ক্ষমতাচর্চায় রাজনীতিক বনাম আমলা
এম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকারের আমলানির্ভরতা নিয়ে হঠাৎ জাতীয় সংসদে শোরগোল উঠেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের পার্টনার জাতীয় পার্টির সিনিয়র সদস্যরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমলারা দেশে দুর্নীতি করে কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি করছেন। রাজনীতিবিদরা এখন তৃতীয় সারিতে। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, জাতীয় পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ ও রুস্তম আলী ফরাজী বেশ ঝাঁজাল কণ্ঠেই সরকারের আমলা তোষণের সমালোচনা করেছেন। এ সময় সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন।
করোনা মহামারি মোকাবিলায় গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অফিস আদেশ জারি করে ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরও আগে ২০২০ সালের মে মাসে করোনাকালীন ত্রাণ বিতরণ ও মহামারি মোকাবিলায় ৬৪ জেলায় দায়িত্ব দেওয়া হয় সিনিয়র সচিব, সচিব ও সচিব মর্যাদার কর্মকর্তাদের। আওয়ামী লীগ ও জাপা নেতাদের ক্ষোভের জায়গাটা এখানেই। তোফায়েল আহমেদ সরকারের আমলানির্ভরতা নিয়ে সমালোচনার সূত্রপাত করার পর তার সঙ্গে সুর মেলান কাজী ফিরোজ ও রুস্তম আলী ফরাজী। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সচিবের ওপর। এটা খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, যারা রাজনীতিবিদ, যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাদের জন্য নির্ধারিত যে স্থান আছে, সেখানে তাদের থাকা উচিত। এক সময় জেলার দায়িত্ব যে মন্ত্রীরা পালন করতেন সেটা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।
কাজী ফিরোজ রশীদ উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা পাশে বসে থাকেন, দূরে। তারপর বলেন- ডিসি সাহেব, আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা। দেশে কোনো রাজনীতি নেই। তাই আওয়ামী লীগের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। এখন রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলাদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। জগৎশেঠরা দেশ চালাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন ফিরোজ রশীদ।
বর্তমান সংসদে কী হলো, কে কী বললেন তা নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। গণমাধ্যমেও আগের মতো সংসদের খবর গুরুত্ব পায় না। সম্ভবত সে কারণেই মাঝেমধ্যে কৃত্রিম উত্তাপ ছড়িয়ে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের প্রয়াস দেখা যায়। মিডিয়া কভারেজও ভালো হয়। তোফায়েল আহমেদ ও কাজী ফিরোজরা আমলাতন্ত্রের দাপট নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলেন তখন তারা ভুলে যান যে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট ব্যয় বরাদ্দের এক-চতুর্থ ভাগের বেশি (২৬ দশমিক ৮ শতাংশ) রাখা হয়েছে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত পাবলিক সার্ভেন্টদের বেতন-ভাতা ও পেনশনের জন্য। গত এক দশকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ২২১ শতাংশ। আমলারা যেভাবে চেয়েছেন, বিনা প্রশ্নে সেভাবেই বাড়াতে হয়েছে।
সরকারের আমলানির্ভরতার সমালোচনা নতুন নয়। এর আগেও শাসক দলের নেতারা এ নিয়ে কমবেশি সরব হয়েছেন বিভিন্ন ফোরামে। এমনও মন্তব্য এসেছে যে, ‘মাঠে খেলছেন আমলারা। রাজনীতিবিদরা সাইডলাইনে বসে খেলা দেখছেন।’ প্রশ্ন হলো, রাজনীতিবিদরা কেন রাজনীতিতে নেই? আমলারা কেন তা দখল করছেন? বলা হচ্ছে- সংবিধান অনুযায়ী দেশের মালিক হচ্ছেন জনগণ আর তাদের ভোটে নির্বাচিতদেরই দেশ পরিচালনার কথা। কিন্তু কাজকর্মে এমপি সাহেবদের খবর নেই, আর সচিব সাহেবরা সব কাজ করেন, মন্ত্রী মহোদয়েরা শুধু অবহিত হন। আসল প্রশ্নটা কিন্তু এখানেই। বর্তমান সংসদের এমপি বা সরকারের মন্ত্রীদের কি সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্ব করার ম্যান্ডেট আছে? এ প্রশ্নের উত্তর জনগণ যতটা জানে, তার চেয়ে ঢের বেশি জানেন আমলারা।
কে না জানে, এখন প্রশাসনের সচিব বা পদস্থ কর্মকর্তারা অবসরের পরই রাজনীতিতে যোগ দিয়ে এমপি, মন্ত্রী হতে চান। আর কাজটি শুরু করেন সরকারি চাকরিতে থাকার সময়ই। তারা সরকারি চাকরিতে থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। নিজ নিজ সম্ভাব্য নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে মনযোগী হচ্ছেন। সভা-সমাবেশে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। যিনি যত বেপরোয়া, তত দ্রুত তরক্কি পাচ্ছেন। কোনো রাখঢাকের বালাই নেই।
তারা এমনটা কেন করতে পারছেন? সরকারি চাকরিতে থাকতেই তাদের কেন রাজনৈতিক আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে? এর উত্তর সোজা। দায় রাজনীতিকদেরই। ক্ষমতার প্রয়োজনেই আমলাদের তুষ্ট ও তোষণ করতে হচ্ছে। ফলে আমলাদের প্রভাব এখন অনেক বেশি বেড়ে গেছে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে রাজনীতিকদের দক্ষতার অভাবেও এটা হয়েছে। রাজনীতি করবেন রাজনীতিকরা। কিন্তু এখন তা করছেন আমলারা। তারা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন ও তৎপরতা চালান। এর জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হয় না।
সরকারের আমলাপ্রীতি নিয়ে বেশকিছু উদাহরণ টানা যায়। অনেক এমপি-মন্ত্রী মাঠ পর্যায়ের আমলাদের দ্বারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। কোনো প্রতিকার চেয়ে পাননি শীর্ষ মহলে। বরং আমলাদের সমীহ করে, ম্যানেজ করে চলার পরামর্শ পেয়েছেন রাজনীতিকরা। কতিপয় আমলার দুর্বিনীতি আচরণের আরেকটি কারণ বর্তমান সরকারের আমলে পাশ হওয়া একটি আইন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করে আইন পাশ করা হয়েছে। কোনো কারণে সংক্ষুব্ধ হলে দেশে যে কারও বিরুদ্ধেই যখন-তখন মামলা করা যাবে, কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে করা যাবে না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এর ফলে একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এখন রীতিমতো ধরাকে সরা জ্ঞান করেন।
ব্যুরোক্রেসির অপর নাম সিভিল সার্ভিস। আমলাদের পাবলিক সার্ভেন্ট বা জনগণের চাকরও বলা হয়। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েবার সর্বপ্রথম আমলাতন্ত্রকে একটি আইনগত ও যুক্তিসঙ্গত মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেন। আমলাতন্ত্র সম্পর্কে অনেক মজার মজার জোকস ও গল্প প্রচলিত আছে। আমরা কথায় কথায় আমলাদের জনগণের সেবক হিসাবে অভিহিত করে তাদের কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করি। কিন্তু সেই চল্লিশের দশকে যাযাবর তার ‘দৃষ্টিপাত’ শীর্ষক রম্য পুস্তকে লিখেছেন, ‘দে আর নিদার সিভিল নর সার্ভেন্ট’; অর্থাৎ তারা সুশীলও নয়, সেবকও নয়। অনেক আগে ডাকসাইটে আমলা আতাউর রহমান তার রম্য লেখায় লিখেছেন- এক ছেলে তার পিতৃপরিচয় দিতে গিয়ে বলে ফেলেছিল, ‘হি ইজ এ সিভিল সারপেন্ট’, অর্থাৎ তিনি ‘একজন ভদ্র সাপ’। ছেলেটি ভুল উচ্চারণে সাপ বললেও আমাদের রাজনীতিকরা যে এখন আমলাদের পথের কাঁটা ও অভিশাপ হিসাবে দেখছেন তারই ধ্বনি পাওয়া গেছে সংসদে। ক’দিন আগে (৮ জুন) সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী ও সাবেক আমলা এমএ মান্নান অবশ্য আমলাদের অসীম গুরুত্বের কথা জানান দিয়ে বলেছেন, আমলাতন্ত্র ভালো এবং এর বিকল্প সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, এমনকি ফেরাউন ও খলিফারাও বের করতে পারেননি। তার এ মন্তব্যেরও সমালোচনা করেছেন প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেছেন, এসব কথা জনগণ পছন্দ করে না।
আমলাতন্ত্র নিয়ে লিখতে গেলেও এখন দশবার ভাবতে হয়। তাই আমলা-চরিত্র বিশ্লেষণের ঝুঁকি না নিয়ে বরং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী তুখোড় রাজনীতিক ও আইনবিদ আতাউর রহমান খানের দ্বারস্থ হতে চাই। তিনি ‘ওজারতির দুই বছর’ নামে একটি সাড়া জাগানো বই লিখেছেন। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক আইয়ুব খানের সময়ে স্মৃতিচারণমূলক বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তিনি ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের শাসন-শোষণ এবং আমলাদের নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের সঙ্গে এর কতটুকু মিল বা অমিল তা পাঠকরা মূল্যায়ন করবেন।
আতাউর রহমান খান তার বইয়ের কুড়িতম অধ্যায়ে লিখেছেন- ‘আমলাতন্ত্রের ইতিহাস সকরুণ। তিক্ত, বিষাদময়। মাঝে মাঝে বেশ গ্লানিজনক। ... ব্রিটিশ চলে গেছে, কিন্তু তার প্রবর্তিত আমলাতন্ত্র ভূত হয়ে আছে এদের ঘাড়ের ওপর। আমলাতন্ত্রের ঘাঁটি সেক্রেটারিয়েট। এখান থেকে বোতাম টিপলেই শাসনযন্ত্র চালু হয়। অবশ্য শাখা দপ্তরও আছে। বেচারারা ওখান থেকেই কেন্দ্রের অনুকরণ করার চেষ্টা করে।’ তিনি আরও লিখেছেন- ‘আমলাতন্ত্রের জীবন আত্মকেন্দ্রিক। জীবনদর্শন অত্যন্ত সংকীর্ণ। দৃষ্টি অপরিচ্ছন্ন। নিজেদের মান-মর্যাদা সম্বন্ধে ভয়ংকর সচেতন। কিসে মানের হানি হলো, মর্যাদা কমে গেল, সেদিকে দৃষ্টি অতিশয় প্রখর। তোমরা ঠিকমতো কাজ করতে পার না, যোগ্যতা নাই- এ কথা বললে রাগে ফুলে যায়। কী, এতবড় বেইজ্জতি?’ আতাউর রহমান খানের ভাষায়- ‘রাজনীতিকের দেশপ্রেম আর সরকারি কর্মচারীর দেশপ্রেমের সংজ্ঞায় পার্থক্য আছে অনেকখানি। যে কর্মচারী কর্তব্যে শিথিল, তার দেশপ্রেম কতটুকু হতে পারে। দেশকে ভালোবাসা মানেই তো দেশের সার্বিক কল্যাণ বিধানে সাহায্য করা। আমলাতন্ত্রের চিন্তাধারা অস্বচ্ছ। কোনো গভীর ব্যাপারে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে তারা পারে না। অথচ বিশেষজ্ঞ বলে দম্ভ আছে।’
আমলাতন্ত্রের ইতিহাস টেনে আতাউর রহমান খান তার বইতে লিখেছেন- ‘ব্রিটিশ শাসনের আমলে দেশ শাসনের জন্য কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মচারী প্রধানত বিদেশি শাসকের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ আরম্ভ করেছিলেন, কালক্রমে তারাই আমলাতন্ত্রের ভিত্তিপত্তন করেন। এরা ছিলেন সেক্রেটারি অব স্টেটের এজেন্ট। আমলাতন্ত্র আজব বস্তু। উপরের স্তরে সিভিলিয়ান-ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস, ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস ইত্যাকার বড় বড় হোমরাচোমরা, নিচের দিকে নেমে কেরানি পর্যন্ত। এ বিরাট প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিভেদ ছিল। এরা বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী। নিুবর্ণের সঙ্গে উচ্চবর্ণের জলচল, এমনকি ওঠাবসাও নেই। বড় ছোটকে ঘৃণা বা করুণার চোখে দেখে। সমানে সমানেও দ্বন্দ্ববিরোধ। অভ্যন্তরীণ বিরোধ সত্ত্বেও গোটা শ্রেণি একটা বিশেষ মনোবৃত্তি সম্পন্ন। সমাজে বাস করেও সাধারণ মনুষ্য-সমাজের বাইরে।’
আতাউর রহমান খানের দৃষ্টিতে ‘আমলাতন্ত্রের জীবন একমুখী। একগুঁয়েমি স্বভাবের জন্য অনেক কাজের ক্ষতি হয়। দেশের উন্নয়ন কাজে সাধারণত আমলাতন্ত্র পক্ষপাতী নন। উন্নয়ন মানেই কাজ বৃদ্ধি। তাহলেই খাটুনি বাড়ে। দৃষ্টি অতি সংকীর্ণ। নাকের ডগার বাইরেই দিকচক্রবাল। তার বাইরে অন্ধকার। আমলাতন্ত্র রক্ষণশীল। প্রাচীনকে আঁকড়ে ধরে তার রসাস্বাদন করে এরা আনন্দ পায়। নতুন কিছু প্রস্তাব করলেই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।’
তিনি লিখেছেন, ‘একটা ব্যাপারে আমলাতন্ত্র খুব নিপুণ। রুল দিয়ে দেশকে রুল করা। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের গোলামি যুগের কতকগুলো জরাজীর্ণ নিয়মাবলির বস্তা এখনো কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। ... এ রুলই নাকি আসল বস্তু। আর বাকি সব জড়পদার্থ। ... কোনো কাজ করতে গেলে করার চেয়ে না করার পক্ষে যত নিয়ম, উপনিয়ম, ধারা, উপধারা, প্রকরণ সব মুখস্থ। উদ্বৃত করে দেবে আমলাতন্ত্র। এক পা এগোবার উপায় নেই।’
এম আবদুল্লাহ : সাংবাদিক; সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন