ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সম্পর্কে যা জানা জরুরি
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ড. মো. আজিজুর রহমান
প্রকাশ: ৩০ মে ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সম্পর্কে যা জানা জরুরি](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2021/05/30/image-425771-1622341680.jpg)
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও সম্ভবত খুব অল্পসংখ্যক মানুষ মিউকরমাইকোসিস (পুরোনো নাম জাইগোমাইকোসিস) বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগটির নাম জানত। ভারতে করোনা রোগীদের মধ্যে ঘাতক এ রোগটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় এর নাম এখন মুখে মুখে। গত শনিবার আলজাজিরায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রায় ৯ হাজার মানুষ মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে মারা গেছে কমপক্ষে ২৯০ জন।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। বাকিদের ছিল উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস। বাংলাদেশেও মিউকরমাইকোসিসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এরই মধ্যে একজন মারাও গেছেন এ রোগে। করোনায় মারাত্মক অসুস্থদের বাঁচাতে স্টেরয়েড (যেমন- ডেক্সামেথাসন ইনজেকশন) ব্যবহারকেই মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনায় সাইটোকাইন স্টর্ম নামে এক ধরনের মারাত্মক অবস্থা সামলাতে ব্যবহার করা হয় স্টেরয়েড। স্টেরয়েডের ব্যবহার শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল করে দেয়। এ সুযোগটাই নেয় মিউকরমাইকোসিস রোগের জন্য দায়ী বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক।
তবে করোনার কারণে যে এ রোগের সংক্রমণ হচ্ছে, তা নয়। মিউকরমাইকোসিস রোগটি প্রাচীন। প্রায় দু’শ বছর আগে এ রোগের সংক্রমণ সম্পর্কে প্রথম জানা যায়। যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মক দুর্বল, তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন- এমন রোগীরাও থাকেন উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকিতে। তাছাড়া, যাদের নিউট্রোপেনিয়া আছে ও অনেকদিন যাবৎ বিস্তৃত-বর্ণালির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হয়েছে- এমন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীরা থাকেন উচ্চ ঝুঁকিতে। যারা ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ যেমন- স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ নিচ্ছেন, তাদেরও হতে পারে মিউকরমাইকোসিস।
মিউকরমাইকোসিস একটি মারাত্মক রোগ; কিন্তু বিরল। এটি এক ধরনের সুবিধাবাদী ছত্রাক সংক্রমণ। সুস্থ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয় না। এটি সংক্রামকও নয়- এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়ায় না। এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুহার গড়ে ৫০ থেকে ৫৪ শতাংশ। মিউকরমাইকোসিস রোগের জন্য দায়ী মূলত মিউকোরলেস বর্গের বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক। ২০০৫ সালে প্রায় ৯০০ মানুষের এ রোগের জন্য দায়ী ছত্রাক পর্যবেক্ষণ করে রোডেন ও তার সহকর্মীরা দেখেছেন, এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৪৭ শতাংশ) রোগীর মধ্যে দায়ী ছিল রাইজোপাস। বাকি ৫৩ শতাংশের মধ্যে ছিল ১৮ শতাংশ মিউকর, ৭ শতাংশ কানিংহামেলা, ৫ শতাংশ অ্যাপফিজোমাইসিস, ৫ শতাংশ লিকথেইমিয়া, ৫ শতাংশ সাকসেনিয়া, ৪ শতাংশ রাইজোমিউকর এবং অন্যান্য জেনাস বা গণের ৭ শতাংশ (সূত্র: Epidemiology and outcome of zygomycosis: a review of 929 reported cases. Clinical Infectious Diseases, 2005)। মিউকোরেলস বর্গের ছত্রাকগুলো পরিবেশের প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান। মাটি, গাছের বাকল ও পাতা, কম্পোস্ট, প্রাণীর মল, পচনশীল কাঠ ইত্যাদিতে প্রচুর মিউকোরেলস থাকে। এ ধরনের ছত্রাকগুলো সূত্রাকৃতির হাইফি দিয়ে তৈরি। এরা স্পোরাঞ্জিওস্পোর নামক এক ধরনের স্পোর তৈরি করে বংশবিস্তার করে। এদের স্পোরগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং নাক-মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। চামড়ায় ক্ষত থাকলে এটি ত্বক দিয়েও শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তবে শরীরে প্রবেশ করলেই যে মিউকরমাইকোসিস হবে তা নয়। সুস্থ মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না এ ফাঙ্গাস।
আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের তথ্য অনুযায়ী, মিউকরমাইকোসিস পাঁচ রকম- ১. রাইনোসেরেব্রাল মিউকরমাইকোসিস (এ রোগটি সাইনাসে হয়; কিন্তু এটি মানুষের মস্তিষ্ক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম); ২. পালমোনারি মিউকরমাইকোসিস (এটি ফুসফুসে হয়); ৩. গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল মিউকরমাইকোসিস (এটি পরিপাকতন্ত্রে হয়); ৪. কিউটেনিয়াস মিউকরমাইকোসিস (এটি ত্বকে হয়) এবং ৫. ডিসেমিনেটেড মিউকরমাইকোসিস, যা রক্তের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রকে আক্রমণ করে। ডিসেমিনেটেড মিউকরমাইকোসিসে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি (প্রায় ৯৬ শতাংশ)। এরপর আছে গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল মিউকরমাইকোসিস (মৃত্যুহার ৮৫ শতাংশ) এবং পালমোনারি মিউকরমাইকোসিস (মৃত্যুহার ৭৬ শতাংশ) (তথ্যসূত্র : Roden MM et al, 2005)। তবে গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল মিউকরমাইকোসিস রোগের প্রকোপ অতটা বেশি নয়। মিউকরমাইকোসিস রোগের একটি বড় অংশই হলো রাইনোসেরেব্রাল টাইপের (৩৯ শতাংশ)। তারপর রয়েছে পালমোনারি (২৪ শতাংশ), ডিসেমিনেটেড (২৩ শতাংশ) এবং এবং কিউটেনিয়াস মিউকরমাইকোসিস (১৯ শতাংশ)। করোনার সঙ্গে সম্পর্কিত মিউকরমাইকোসিস আক্রান্ত রোগীর মধ্যে এ পর্যন্ত রাইনোসেরেব্রাল এবং পালমোনারি মিউকরমাইকোসিস দেখা গেছে।
মিউকরমাইকোসিস রোগের ধরন অনুযায়ী এ রোগের লক্ষণ নির্ভর করে। রাইনোসেরেব্রাল মিউকরমাইকোসিস রোগের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে মুখমণ্ডলের একদিক ফুলে যাওয়া, মাথাব্যথা, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাকের ওপরের অংশে কাল ছোপ, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং জ্বর। পালমোনারি মিউকরমাইকোসিসের লক্ষণ হলো জ্বর, কাশি, বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট। কিউটেনিয়াস মিউকরমাইকোসিস হলে ত্বকে ফোড়া বা ক্ষত হয়, যা আস্তে আস্তে কালো হয়ে যেতে পারে। গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল মিউকরমাইকোসিসের লক্ষণ হলো- পেটে ব্যথা, বমি এবং রক্তবমি ও রক্ত পায়খানা। ডিসেমিনেটেড মিউকরমাইকোসিসের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ নেই; তবে এটি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়লে মানসিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে এবং রোগী কোমায় চলে যেতে পারে।
কীভাবে এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যাবে?
সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের মিউকরমাইকোসিস নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। শুধু যারা উপরোল্লিখিত উচ্চ ঝুঁকি শ্রেণিতে পড়েন- এমন রোগীদের বেশি ধুলাবালি আছে এমন জায়গা এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ পরিহার করা ভালো। তবে রোগের জন্য দায়ী মিউকোরলেস বর্গের বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক যেহেতু পরিবেশের সব জায়গায় বিদ্যমান এবং বাতাসে এদের স্পোর ঘুরে বেড়ায়, তাই সাবধানতা অবলম্বন যে খুব কাজে দেবে, তা নিশ্চিত নয়। করোনার মারাত্মক অবস্থা থেকে সুস্থ হলে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে।
মিউকরমাইকোসিসের চিকিৎসা কী?
আগেই বলেছি, এ রোগটি খুব বিরল; কিন্তু মারাত্মক। সাধারণ ছত্রাকনাশক ওষুধ যেমন কিটোকনাজল, ভরিকনাজল ইত্যাদি মিউকরমাইকোসিসে কাজ করে না। মোট তিনটি ছত্রাকনাশক এ রোগে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যামফোটারিসিন বি, পোসাকনাজল এবং ইসাভুকনাজল। এর মধ্যে শেষের দুটি ওষুধ আমাদের দেশে তৈরি হয় না। দেশের মধ্যে শুধু বিকন ফার্মা টেরিসিন নামক ব্র্যান্ড নামে অ্যামফোটারিসিন বি ইনজেকশন তৈরি করে থাকে। কমপক্ষে চৌদ্দ দিন অ্যামফোটারিসিন বি প্রয়োগ করতে হয়। এ রোগের আরেকটি চিকিৎসা হলো সার্জারির মাধ্যমে আক্রান্ত জায়গা কেটে ফেলা দেওয়া।
মিউকরমাইকোসিস রোগটি ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক রোগ নামে গণমাধ্যমে বেশি পরিচিতি পেলেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নামটি ব্যবহার না করাই উত্তম। কারণ, এ রোগের অনেকগুলো রোগ ও লক্ষণের মধ্যে একটি হলো আক্রান্ত জায়গা কালো রং ধারণ করা। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নামটি বেশি প্রচার পেলে অন্য লক্ষণগুলোর গুরুত্ব কমে গিয়ে এ রোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভুল ধারণা তৈরির অবকাশ আছে। তাই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের পরিবর্তে মিউকরমাইকোসিস ব্যবহার যুক্তিসংগত। এতে এ রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের নাম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে এবং রোগটি সম্পর্কে সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য খুঁজে বের করতে সহায়ক হবে। আর বর্তমানে করোনার কারণে যেহেতু এ রোগের প্রকোপ বেড়েছে, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও করোনার টিকা নিয়ে করোনা প্রতিরোধ করতে পারলেই মিউকরমাইকোসিসের প্রকোপ কমে যাবে।
ড. মো. আজিজুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ; প্রশাসক, জনসংযোগ দপ্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ajijur.rubd@gmail.com