চীনা দূতের বক্তব্যের সমালোচনা দেশে-বাইরে

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ফাইল ছবি
সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত কূটনৈতিক সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে হুমকির সুরেই বলেছেন বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দিলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত ১৩ মে চীন সরকারের এক মুখপাত্র চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের সমর্থনে কথা বলায় এটা এখন নিশ্চিত হলো যে, চীনাদূতের উক্তি মোটেও তার ব্যক্তিগত কথা ছিল না। এটি ছিল চীনের রাষ্ট্রীয় বক্তব্য। শুধু বাংলাদেশেই নয়, চীনাদূতের বক্তব্যের সমালোচনা বাইরেও হয়েছে। কেননা এটাই স্বাভাবিক। একটি সার্বভৌম দেশ কি করবে সে ব্যাপারে বাইরে কোন দেশ হুমকি দেওয়া তো দূরের কথা, মতামতও দিতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইন তাই বলছে।
দুটি দেশের মধ্যে আলোচনা এবং যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে দূতের ব্যবহার, যাকে অতীতে লিগেশন নামে উল্লেখ করা হতো, অনাদিকাল থেকে প্রচলিত। ইতালি এবং গ্রিসের নগর রাজ্যগুলোর মধ্যে এ ধরনের যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল খ্রিস্টজন্মের বহু আগে থেকে। ভারতের মৌর্য যুগে কৌটিল্যের লিখিত অর্থ শাস্ত্রেও এ ধরনের যোগাযোগের কথার উল্লেখ রয়েছে। মনুও তাই লিখেছেন।
মৌর্য সম্রাট অশোক সিংহল এবং দূরপ্রাচ্যের দেশসমূহের দূত পাঠিয়েছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য। বঙ্গভূমি থেকে হাজার বছর পূর্বে অতীশ দীপংকর তিব্বত গিয়েছিলেন দূত হিসেবেই। মেগাস্থিনিস, হিউ এন শং, ইবনে বতুতা ও ভারত বর্ষে এসেছিলেন দূত হিসেবেই। খ্রিস্ট-পরবর্তীকালে রোমান পোপের রাজ্য হলি সী থেকেও দূত পাঠানো হতো বিভিন্ন দেশে। তবে স্থায়ী দূতাবাস রাখার প্রথা ১৪ শতকের আগে শুরু হয়নি। ডিপ্লোমেট শব্দটির প্রচলন ও তার আগে হয়নি। এ প্রথা ইটালি এবং ভেনিস ১৩ শতকে শুরু করেছিলেন বলে ইতিহাস বলছে। ১৫ শতকে জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডেও এই প্রচলন শুরু হয়। ১৫২০ সালে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে ইংল্যান্ড এবং জার্মানিতে স্থায়ী দূত রাখার ব্যবস্থা হয়। ইংল্যান্ড টিউডর রাজবংশের রাজত্বকালে, বিশেষ করে প্রথম এলিজাবেথের সময়, ভারতের মোগল সম্রাটদের দরবারে দূত পাঠাতেন ব্রিটিশ রাজ, যার ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ব্যবসার অনুমতি পায়। এই লিগেশন পদ্ধতির কারণে ১৫ শতক থেকেই বিদেশি দূতের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইনে অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং শুরু থেকেই যে কথাটি প্রাধান্য পায় তা হলো এই যে দূতগণ কখনো স্বাগতিক দেশের ঘরোয়া ব্যাপারে নাক গলাবে না। অধ্যাপক ব্রাউনলি কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন এটি হচ্ছে এমনি সম্পর্ক যার দ্বারা বিভিন্ন রাষ্ট্র পারস্পারিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে এবং চালিয়ে যায়, একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, রাজনৈতিক অথবা আইনি আলোচনা চালিয়ে যায়।
তবে কূটনৈতিক শব্দটির উৎপত্তি হয় সপ্তাদশ শতকে এবং তখন থেকেই এই তত্ত্বটির উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রা শুরু। ১৮১৪ সালে ভিয়েনাতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অব ভিয়েনার মাধ্যমেই এর আনুষ্ঠানিক পথযাত্রা শুরু। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রচলিত অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি বিধিবদ্ধ করে আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত করার জন্য এটি ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।
তৎপূর্বেও ইংল্যান্ডে ১৭০৮ সালেও কূটনৈতিক সুবিধাদি আইন ছিল, যা ছিল ইংলিশ কমন ল’ বিধানসমূহের আদলে। তবে কূটনৈতিক বিষয়াদিকে সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজিয়ে বর্তমান সময়ের উপযোগী করার জন্য বিধিবদ্ধ করা হয় ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের মাধ্যমে। শুরু থেকেই যে নিয়ম প্রচলিত ছিল তা হলো কোনো দেশের দূত স্বাগতিক দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবে না। ১৮১৪ সালের কংগ্রেস অব ভিয়েনা এই নীতি অনেকটা আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে আনা হয় এবং এ ব্যাপারে আইনের যাত্রা শুরু হয়। ইংলিশ কমন ল’ বিধান মতে দ্বিপাক্ষিক বা বহুজাতিক চুক্তির বিধানাবলি দেশি আদালতে আইনের স্বীকৃতি পায় না যদি চুক্তির বিধানসমূহকে পার্লামেন্টে আইন পাশ করে দেশি আইনের মর্যাদা প্রদান করা না হয়। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অনেক দেশ ১৯৬১ সালের কূটনৈতিক সংক্রান্ত ভিয়েনা কনভেনশনকে পার্লামেন্টে আইন পাশ করে দেশি আইনের অন্তর্ভুক্ত করেছে।
১৯৬১ সালের কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, যেসব ব্যক্তি কূটনৈতিক সুবিধাদি ভোগ করে, তাদের দায়িত্ব রয়েছে স্বাগতিক দেশের আইনকে শ্রদ্ধা করা এবং সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানো।
১৯৬১ সালের কনভেনশন একদিকে যেমন কূটনীতিকদের সুযোগ-সুবিধার বিধান রেখেছে, অন্যদিকে তেমনি তাদের ৫টি দায়িত্বের কথাও উল্লেখ করেছে। এই ৫টির দ্বিতীয়টিতে বলা আছে স্বাগতিক দেশে আন্তর্জাতিক আইন সাপেক্ষে নিজ দেশের এবং নিজ দেশের নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা। অর্থাৎ এখানে তাদের ওপর আন্তর্জাতিক আইন পালনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। প্রথাগত (কোস্ট্রামারি) আন্তর্জাতিক আইন বলছে কোনো কূটনৈতিক প্রতিনিধি স্বাগতিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে না। বিষয়টি পরিষ্কার করতে আন্তর্জাতিক আইনের এক শীর্ষ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ওপেন হাইম তার পুস্তকে লিখেছেন ‘এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে কূটনীতিকরা অবশ্যই স্বাগতিক দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জীবনে হস্তক্ষেপ করবে না। সে দেশের রাজনৈতিক স্রোত অবলোকন করা এবং তা নিজ দেশকে জানানোর অধিকার তাদের অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো অধিকার নেই স্বাগতিক দেশের রাজনৈতিক জীবনে অংশ নেওয়ার বা কোনো দলকে সমর্থন করার বা হুমকি দেওয়ার। যদি কেউ সে নিয়ম না মানে তবে সেটি হবে কূটনৈতিক সুযোগের অপব্যবহার। তেহরানে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক এবং কনস্যুলার স্টাফ (১৯৭৯) মামলায় আন্তর্জাতিক আদালত কূটনীতিক এবং স্বাগতিক দেশ উভয়কেই আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার বাধ্যবাধ্যকতার কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রথাগত বা কাস্টমারি আন্তর্জাতিক আইন ছাড়াও রয়েছে ১৯৭০ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ঘোষণা যাতে বলা হয়েছে প্রতিটি দেশই অন্য রাষ্ট্রকে হুমকি দেওয়া, সে দেশের জাতীয় সংহতি অথবা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য। তাছাড়া জাতিসংঘ সনদেও পরিষ্কারভাবে সার্বভৌম সমমর্যাদার নীতির কথা বলা আছে ২ অনুচ্ছেদে। এর অর্থ হচ্ছে কোনো রাষ্ট্রই অন্য কোনো রাষ্ট্রের ওপর দাদাগিরি চালাতে পারবে না। দেশি আইনে যেমন আইনের চোখে সবাই সমান, আন্তর্জাতিক আইনেও ছোট, বড়, ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সব দেশ একই কাতারে। চীনা দূত ওপরে উল্লেখিত হুমকি দিয়ে দাদাগিরিই করতে চেয়েছেন। চীন একটি প্রাচুর্যবান দেশ। তার থেকে অর্থ ধার করা আমাদের প্রয়োজন। এ কথা পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েই চীনের সেই হুমকি। অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সময়োচিতভাবেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন চীনা দূতের হুমকির জবাব দিয়েছেন কঠোর ভাষায়। বলেছেন বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে সে কোয়াডে যাবে কিনা যাবে এটি তার নিজস্ব ব্যাপার। এ ব্যাপারে কোনো দেশ তাকে নির্দেশনা দিতে পারে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও চীনা দূতের ধৃষ্টতার কঠোর সমালোচনা করেছেন।
চীন যে এই প্রথম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলালো, তা নয়। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর শাহাদত দিবস, অর্থাৎ আমাদের জাতীয় শোক দিবসে চীনা দূত খালেদা জিয়ার জন্য ফুল এবং উপহার পাঠিয়ে আমাদের শোক দিবসকে উপহাস করেছিল। বঙ্গবন্ধুর আত্মাকে অবমাননা করেছিল। ১৫ আগস্ট যে খালেদা জিয়ার সত্যিকার জন্ম দিবস নয়, সেটা চীনা দূতের জানা ছিল না বলে সে উপহাসের মাত্রা আরও বাড়িয়ে ছিল। খালেদা জিয়ার ভুয়া জন্মদিবসের কথা না জানালেও দিনটি যে আমাদের শোক দিবস সে কথা তো চীনা দূতের না জানার কথা নয়। আসল কথা চীন মনে করছে তাদের ঋণ আমাদের প্রয়োজন আর তাই দাদাগিরির অধিকার রয়েছে তাদের। অথচ আমাদের ঋণ দিয়ে চীনই বেশি লাভবান হচ্ছে। কেননা তারা যে হারে সুদ নিচ্ছে, অর্থাৎ ৩.১/২, তা বিশ্ববাজারের বিবেচনায় অতি উঁচু। বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল এমনকি ভারত থেকে নেওয়া ঋণে ও সুদের হার অনেক কম। এটাও অজানা নয় যে, গ্রাম্য মহাজনদের মতো এবং কাবুলিওয়ালাদের মতো চীন শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জিবুতিসহ বহু দেশকে ঋণজালে আটকিয়ে তাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে। অন্যদেশের ঘরোয়া বিষয়ে নাক গলানো চীনের জন্য নতুন নয়। কয়েক মাস আগে নেপালে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত প্রত্যক্ষ এবং দৃশ্যমানভাবে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করেছে। মালদ্বীপের রাজনৈতিক পরিবর্তনেও চীনা হস্তক্ষেপের ছাপ ছিল।
মিয়ানমারের ঘরোয়া ব্যাপারেও চীনের হস্তক্ষেপ দর্শনীয়। বিশাল অর্থসম্পদের মালিকানার কারণেই চীন আন্তর্জাতিক আইনকে তোয়াক্কা না করে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর দাদাগিরি চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন লংঘন করে দক্ষিণ চীন সাগরের একচ্ছত্র মালিকানা দাবি করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা এক সময় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এখন সময় হয়েছে চীনের এই দাদাগিরিকে কঠোরভাবে প্রতিহত করা। চীনের এই আশকারা এখনই প্রতিহত না করলে চীন আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তনের মতো ভয়ংকরী প্রচেষ্টায় মেতে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, যেমনটি তারা নেপালে করেছে এবং এখনো করছে, মালদ্বীপ করেছে। চীনের পয়সা বিতরণের ঘটনা তো বাংলাদেশে হাতেনাতেই ধরা পড়েছে।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত