
‘আজ আমার একটু তাড়া রয়েছে, কিছুটা আগে আমি বেরিয়ে যাব’-এমন বক্তব্য অফিস বা কর্মক্ষেত্রে চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কখনো উপরের সাহেবকে বলে বের হওয়া; আবার কখনোবা না বলেই একফাঁকে বেরিয়ে যাওয়া। দেশ-কাল ভেদে সরকারি কর্মীদের এটাই গড়পড়তা কর্মসংস্কৃতি। তবে এবার তাদের এ সংস্কৃতি রুখতে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে জাপান সরকার।
হাজিরার বায়োমেট্রিক মেশিনে দু’মিনিট আগে আঙ্গুল ছোঁয়ালেই বেতনে কোপ। হাজিরার শেষে যেমন এই নতুন ব্যবস্থা, হাজিরার শুরুতেও তেমনি। কাজ হয়ে যাওয়ায় কেউ অফিস থেকে দুই মিনিট আগে বেরিয়ে গিয়েছিলেন; সেই অপরাধে বেতন কেটে রেখে দেওয়া হলো।
জাপানের ফুনাবাশি সিটির ‘বোর্ড অব এডুকেশন’ অফিসের বহু কর্মী এভাবেই শাস্তি পেয়েছেন। কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালের মে থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আগে বেরোনোর ৩১৬ ঘণ্টা শনাক্ত করেছে এবং যথাযথভাবে শাস্তির ব্যবস্থাও করেছে। শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মীদের মধ্যে ছিলেন ৫৯ বছরের এক মহিলা। অন্যরাও যাতে কাজ শেষ করে একটু আগে বেরুতে পারে, তাতে সাহায্য করেছিলেন তিনি। তিনি অফিসের হাজিরা খাতার দায়িত্বে ছিলেন। আগামী তিন মাস তার বেতনের ১০ শতাংশ কেটে নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। ওই মহিলার লগ আউট করার সময় বিকাল ৫টা ১৫ মিনিট।
কিন্তু ৫টা ১৭ মিনিটে তার বাড়ি ফেরার বাস ধরার সময়। ঠিক দুই মিনিট আগে তিনি অফিস ছেড়েছিলেন। তিনি সাহায্য করেছিলেন জাপানের চাইবা প্রিফেকচারের সরকারি দপ্তরের অন্য কর্মচারীদেরও। বেশ কিছুদিন ধরেই তারা আগে অফিস ছাড়ার কর্মসংস্কৃতি পালন করে আসছিলেন। ছুটির ঘণ্টা বাজার আগেই কর্মীরা চেয়ার ছেড়ে পালাতেন। তাদের বিরুদ্ধে এবার ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। কড়া নির্দেশ জারি করা হয়েছে-ছুটির নির্ধারিত দুই মিনিট আগেও যদি কেউ বায়োমেট্রিকে পাঞ্চ করেন, তাহলে তার বেতন কেটে নেওয়া হবে।
কর্তৃপক্ষের এ কড়া নির্দেশ প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীরা এ ব্যাপারে একটি সাফাই দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য-দপ্তর থেকে বেরোনোর নির্ধারিত সময় বিকাল ৫টা ১৫ মিনিট। আর তারা অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মাত্র দুই মিনিট আগে। অর্থাৎ ৫টা ১৩ মিনিটে। কারণ অফিসের কাছ থেকেই ৫টা ১৭ মিনিট নাগাদ একটি বাস ছাড়ে। অফিস থেকে বেরিয়ে হাতে ৪ মিনিট সময় থাকলে সেই বাস ধরার সুযোগ থাকে।
কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বের হলে বাসটি আর ধরা যায় না। পরের বাসের সময় ৫টা ৪৭ মিনিট। অর্থাৎ প্রায় আধা ঘণ্টা তাদের অপেক্ষা করতে হয়। তাই বাড়ি ফেরার তাড়ায় মাত্র দুই মিনিট আগে তারা বেরিয়ে পড়তেন। কিন্তু কর্মচারীদের এ সাফাইয়ে মন গলেনি কর্তৃপক্ষের।
জাপান বরাবরই সময়ানুবর্তিতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। জাপানে এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, নির্ধারিত সময়ের কয়েক সেকেন্ড আগে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ায় সরকারি বিবৃতি প্রকাশ করে যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। ২০১৮ সালে কোবে শহরের ওয়াটার ওয়ার্কস ব্যুরোর এক ৬৪ বছর বয়সি কর্মীকে জরিমানা করা হয়েছিল। কারণ, নির্দিষ্ট সময়ের ৩ মিনিট আগে তিনি লাঞ্চ করা শুরু করেছিলেন।
জাপান পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র। তবে আজকের জাপান ঠিক এমনটা ছিল না কয়েক বছর আগেও। ২০১৩ সালে জাপানে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৬ শতাংশ। ২০২০ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশে। জাপানের প্রত্যেক নাগরিকের গড় সম্পদ ১ লাখ ১০ হাজার ৪০৮ মার্কিন ডলার, যা আমেরিকার নাগরিকের গড় সম্পদের থেকে প্রায় ৪৪ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার বেশি। জাপানের জিডিপি ৪৮ হাজার ৩৩২ মার্কিন ডলার।
জাপানিদের গড় বেতন বার্ষিক ২৮ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ মাসিক গড় বেতন ২ হাজার ৩৫২ মার্কিন ডলার। জাপানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য শিক্ষা, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য খাতে। দেশটির একশ ভাগ মানুষই শিক্ষিত। জাপানে স্বাস্থ্য খাতের পয়েন্ট ৯৩ দশমিক ৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান অর্থনীতির ভিত শক্ত করার কাজে হাত দেয় এবং প্রযুক্তিতে স্থায়ী অবস্থান নিশ্চিত করে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ঢাকায় জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে দশ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন পর্বে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়াশিহিদে সুগা বলেছেন, দুই দেশের পতাকার নকশায় সামঞ্জস্য আছে এবং দুদেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান।
জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের বয়স ৪৯ বছর। বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপান বরাবরই সহায়তার হাত নিয়ে পাশে থেকেছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাংলাদেশে বিনিয়োগে জাপানের ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করেছে। বস্তুত বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের অনেক বিষয়েই মিল আছে।
বাংলাদেশে কয়েকজন জাপানি মহিলা বসবাস করেন, যারা বাংলাদেশি স্বামীর সঙ্গে ঘর করছেন। অপরদিকে, জাপানেও স্বল্পসংখ্যক বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে একটি অংশ আবার জাপানি মেয়ে বিয়ে করে জাপানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুবিধা লাভ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে এমন কিছু জাপানি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছে আমার। কয়েকজন জাপানি মেয়েকে বাংলার বধূ হিসাবে দেখারও সুযোগ হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই একটি বিষয় লক্ষ করা গেছে- এসব জাপানি অত্যন্ত ঘরোয়া ও পারিবারিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
অমিলও আছে অনেক। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো সময়ানুবর্তিতা ও দায়িত্ববোধ। জাপানিরা দু’মিনিট আগে সরকারি অফিস ছাড়লে বেতন কেটে নেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেদেশের সরকার। আর বাংলাদেশ? কখন অফিসে এলেন আর কখন অফিস ত্যাগ করলেন, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায় সরকারি অফিসগুলোতে? মিলের জায়গাটি তৈরি করতে হবে এক্ষেত্রেও। তবেই জাপানের সঙ্গে তুলনা করার জায়গাটি তৈরি হতে পারে। উন্নয়ন হচ্ছে বাংলাদেশে। সেই উন্নয়ন হয়তো আমাদের সহায়তাও করবে সামনের দিকে ধাবমান হতে। কিন্তু জাপানের মতো হতে হলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
সময়ানুবর্তিতা, সততা, কর্মদক্ষতা, শিক্ষা-এসব ক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি ঘটাতে হবে। কোভিড এসে ধাক্কা দিয়ে অনেক দেশের মতো বাংলাদেশকেও বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কতটা দুর্বল। এই সেদিন জানলাম এক ভদ্রমহিলার কথা। শরীর বেশি খারাপ হলে ত্মীয়রা পরপর পাঁচটি হাসপাতালে ছুটে বেড়িয়েছেন। কিন্তু ভর্তি করেনি কোনো হাসপাতালই। করোনার টেস্ট নেই বলে নাকি ভর্তি করা যাবে না! কিন্তু করোনার টেস্টটি কোনো হাসপাতালই করে দেখাল না। শেষে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে অতিরিক্ত খরচের বোঝা নিতে বাধ্য হলো ত্মীয়স্বজনরা।
ভর্তির পর অবস্থা সংকটাপন্ন হলেও আইসিইউর সুবিধা তার মিলল না। আইসিইউতে স্থান খালি নেই। মহিলা দু’দিন পরই মৃত্যুবরণ করলেন। মৃত্যুর সময় হয়তো তিনি একটি প্রশ্ন রেখে গেলেন। কিন্তু কে মনোযোগ দিয়ে শুনবেন সেই প্রশ্নটি?
বাংলাদেশকে জাপান হতে হবে না। তা হয়তো সম্ভবও নয়। তবে জাপানের দেখানো পথে হাঁটতে পারে বাংলাদেশ। জাপানের মতো উন্নত এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ হতে হলে বাংলাদেশকে হাঁটতে হবে অনেকটা পথ। আর এজন্য সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে দায়িত্ব আর সময়ানুবর্তিতার সঠিক ব্যবহার। নিশ্চিত করতে হবে, কেউ অফিসে দেরিতে এলে এবং সময়ের আগেই অফিস ত্যাগ করলে তার বেতন কাটা যাবে। তাহলেই একদিন বলার দিন আসবে-আমরাও পারি।
মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক
ceo@ilcb.net