Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাজেট ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়াতে হবে

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২১, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাজেট ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়াতে হবে

দিন পার হলেই জুন মাসের শুরু। আমাদের আর্থিক বছর জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে শুরু করে চলে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত। সাধারণত জুনের প্রথম সপ্তাহেই জাতীয় সংসদে পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব আকারে উত্থাপিত হয়। এবারের বাজেট ৩ জুন উত্থাপিত হওয়ার দিন ধার্য করা হয়েছে। প্রায় সপ্তাহ তিনেক ওই বাজেটের নানা দিক নিয়ে মাননীয় সংসদ সদস্যরা আলোচনা করেন। সব ধরনের সংযোজন-বিয়োজন-পরিমার্জন শেষে জুনের শেষ সপ্তাহে সংসদ বাজেটকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় এবং তা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়।

আলোচনা-সমালোচনার কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে প্রস্তাবিত বাজেটের তেমন কোনো পরিবর্তন আমরা বিগত ৫০ বছরে দেখতে পাইনি, অনেকখানি অক্ষত অবস্থাতেই পাশ হয়ে যায়। সরকারি দলের আধিপত্য থাকায় বিরোধীদের মতামত খুব একটা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। ১৯৭২ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। গেল বছর অর্থমন্ত্রী অ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা করেছিলেন ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের বাজেট ৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বাজেট নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গবেষক, শিল্প ও ব্যবসায়িক মহল, অর্থনীতিবিদ এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও সুশীল সমাজকে এগিয়ে থাকতে দেখা যায়। সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকে সরকার ও বিরোধী রাজনীতিকরা। সরকার সমর্থকরা অনেকটা অন্ধের মতোই বলে থাকেন-‘এ বাজেট গণমুখী’। আবার বিরোধী দলও তাদের মন্তব্য শেষ করেন এক কথায়-‘এ বাজেট গণবিরোধী’। দুটোই চরম প্রতিক্রিয়া। বাস্তবে ভালো-মন্দ মিলিয়েই বাজেট প্রণয়ন করা হয়; কোনো কোনো বাজেটে হতাশার চিত্রটি প্রমিন্যান্ট থাকে, কোনো কোনোটিতে তুলনামূলকভাবে কম উজ্জ্বল থাকে। লক্ষণীয় দিক হলো, এ যাবতকালের কোনো সরকারই বাজেট প্রণয়নের বেলায় গতানুগতিকতার বাইরে যেতে পারেনি। তারপরও বাজেট নিয়ে আমাদের সবারই একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে, থাকে একটা ভিন্ন ধরনের আগ্রহ।

বাজেট আলোচনায় প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো আমাদের আর্থিক সঙ্গতি বা সামর্থ্য। আমরা সবসময়ই আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরতে চাই। একথা সত্য, বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রাখতে হয়, তাই বলে এটিকে একমাত্র নির্ণায়ক বিবেচনা করা ঠিক নয়। আপনার যে পরিমাণ অর্থই থাক না কেন, দেখতে হবে সেই স্বল্প পরিমাণ অর্থ আপনি কতটা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে সক্ষম। গরিব মানুষের অভাবের শেষ নেই, তারপরও কোন্ অভাবকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তা নির্ধারণ করাটা জরুরি। কোন্ খাতে কত খরচ করব, কেনই বা করব তার একটা স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ বাজেটের আকার নয়, দর্শন ভিত্তিটাই মূল কথা। সেসব কথা বিবেচনা করে যদি প্রশ্ন করা হয়-আমরা তাহলে কেমন ধরনের বাজেট চাই? প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আবুল বারকাত বলেন, ‘আমরা এমন একটি বার্ষিক বাজেট প্রস্তাব করতে চাই, যা আমাদের দেশে ‘শোভন সমাজব্যবস্থা’ বা ‘শোভন জীবনব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে এবং একইসঙ্গে ওই বাজেট কাঠামো দিয়েই বিচার হবে যে দেশ শোভন সমাজমুখী কিনা? প্রস্তাবিত বাজেটটি কাঠামোগতভাবে এমন হতে হবে, যার মৌলিক নীতিগত বিষয়াদি একশিলা-দৃঢ়বদ্ধ হবে (monolithic অর্থে), যা প্রকৃতির প্রতি পূর্ণ আনুগত্যভিত্তিক আমাদের জীবনব্যবস্থাকে নিরন্তর শোভনকরণ প্রক্রিয়াভুক্ত করবে। একইসঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটটি কাঠামোগত বিন্যাসের নিরিখে নীতিগতভাবে হবে সর্বজনীন (universal অর্থে) অর্থাৎ অনেক দেশের জন্য প্রযোজ্য- বিশ্বজনীন। আমাদের প্রস্তাবিত বাজেট কাঠামোটি সর্বজনীন এ জন্য যে, তার অভীষ্ট-সবুজ বিশ্বে জ্ঞানসমৃদ্ধ আলোকিত মানুষের বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টি।’ ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি সরকারি বাজেট উপস্থাপনের আগে একটি বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করে আসছে। সেখানে বাজেটের নীতিগত দিকটির ওপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে যা হয় তা হলো কোনো সরকারই সেদিকে দৃষ্টি দেয় না। তারা গতানুগতিকভাবেই খাতওয়ারি বাজেট বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে, তাদের স্বার্থে বাজেট প্রণীত হয়। এই দরকষাকষিতে যেহেতু দরিদ্র মানুষের কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী নেই, তাই তাদের স্বার্থ উপেক্ষিতই থেকে যায়, যে কারণে বাজেটটি সর্বজনীন না হয়ে গোষ্ঠীস্বার্থের বাজেটে পরিণত হয়।

যদি আমরা গতানুগতিক বাজেটও ধরি, তারপরও কিছু কথা বলা যায়। প্রতিটি সরকারের আমলেই বাজেটে খাতওয়ারি বরাদ্দ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়। বলা হয় অমুক খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখানে মানুষের দৃষ্টিকে সংকুচিত করার সুযোগ আছে। কতটা প্রয়োজনের বিপরীতে কতখানি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সে কথাটি আড়ালেই থেকে যায়। ফলে ভুল বোঝার অবকাশ থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধরা যাক শিক্ষা খাতে ব্যয়ের প্রয়োজন ছিল ১০০ টাকা কিন্তু বরাদ্দ দেওয়া হলো ৫০ টাকা। অন্যদিকে পরিবহণ খাতে প্রয়োজন ছিল ৫০ টাকা কিন্তু বরাদ্দ দেওয়া হলো মাত্র ৪০ টাকা। যদি টাকার পরিমাণ ধরা হয় তাহলে বলতে হবে, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেশি দেওয়া হয়েছে, যা প্রকৃত অর্থে সঠিক নয়। আসলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনের ৫০ শতাংশ, আর পরিবহণ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনের ৮০ শতাংশ। সেই হিসাবে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ পরিবহণ খাতে, শিক্ষা খাতে নয়।

আমরা গত ১৫ মাস ধরে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। করোনাভাইরাসের আক্রমণে আমাদের জীবন-জীবিকা আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। গত বছরের শেষ দিকটায় কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও এ বছরের শুরু থেকে তা আবার কঠিন রূপ ধারণ করেছে। এখনো দেশে হালকা মেজাজে হলেও লকডাউন চলছে। করোনার কথা চিন্তা করে গত অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সে মতে গত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা, যা বার্ষিক জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বাজেটের মাত্র ৭ দশমিক ২ শতাংশ। অনেকেই মনে করেন, এ বরাদ্দ করোনা মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়। সে অঙ্কটা বাজেটের কমপক্ষে ১২ শতাংশ হওয়া উচিত। তবে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি কমাতে না পারলে শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে কোনো ফল পাওয়া যাবে না।

গত বাজেটের দুর্বল দিকগুলোকেই বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা জানি, গেল বছর করোনাকালের ক্ষতি মাথায় রেখে সরকার ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। এই প্রণোদনার ক্ষেত্রে কিছু, বিশেষ করে ঋণ বিতরণে পদ্ধতিগত ত্রুটি দেখা গেছে। বড় শিল্প খাতে প্রণোদনার ৮৬ শতাংশ বিতরণ করা হয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বা এসএমই খাতে মোট বিতরণের পরিমাণ ২২ শতাংশের বেশি নয়। এর প্রধান কারণ হলো, ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক কারণেই চাইবে যেন তার প্রদত্ত ঋণ তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এসএমই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি, তাই সুযোগ-সুবিধার অধিকার তাদেরই বেশি। অন্যদিকে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে ব্যাংক অধিকতর ঝুঁকি মনে করে। ফলে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতির প্রতিষ্ঠানকেই ব্যাংক অধিকতর বিবেচনায় নিতে আগ্রহী। তাছাড়া ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বড় শিল্পের তুলনায় কম স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এ বিষয়টির সুরাহা করাটা জরুরি।

সরকারি যে প্রণোদনা তা শুধু আনুষ্ঠানিক খাতের (formal sector) মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনানুষ্ঠানিক খাতকে (informal sector) এর আওতায় আনা হয়নি। চাকরিবাজারকে আমলে নেওয়া হলে দেখা যাবে দেশের মোট শ্রমজীবীর প্রায় ৮৪ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে। ৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষের কর্মবাজারের ৫ কোটি ৭০ লাখই অনানুষ্ঠানিক খাতে। তাছাড়া আমাদের মোট প্রায় ২ কোটি নারী কর্মজীবীর ৮৮ শতাংশই এই অনানুষ্ঠানিক খাতে। তাই এবারের বাজেটে এ খাতে পৃথক মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। করোনাকালের আঘাত থেকে মুক্ত হতে হলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য সরকারি ব্যয় বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণজনিত জটিলতা কমিয়ে আনতে হবে।

সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা তো আছেই। আমরা চাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক খাত-উপখাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হোক। কিন্তু সরকারকে ব্যয় করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে। আমরা মনে করি, আয়ের ক্ষেত্রে সরকারের দুটি প্রধান দুর্বলতা আছে। প্রথমত, নির্দিষ্ট খাত-উপখাত থেকে যে পরিমাণ আয় করার কথা, দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে সরকার কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ আয় আহরণ করতে পারছে না। এর নিরসন হওয়াটা জরুরি। দ্বিতীয়ত, এমন অনেক উপখাত আছে যেখান থেকে সরকার আয় করার কথা ভাবছেই না। যেমন সরকার কোনো সম্পদ কর নেয় না।

অথচ দেশে বার্ষিক সম্পদ করের পরিমাণ হতে পারে ৮০ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত মুনাফা থেকে সরকারের কোনো আয় নেই। কিন্তু এ কর আরোপ করে সরকার বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে। বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবসা এখন রমরমা। এর অনুমতি নবায়ন ফি থেকেই বছরে ২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব, যা বর্তমানে শূন্য। কালো টাকা নিয়ে আমরা সারা বছরই কথা বলে আসছি। কালো টাকা উদ্ধার থেকেই বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। এক অজানা কারণে তা করা যাচ্ছে না। সরকার ইচ্ছা করলে বিউটি পার্লার সেবালব্ধ কর থেকেই বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে। সেদিকে সরকারের কোনোই নজর নেই।

আমরা চাইব বাজেটে সরকারের আয়ের কলেবর বৃদ্ধি করা হবে এবং তা আহরণের দক্ষতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানো হবে।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম