
সাগর থেকে আসা ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গী হয়ে আসে জলোচ্ছ্বাস। কখনো প্রবল বেগে, ভয়ংকররূপে, কখনো অতটা নয়। এ জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষার জন্য তৈরি করা হয় বেড়িবাঁধ। বাংলাদেশের উপকূলে বেড়িবাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয় ষাটের দশকে। সাতক্ষীরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত উপকূলঘেঁষে নির্মিত এ বাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার।
ষাট বছর আগের এ বাঁধের অবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখন জরাজীর্ণ, বিশেষ করে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে। ভাঙাচোরা বাঁধ যে প্রবল জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে অক্ষম তা আবার প্রমাণিত হলো বুধবার, যখন ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত হানল বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলে।
ইয়াস খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে আছড়ে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা প্রথম দিকে করা হয়েছিল, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু ইয়াস শেষ পর্যন্ত জোরেশোরে আঘাত করে ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের দীঘা উপকূলে। ঝড়ের আঁচ বাংলাদেশেও কিছুটা লেগেছে, তবে অতটা তীব্র নয়। মোংলা বন্দরে ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ রেকর্ড করা হয় ঘণ্টায় ৫৯ কিলোমিটার। কিন্তু বিপদ ঘটিয়েছে ইয়াসের সঙ্গী জলোচ্ছ্বাস।
মঙ্গলবার থেকেই সমুদ্রের পানি ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে। বোঝা যাচ্ছিল জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা এবার বেশি হবে- উঁচু জোয়ার হবে। কারণ বুধবার ছিল পূর্ণিমা। তার ওপর সেদিন পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ। ঘূর্ণিঝড়, পূর্ণিমা, চন্দ্রগ্রহণ- এ তিনে মিলে জলোচ্ছ্বাসকে তীব্র করে তোলে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অন্তত ছয় ফুট বেশি উচ্চতা নিয়ে ধেয়ে আসে বাংলাদেশের উপকূলে।
বাংলাদেশের ৯টি উপকূলীয় জেলার ২৭টি উপজেলা জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়। খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় বাঁধ তথা বেড়িবাঁধ অধিকাংশ স্থানেই দুর্বল অথবা জরাজীর্ণ। বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি সহজেই চলে গেছে লোকালয়ে, প্লাবিত করেছে জনবসতি, ফসলের মাঠ। অনেক জায়গায় দেখা গেছে বাঁধ ভাঙা নয় ঠিকই, কিন্তু জোয়ারের পানি বাঁধের ওপর দিয়ে চলে গেছে জনপদে। এমনটি ঘটার কারণ, বাঁধের উচ্চতা কমে গেছে মাটি ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে। বিষয়টি সহজেই বোধগোম্য- বাঁধ মেরামত হয়নি দীর্ঘকাল। তদুপরি জোয়ারের পানির প্রবল চাপে বাঁধের অনেক স্থান নতুন করে ভেঙেছে।
এবারের ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আসার এক বছর আগে, গত বছরের ২২ মে আঘাত হানে আরেক ঘূর্ণিঝড় আম্পান। তখনো জলোচ্ছ্বাসে বাঁধের ক্ষতি হয়, মেরামত হয়নি, হলেও ঠিকমতো হয়নি। ২০১৯ সালে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়, যার নাম ছিল বুলবুল। এর আগে ২০০৯ সালে আইলা নামের একটি ঘূর্ণিঝড়, সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস, খুলনা, বরিশাল উপকূলের ব্যাপক ক্ষতি করে। সেই জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে বা উপচিয়ে লোনা পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে, কৃষি জমিতে। লোনা পানি জমে থাকে বিস্তীর্ণ এলাকায়। ফসল ফলানো যায়নি দীর্ঘকাল। তারও আগে ২০০৭ সালে সিডর নামের আরেকটি ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় জেলাগুলোকে তছনছ করে।
বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম নভেম্বর এবং এপ্রিল-মে মাসে। এ সময় প্রতিবছর ছোটখাটো বা কম শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয় উপকূলীয় এলাকায়। কখনো কখনো ঘূর্ণিঝড় তীব্র হয়, ভয়াবহ হয়। যেমন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা যায়। এভাবে বারবার ঘূর্ণিঝড় আসে উপকূলে প্রকৃতির নিয়মে।
ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাস, তা দুর্বল বা শক্তিশালী যাই হোক না কেন, প্রথমেই আঘাত করে বেড়িবাঁধকে। বেড়িবাঁধ নতুন অবস্থায় মজবুত ছিল, তাই জোয়ারের ধাক্কা সামলাতে পেরেছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাঁধ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে, পানির ধাক্কায় অনেক জায়গা ভেঙে যায় বা ক্ষয়ে যায়। লোনা পানি গ্রাম, লোকালয়, জনপদ প্লাবিত করে, ফসলের ক্ষতি করে।
শুক্রবার (২৮ মে) পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা যায়, খুলনা ও সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ এলাকা তখনো প্লাবিত। বাড়িঘরে পানি, সেখানে থাকা যায় না। বহু মানুষ আশ্রয়হীন, খাদ্যের অভাব, খাবার পানির অভাব। দুর্গত মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পানি কবে নেমে যাবে অনিশ্চিত। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ বলেছেন তারা পাম্প বসিয়েছেন, পানি সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে। কবে শেষ হবে কে জানে! দুর্গত মানুষ কবে ঘরে ফিরতে পারবে?
এদিকে লোনা পানির কারণে ফসলের যে ক্ষতি হলো সেটিই বা পূরণ হবে কী করে? ফসল ছাড়াও হাজার হাজার চিংড়ির ঘের, মাছের ঘের, মাছ চাষের পুকুর ভেসে গেছে জোয়ারের পানিতে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলবাসীর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ছাড়াও মৎস্যসম্পদের যে বিরাট ক্ষতি হলো সেটি জাতীয় অর্থনীতিরও ক্ষতি।
টেলিভিশনের নিউজ বুলেটিনে এবং সংবাদপত্রের পাতায় আমরা দেখেছি জোয়ারের পানি যখন বাড়তে শুরু করেছে, তখন সেখানকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শতশত মানুষ লড়াই করছেন বাঁধ বাঁচানোর জন্য। আমরা দেখেছি মানুষ জীবন-জীবিকা-বাসস্থান বাঁচানোর জন্য মাথায় করে মাটির বস্তা, বালির বস্তা নিয়ে বাঁধের ওপর ফেলছেন বাঁধ রক্ষা করতে। কোদাল দিয়ে মাটি কেটে আনছেন বাঁধের জন্য। বাঁশের খুঁটি, গাছের ডাল বসিয়ে দিচ্ছেন বাঁধের পাশে যাতে বাঁধ ভেসে না যায়। এ হলো বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
উপকূলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামত করা হোক। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়েছে, সে কারণে বাঁধ মজবুত করার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধের উচ্চতাও বাড়াতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে, যাতে জোয়ার যত বেশিই হোক, বাঁধ উপচিয়ে যেন পানি আসতে না পারে। কিন্তু উপকূলবাসীর আবেদন, নিবেদন, দাবি কর্তৃপক্ষের কানে কতটা প্রবেশ করে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
উপকূল এলাকার মানুষ যখন বাঁধ রক্ষার জন্য প্রাণপণ লড়াই করছিলেন, সে সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের কেউ সেখানে এসেছিলেন কিনা জানি না। সংবাদপত্র বা টিভির রিপোর্টে তার উল্লেখ নেই।
জরাজীর্ণ বাঁধ মেরামত বা পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থের বরাদ্দ কত আছে আমার জানা নেই। তবে ধারণা করতে পারি, এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বরাদ্দ নিশ্চয়ই কম নয়। তা কি সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে, সে প্রশ্ন জনগণের মনে রয়েছে। সঠিকভাবে ব্যয় হলে বাঁধের এত দুরবস্থা হবে কেন?
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ে অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে, পুনর্নির্মাণের কাজও চলছে। বাঁধগুলো অনেক পুরোনো। এ জন্য ডেল্টা প্রকল্পের আওতায় টেকসই বাঁধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সেটার জন্য বাজেট বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। ২০৩১ সালের মধ্যে সব উপকূলীয় অঞ্চল টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
টেকসই বাঁধ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, এটা খুবই ভালো কথা। কিন্তু এ জন্য ২০৩১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? ভাঙা বাঁধ পুনর্নির্মাণের বা মেরামতের সাময়িক ব্যবস্থা নিতে অসুবিধা কোথায়? ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আসছে এমন সতর্কবার্তা পাওয়া গিয়েছিল অন্তত এক সপ্তাহ আগে। তখনই কেন বাঁধের ভাঙা অংশগুলো মেরামতের জন্য জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? তাহলে তো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং মানুষের দুর্ভোগ অনেক কমিয়ে আনা যেত।
সাধারণ মানুষ যখন বুঝতে পেরেছে মহাবিপদ আসন্ন, তখনই তারা কোদাল হাতে, মাটির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বাঁধ রক্ষায় নেমেছে। হয়তো সফল হয়েছে, অথবা হয়নি, প্রাণপণ চেষ্টা তো করেছে। পাউবোর প্রকৌশলী বা কর্মকর্তারা তখন কেন এগিয়ে আসেননি? তারা কি ডেল্টা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছেন?
উপকূল এলাকার মানুষ কৃষিজীবী অথবা মৎস্যজীবী। এ পেশার মাধ্যমে তারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন এবং দেশের মানুষের অন্নের সংস্থান করেন। জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অবদান বিরাট। উপকূলবাসীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তাদের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে। ডেল্টা মহাপরিকল্পনার অধীনে টেকসই বাঁধ নির্মাণ হতে আরও এক দশক লাগবে। ততদিন উপকূলবাসীকে জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচাতে অস্থায়ী ভিত্তিতে মজবুত ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।
মনে রাখা দরকার, ইয়াস শেষ ঘূর্ণিঝড় নয়, ঘূর্ণিঝড় আরও আসবে, আসতেই থাকবে।
চপল বাশার : সাংবাদিক ও লেখক