Logo
Logo
×

বাতায়ন

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কি আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে?

Icon

অমিত রায় চৌধুরী

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কি আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে?

ফাইল ছবি

সম্ভবত সেদিন পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোট চলছিল। একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের খাস কামরায় বসেছিলাম। কক্ষে উপবিষ্ট একজন গৃহবধূ জি-২৪ ঘণ্টা চ্যানেল দেখতে চাইলেন। উদ্দেশ্য উত্তেজনাপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের দৃশ্য উপভোগ। জেনেছিলাম সহজ-সরল গাঁয়ের বধূটি একজন জনপ্রতিনিধি। নির্দোষ কৌতূহলে ভর করে তার পাশে বসে থাকা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করলেন- ভারতে কি এ দুটো দলই আছে? তিনি বলে চললেন- জানেন ভাবি, ওখানকার নির্বাচনের একটা ইভেন্টও আমি মিস করি না। ভীষণ ভালো লাগে। একদম সিনেমার মতো মারপিট। লাঠি, বাঁশ, দা, বোমা- আরও কত কী! ওই দেখেন, বলেছিলাম না? তারা নিচুস্বরে কথা বলছিলেন। আর আমি ভাবছিলাম- গণতন্ত্রের পদ্ধতিগত গম্ভীর অনুশীলন আজ কোন চেহারা নিয়েছে! পরিণত গণতন্ত্রের জন্য এর চেয়ে কদর্য বিজ্ঞাপন আর কী হতে পারে!

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন গণতন্ত্রের ধারণাকে কতটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারল- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। এখানে কি সত্যিই কোনো শিক্ষণীয় উপাদান আছে? এ নির্বাচনকে আদর্শ হিসাবে কতটা গ্রহণ করা যেতে পারে? এদেশে কি আমরা এমন নির্বাচন দেখতে চাই? ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তি, গভীরতা কিংবা সৌন্দর্য নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। হয়তো পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্য প্রদেশগুলোতে তা কিছুটা সত্যিও বটে। সবচেয়ে বড় কথা- গণতন্ত্রের দীর্ঘ পরিক্রমায় সেখানে সামরিক শক্তি কিংবা স্বেচ্ছাচারি শাসনব্যবস্থা কখনোই জায়গা পায়নি। তবে পশ্চিমবঙ্গ সেখানে অবশ্যই ব্যতিক্রম। জলবায়ু, প্রকৃতি, জীবনশৈলী এমনকি মানসগঠনেও হয়তো দুই বাংলায় এক ধরনের সাযুজ্য আছে। বিগত ৫০ বছর আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন সংস্কৃতি লক্ষ করি, তা বাম কিংবা তৃণমূল শাসনামল যাই হোক না কেন- সবক্ষেত্রেই অভিন্ন চরিত্রের প্রমাণ মেলে।

এবারের নির্বাচনকে যদি আলোচনার স্বার্থে আমরা মডেল হিসাবে ধরে নিই- দেখব প্রথম থেকেই শাসক বাদে অন্য কোনো দলকেই নির্বাচনী পরিবেশ সন্তুষ্ট করতে পারেনি। হয়তো পঞ্চায়েত কিংবা পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতা তাদের স্বস্তি দেয়নি। তামিলনাড়ু, কেরল, অসম, এমনকি উত্তর ভারতের বিভিন্ন হিংসাপ্রবণ রাজ্যগুলোতেও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। অনেক রাজ্যে একদিনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও কোনো অভিযোগ ওঠেনি বললেই চলে। অথচ ৮ দফায় পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সহিংসতায় প্রায় ২০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, শতশত আহত, কারচুপি-রিগিং-এর অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, ভোটকেন্দ্রে গুলি, রক্ত, মৃত্যু, বাড়ি বাড়ি ভয় দেখানো, অবৈধ অর্থের ব্যবহার- অপরাধের সব অনুষঙ্গই এখানে উপস্থিত। অন্তত একথা হয়তো বলা যায়- বাংলাদেশে আমরা সচরাচর এমন দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত নই।

আমরা এদেশে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার চাচ্ছি, রাষ্ট্রের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে কীভাবে আরও মজবুত ও বিশ্বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা যায়- সে প্রশ্ন অবশ্যই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। আর এ প্রসঙ্গে ভারতের উদাহরণ আমরা সবসময় দিয়ে থাকি। এটা ঠিক- ভারতের গণতন্ত্র বিশ্বে দেশটিকে মর্যাদা দিয়েছে। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশও সহজ হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কি আমাদের তেমন কোনো উচ্চমানের সন্ধান দিতে পেরেছে? উত্তর হবে- মোটেই নয়। প্রায় সব দলই সাম্প্রদায়িকতাকে কার্ড হিসাবে ব্যবহার করেছে। অর্থ, পেশি ব্যবহৃত হয়েছে নির্বিচারে। সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বাস্তবায়নের সংকল্পের পরিবর্তে সস্তা জনতুষ্টিকরণ বা চমক দেওয়ার প্রবণতা নির্বাচনি ইশতেহারকে দখল করেছে। শাসকদল ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে মরিয়া। বিরোধীদলগুলোকেও মনে হয়েছে ক্ষমতায় আসতে বেপরোয়া।

দলবদল রাজনীতির আর একটা কুৎসিত প্রবণতাকে প্রকট করে তুলেছে। নৈতিক মূল্যবোধ সেখানে এতই ঠুনকো যে, রাজনীতির মতো মহান ব্রত সেখানে অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছে। দলগুলোকে যথেষ্ট শঙ্কায় থাকতে দেখা গেছে, পাছে সহকর্মীরা দলছুট হয়ে প্রতিপক্ষের শক্তি বাড়িয়ে ফেলে। এটি গণতন্ত্রের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বিপজ্জনক সংকেত। দাবি, অভিযোগ কিংবা ঘটনা বিশ্লেষণে অসত্যকে যেভাবে প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা হয়েছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। ফলত, জনসাধারণ অনেক সত্য ঘটনাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। রাজনীতিতে নীতির ওপরে জায়গা পেয়েছে কৌশল। সে কারণে বহু টাকা খরচ করে নির্বাচন কৌঁসুলিকে ভাড়া করা হয়েছে। উদ্দেশ্য কীভাবে লক্ষ্য হাসিল করা যায়। পথ ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন। এটি রাষ্ট্রনীতির আধুনিক শৈলী বা বিবর্তিত রণনীতি হতে পারে। তবে এখনো আমাদের দেশে এমন চালাকির সংক্রমণ চোখে পড়ে না।

গুজব, মিথ্যা, ছলচাতুরী ছিল নির্বাচনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষ ভয়ে কিংবা বিভ্রান্ত হয়ে বুথে গেছে বা যাওয়া থেকে বিরত থেকেছে। অনেক জীবিত ব্যক্তিকে ভোটার তালিকায় মৃত দেখানো হয়েছে, কারও ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে, আর ভোট লুটতো সাধারণ ব্যাপার। তবে মজার ব্যাপার ভারতের কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপিও বলেছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। মানুষ ভোট দিতে পেরেছে। অতীতের মতো ঢালাওভাবে ভোটলুট কিংবা গণনাকালে রিগিং হয়নি।

ভোট-পরবর্তী হিংসাও এবার লজ্জার সীমা ছাড়িয়েছে। ভোট দেওয়ার অপরাধে বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে, খুন-জখম হয়েছে, নারীর সম্ভ্রমহানির মতো ঘটনা ঘটেছে। মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। আধুনিক গণতন্ত্রের পীঠস্থান ভারতবর্ষে এটি রীতিমতো অবিশ্বাস্য। আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে অনেক হতাশা আছে, অভিযোগ আছে, তবে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে আমাদের যত মাতামাতিই থাকুক না কেন- কোনোভাবেই যেন এ সংস্কৃতি আমাদের সমাজ মননে ঠাঁই না পায় সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

গণতন্ত্র কি বিবর্তনের ধারায় এখন ক্ষয়ের যুগে প্রবেশ করেছে? এ প্রশ্ন এখন পশ্চিম থেকে প্রাচ্য সর্বত্রই ভেসে বেড়াচ্ছে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় ঔপনিবেশিক শক্তির একদিকে যেমন বিলুপ্তি ঘটেছিল, অন্যদিকে অনেক চমকপ্রদ রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বকে ছাপিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই আধুনিক সভ্যতার প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। সভ্যতার বৌদ্ধিক আশ্রয় গ্রিক মনীষীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যুক্ত করেছেন ডেমোক্রেসি শব্দটি। ‘ডিমোস’ অর্থাৎ জনসাধারণ আর ‘ক্রেটোস’ অর্থাৎ শাসন করা। রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসাবে বিশ্বের সর্বত্রই গণতন্ত্রের এ ধ্রুপদী ধারণা জনমানসকে শাসন করে এসেছে; যেখানে গরিষ্ঠ শাসন করে লঘিষ্ঠের সম্মতিতে।

অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন, গণতন্ত্রের সঙ্গে চিরন্তন সংঘাত বৈষম্যের আর গণতন্ত্রের শত্রু দারিদ্র্য ও অশিক্ষা। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাগুলোও গণতন্ত্রকে নিজের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করে। সার্বিক কল্যাণের জন্য জনগণের শাসন বা সার্বভৌমত্বই যে গণতন্ত্রের দর্শনগত ভিত্তি- এ বিষয়ে সন্দেহ না থাকলেও নির্বাচনে মানুষের অবাধ, মুক্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত ভোটদানের সুযোগের মাঝেই গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিহিত। আর রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি, সামর্থ্য ও সক্ষমতা গণতন্ত্রের শর্তগুলোকে প্রাসঙ্গিক করে রাখে। নোবেল লরিয়েট অভিজিৎ বিনায়ক সেনের মতে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কখনোই নির্বিষ ছিল না। হানাহানি, বোমাবাজি, বলপ্রয়োগের ঐতিহ্য বাম-কংগ্রেস জমানা থেকেই শুরু হয়েছিল। এবারের নতুন মাত্রা পোস্ট পোল ভায়োলেন্স। মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। মানবাধিকার কমিশন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, তাহলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী হবে? মানুষের মতের প্রতিফলনই বা কীভাবে ঘটবে? এবারের নির্বাচনের আরও একটি বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্য হলো ভোটে টাকা ব্যবহারের পাশাপাশি মিডিয়াকে কিনে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধু ভারতে নয়, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এবার এ অভিযোগ অনেকের নজর কেড়েছিল। তাহলে ভাবতেই হবে, এভাবে গণতন্ত্র আর কতকাল টিকে থাকবে?

এবার ফিরি নিজ দেশে। এখানে দীর্ঘদিন সামরিক শাসন বলবৎ ছিল। ছাউনি থেকে ফেরা জেনারেলরা রাজনীতি করেছেন। পাশবিক শক্তি ব্যবহার করে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে নিজের মতো শাসন করেছে। নির্বাচনব্যবস্থাও অগোচরে দূষিত হয়েছে। পেশি ও অর্থ দুটোই মদদ পেয়েছে। তবে জনগণের আগাগোড়াই পছন্দ গণতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধ থেকেই সে আকাক্সক্ষা লালিত হয়ে এসেছে। গণতন্ত্রই মানুষের অধিকারকে স্বীকার করে, মান্যতা দেয়। রাষ্ট্রব্যবস্থা সে গণতন্ত্রের সুফল নাগরিকের কাছে পৌঁছে দেয়। ’৯০ থেকেই এদেশের মানুষকে গণতন্ত্রের জন্য নতুন করে লড়াই শুরু করতে হয়েছে। আশা-নিরাশার দোলাচলে তিন দশক পেরিয়ে গেছে। নির্মম সত্য হলো- রাজনৈতিক দলগুলো সততার পরিচয় দিতে পারছে কিনা সে বিষয়ে সংশয় থেকেই গেছে। ক্ষমতাসীন বা বিরোধীদল- রহস্যজনকভাবে সবার আচরণই বদলে গেছে। ত্যাগ, পরার্থপরতা, সহনশীলতা এ অঙ্গন থেকে দ্রুত উবে যাচ্ছে। নীতি ও আদর্শ অবক্ষয়ের পথে চলায় সব প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষায় দক্ষতা ও জ্ঞান এখন লক্ষ্য নয়। শুধু সনদ চাই; যা নিছকই আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল। কোনো পেশাই এখন অনৈতিকতার ঢেউ থেকে বাঁচতে পারছে না। আর্থ-সামাজিক সূচকে আমাদের সমৃদ্ধি নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু সুশাসন নিশ্চিত করার পথে আমাদের অনেকটা পথ এখনো হাঁটতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে না পারলে আমাদের উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। সেজন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশকে যে কোনো মূল্যে অনুকূল রাখতে হবে। নির্বাচনব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য করতে না পারলে জনসাধারণ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বে; যা মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্গত চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করবে। আমরা ভাবতাম- প্রতিবেশী ভারত আমাদের গণতন্ত্রের দিশা। অন্তত পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক নির্বাচন আমাদের তেমন কোনো সুখকর বার্তা দিতে পারেনি। গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য এ নির্বাচনকে ঘিরে কোনো আশার জায়গা সৃষ্টি হয়েছে- এ কথা হয়তো বলা যাবে না।

অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ

principalffmmc@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম