যেসব জেলায় জনসংখ্যা বেশি, সেসব জেলাকে বিভাগে উন্নীত করতে হবে। ২৮. রাজধানীর ওপর থেকে মানুষের চাপ কমাতে এ নগরীর আশপাশে উপশহর গড়ে তুলতে হবে। সেসব উপশহরে প্রচুর ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে হবে। নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে কম টাকায় ওইসব ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হবে। বিশেষ করে বস্তি উঠিয়ে দেওয়ার পর বস্তিবাসীদের আয়-সংগতি অনুযায়ী ওইসব ফ্ল্যাট বিলি করতে হবে।

২৯. সন্ত্রাস দমনে শুধু আইন করলেই হবে না, এর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। সন্ত্রাসী যাতে জামিন না পায় তার যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। ৩০. ভিক্ষুক পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। ভিক্ষাবৃত্তি চিরতরে বন্ধ করার জন্য ভিক্ষুকদের ওইসব কেন্দ্রে নিয়ে কুটির শিল্পসহ নানাবিধ কাজে লাগাতে হবে। প্রতিটি জেলায় এই কেন্দ্র চালু করতে হবে।

৩১. বাজারব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই অযৌক্তিক কারণে পণ্যমূল্য বাড়তে দেওয়া যাবে না। ৩২. ঘুস-দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এ জন্য উপযুক্ত শাস্তির বিধান করতে হবে। ৩৩. সব দেশের সহযোগিতা নেওয়া হবে। ঋণ বা সাহায্য যাই পাওয়া যাক না কেন, তা জনগণের কল্যাণে ব্যয় হতে হবে। ৩৪. প্রশাসনিক কাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় খাত চিহ্নিত করে সেখান থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রত্যাহার করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতে সেই অর্থ ব্যয় করতে হবে। ৩৫. সর্বক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনে নারীর সমান অধিকার থাকবে। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষক ও ফতোয়াবাজের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করতে হবে।

৩৬. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বুলেট নয়, ব্যালটই ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পদ্ধতি- এই নীতি সর্বদা প্রযোজ্য হবে। ৩৭. জনগণের মধ্যে তৃণমূল পর্যন্ত ক্ষমতার শেয়ার দিতে হবে। তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব বের করে নিয়ে আসতে হবে।

৩৮. আইন সবার জন্য সমান। দরিদ্রদের বিনা খরচে আইনি সহায়তা দিতে হবে। ৩৯. সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অবশ্যই এসএসসি পাশ হতে হবে। দেশের প্রধান যিনি হবেন- রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী- প্রত্যেককেই ন্যূনতম এসএসসি পাশ হতে হবে। ৪০. ব্যক্তিগত মালিকানায় কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকবে, তবে ১০০ কোটি টাকার বেশি হলে বাকি অর্থ বা সম্পদ সরকারের মালিকানার শেয়ার করতে হবে।

৪১. ঐতিহাসিক এলাকাগুলোকে পর্যটনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কক্সবাজার সি-বিচকে আন্তর্জাতিক মানের সি-বিচ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। সুন্দরবনকে ঢেলে সাজাতে হবে। কোনো বনখেকোকে দায়িত্ব দেওয়া চলবে না। ৪২. সংবিধানের মূলনীতি হবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিশ্ব মানবতার অর্থে আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং সমাজতন্ত্র। প্রয়োজনে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। ৪৩. সার্ককে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সেজন্য সার্কভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে নিরাপত্তার স্বার্থে এ উপমহাদেশে সার্ক নিরাপত্তা সংস্থা গঠন করতে হবে।

৪৪. হরতাল-অবরোধ নিষিদ্ধ করতে হবে আগামী ২০ বছরের জন্য। তবে ধর্মঘট, সমাবেশ ইত্যাদি করা যেতে পারে। ৪৫. শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। যেসব শিশু বাধ্য হয়ে শ্রম দেয় তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। বিশেষ করে পথশিশুদের লেখাপড়া নিশ্চিত করতে হবে। যেসব শিশুর থাকার জায়গা নেই, তাদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করতে হবে। বিনা খরচে থাকা ও পড়ালেখার নিশ্চয়তা দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে তা প্রতি জেলায় করতে হবে। ৪৬. গার্মেন্টস শ্রমিকদের থাকার জন্য আবাসিক হোস্টেলের ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করা যেতে পারে।

৪৭. বাংলা ভাষায় ধর্মচর্চার প্রচলন করতে হবে। এতে ধর্মচর্চার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে। ৪৮. কম্পিউটার শিল্পকে সাধারণের কাছে নিয়ে যেতে হবে। প্রতি জেলায় আইটি পার্ক স্থাপন করতে হবে, যেখান থেকে মেধাবী আইটি প্রফেশনাল তৈরি হবে। সফটওয়্যার রপ্তানিতে ব্যাপক সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। ৪৯. পল্লি রেশনিং চালু করতে হবে। ৫০. শস্যবিমা চালু করতে হবে।

সাইফউদ্দিন মো. শোভন : সাংবাদিক, সাবেক ছাত্রনেতা

shyfshovon@yahoo.com

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম