কৌতূহলী মানুষের লকডাউন দর্শন!
ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহ সংক্রমণ ঠেকাতে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে ১ জুলাই। জরুরি সেবাদানকারীরা ছাড়া সাধারণ মানুষ যেন অহেতুক ঘরের বাইরে যেতে না পারেন সে জন্য ২১টি শর্ত দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
শর্তগুলো গণমাধ্যমে বারবার প্রচার করা হচ্ছে। এ জন্য রাস্তায় নেমেছে সেনাবাহিনী, আনসার, পুলিশ। বড় রাস্তায় বিশেষ চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। প্রথম দিন টিভিতে দেখা গেল- গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারকে রাস্তায় বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করার সময় পাশে ঘিরে রয়েছে বহু কৌতূহলী মানুষ। জরিমানা বা শাস্তি দেওয়া হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য কৌতূহলী এসব মানুষ গাড়ির পাশেই হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছেন!
অজ্ঞ মানুষরা মনে করছে, পুলিশ গাড়ি আটকাচ্ছে- ব্যাপারটা বেশ মজার বা তামাশার। দ্বিতীয় দিন থেকে কৌতূহলী জনতাকে রাস্তায় বের না হতে মাইকিং করা হয়েছে। তারপরও নানা অজুহাতে অনেকে বের হয়েছেন।
তৃতীয় দিন থেকে তাদের বিনা কারণে রাস্তায় বের হওয়ার জন্য জরিমানা করা হচ্ছে। গণমাধ্যমের ভাষ্যমতে, অহেতুক ঘরের বাইরে বের হওয়া হাজারের অধিক উৎসুক জনতাকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। এগুলো বড় বড় রাস্তায় ঘটেছে।
শহরাঞ্চলের অলিগলিতে বাধা মানছে না মানুষ। ঘরের বাইরে বের হওয়ার জন্য নানা অজুহাত তাদের মধ্যে। গলির ভেতরে মানুষের ঘরের বাইরে বের হওয়া ঠেকানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা নেই। ঢাকায় রয়েছে অসংখ্য বাজার, অসংখ্য গলি। সেগুলোতে পুলিশের গাড়ি ঢুকতে দেখলে মানুষ হুড়মুড় করে দোকানের শাটার টেনে দিয়ে সট্কে পড়ে।
এই নির্বোধ জনতাকে ঠেকানোর জন্য এত পুলিশ কোথায়? অথবা তারা করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে এখনো সচেতন না হয়ে পুলিশের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলতে থাকলে কার দায় পড়েছে সারা দিন ওদের সঙ্গে খেলার!
কিছু মানুষ আছেন, যারা সবসময় নিয়ম-কানুন ভেঙে চলতে চান। উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বড়-ছোট নির্বিশেষে এ ধরনের ‘কিছু মানুষ’ সব জায়গায় লক্ষণীয়। আইন, বিধি, নৈতিকতা ইত্যাদি তাদের দমাতে পারে না। তারা নির্বোধ, স্বার্থপর অথবা ‘মব’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। সুযোগ পেলে তারা আইন নিজের হাতে তুলে নেন। নিজে অপরাধ করতে ভয় পান না; আবার অপরকে দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করিয়ে নিজে ফায়দা লুটে নেওয়ার তালে থাকেন। তারপর অপরাধের দ্বারা সংঘটিত ক্ষমতা ও কাজের মুনাফা ভাগাভাগি করে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
এ ধরনের কৃতকর্মের ফলে যে সমাজ ও জীবনধারা তৈরি হয়, তা এক ধরনের কপটতা ও দুর্নীতিকে উসকে দিয়ে মানুষকে স্বার্থপর ও অনৈতিক হওয়ার কুশিক্ষা দেয়। এরূপ অন্যায় দেখে বা শিখে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ বেশি হয়ে একটি অসম সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি হয়। এভাবে একটি মন্দ সামাজিক নীতির মধ্যে বসবাসরত মানুষের ভালো-মন্দের পার্থক্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
বলা বাহুল্য, আমাদের সমাজে টাকাওয়ালাকে বাহবা দেওয়া হয়, কিন্তু টাকা কীভাবে অর্জিত হলো বা কীভাবে সেই ব্যক্তি টাকাওয়ালা হলো, তা বহুলাংশে আড়ালে রাখা হয়। এতে দুর্নীতি বিস্তারের ফলে সমাজে আয় ও ক্ষমতা বৈষম্য দেখা দেয়। ক্রমাগত এ ধরনের বৈপরীত্য ও বঞ্চনা থেকে জনমনে ব্যাপক সামাজিক ঘৃণা সৃষ্টি হয়।
এ ধরনের অসম সামাজিক ব্যবস্থায় কোনো নির্দেশনা এক শ্রেণির মানুষ মানেন, অন্য শ্রেণির মানুষ সেটাকে অবহেলা করেন, অমান্য করেন এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও ভাঙন সৃষ্টি করেন। যেমনটা ঘটেছে আমাদের মতো চরম আর্থিক ও নৈতিকভাবে বৈষম্যমূলক সমাজে। নিম্ন আয়ের মানুষ কঠোর লকডাউন কী তা বোঝেন না। তারা দিন আনে দিন খায়।
সকাল হলেই তারা শুধু বোঝে তাদের ক্ষুধার আহার জোটানোর জন্য কোদাল-টুকরি নিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে শ্রম বিকানোর খোঁজে লাইনে দাঁড়াতে হবে। তাই মাটি কাটা শ্রমিকরা লকডাউনের দিনেও রাজধানীর রাস্তার মোড়ে কোদাল-টুকরি নিয়ে বলছেন- ‘বাইরে না বের হলে আমাদের খাবার দেবে কে?’ এভাবে সারা দেশের বড় রাস্তার মোড়ে কত শত শ্রমিক পেটের দায়ে লকডাউনেও কাজের জন্য অপেক্ষা করছেন কে জানে!
রাস্তায় রিকশা চলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে একই কারণে। কিন্তু অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট বন্ধ থাকায় ভদ্রলোকেরা ঘরের বাইরে বের হননি। তাই বিধিনিষেধের সময় নিম্ন শ্রেণির মানুষের শ্রমের খদ্দের নেই, কাজ নেই, উপার্জনও নেই। রাস্তায় তারা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পুলিশের আটকানো দেখছেন! ব্যক্তি-সামাজিক দূরত্ব না মেনে ঘেঁষাঘেঁষি করে গাড়িকে জরিমানা করা দেখে আনন্দ পাচ্ছেন। তাদের আর দোষ কী!
উন্নত দেশে চলমান ইউরো কাপ ফুটবলে অনেক দর্শক নাকি করোনা সংক্রমিত হয়েও মাঠে খেলা দেখছেন! তারা নাকি টিকাও নেননি! তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, করোনা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। এরা ফুটবল ফ্যান শুধু নয়- ভয়ংকর ‘মব’। পুলিশ ওদের সামলাতে হিমশিম খায়। তাই তাদের মাড়াতে যায় না। তারা সবাই উন্নত দেশের তথাকথিত শিক্ষিত-ভদ্র মানুষ!
আমাদের দেশে ১ জুলাই সকালে শহরের এক রেস্টুরেন্টে গাদাগাদি করে মানুষ খাবার খাচ্ছিল। কারণ জানতে গিয়ে জানা গেছে, দোকানের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে খদ্দেররা হুড়মুড় করে ঢুকে সব আসনে বসে পড়েছেন। মালিকের লোকজন মার খাওয়ার ভয়ে তাদের সামলাতে পারেনি। তারা সবাই ভদ্রগোছের মানুষ।
একদিকে শিক্ষিত মানুষদের অবহেলা ও উদাসীনতা, অন্যদিকে নানা বৈষম্যপীড়িত অসংখ্য অজ্ঞ, নিম্ন আয়ের মানুষের পেটের দায়- সবকিছুর কাছে যেন করোনা সংক্রমণ ঘটার ক্ষেত্র খুবই উর্বর ও সহজ।
সেই সুযোগ নিয়ে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন আরও আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। জাতীয় সংসদে নিম্ন আয়ের মানুষকে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কথা উঠেছে; কিন্তু সেই খাবার দরিদ্র শ্রমিকরা কখন, কোথায়, কীভাবে পাবেন বা আদৌ পাবেন কিনা সে তথ্য তাদের জানা নেই। বিধিনিষেধের প্রথম দিন একজন ভিক্ষুক সকালবেলাতেই আমাদের আবাসিক এলাকায় ঢুকে বারবার কলিংবেল টিপছিলেন।
কীভাবে তিনি ঢুকলেন জানতে চাইলে জানালেন, আজ কঠোর লকডাউন তিনি জানেন না। দারোয়ান দয়া করে তাকে ঢুকতে দিয়েছে। ১০ টাকা দেওয়ার পর সে সরাসরি বলল, স্যার চাল কিনতে হবে আমাকে, ১০০ টাকা দেন। পরদিন শুক্রবারের অবস্থা ছিল আগের মতোই বেগতিক। সংক্রমণের এ ভয়াবহ সময়ে সরাসরি ভিক্ষাদান করাটাই যেন খুব কঠিন কাজ।
গ্রামে গত বছর কেউ করোনাকে পাত্তা দেননি। এখন গ্রামের সহজ-সরল মানুষের ঘরে ঘরে সর্দি-জ্বরের কথা জানা যাচ্ছে। বেশি আক্রান্তরা হন্যে হয়ে ছুটছেন হাসপাতালে। অনেকের চিকিৎসার টাকা নেই। বিকাশে টাকা পাঠানোর জন্য অনুরোধ করছেন। এর মধ্যে জানা গেল, তারা জীবিকার তাগিদে সাইকেল, মোটরসাইকেল, অটোরিকশায় চেপে হাটে-বাজারে যাচ্ছেন। অনেকের মুখে মাস্ক নেই। গ্রামে স্বাস্থ্যবিধি উধাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো তদারকিতে নেই বা মানুষকে বাইরে যেতে নিষেধ করছে না।
কঠোর লকডাউনে পোশাক কারখানা খোলা। রিকশা ও খাবারের দোকান খোলা, কাঁচাবাজার খোলা। এর সবকিছুর সঙ্গে নিম্ন শ্রেণির মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। এদের অনেকের আইডি কার্ড নেই। মাস্ক কেনার অর্থ নেই। হতদরিদ্র মানুষদের জন্য খাবার সরবরাহের কথা বলা হলেও তা কীভাবে দেওয়া হবে সেটা বোধগম্য নয়। তাদের জন্য তিন-চার কোটি মাস্ক বিতরণ করার কথা বলা হচ্ছে। সেটা সংগ্রহ ও বণ্টনের ব্যবস্থাপনার কথা কেউ কোথাও ভালোভাবে বলছেন না।
শহরের অলিগলি ছাড়াও গ্রামে-গঞ্জে, বস্তিতে করোনা সংক্রমণের গতি কমানোর জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পাশাপাশি নজরদারি বাড়ানো উচিত। এ সময় হাট-বাজারগুলো হলো করোনা ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম।
সামনে কুরবানির গরুর হাটে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত। তা না হলে সারা দেশের গ্রামগুলো কোনো কারণে ভারতের গ্রামাঞ্চলের মতো মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে থাকলে এর ঢেউ কোনো শহরকেও রক্ষা করবে না। তখন রাজপথে টহলদার কর্তৃক বিধিনিষেধ ভঙ্গকারীদের জরিমানা করা দেখে মজা পাওয়ার মতো কোনো কৌতূহলী মানুষ আর ঘরের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ নাও পেতে পারেন।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান
fakrul@ru.ac.bd