
করোনাকালীন আমার বন্দিজীবন থেকে সংসদ ভবনের উত্তর পাশের সড়কটির দূরত্ব খুব কম। প্রায় হাত বাড়ালেই ধরা যায়। পা ফেললেই পৌঁছা যায়। জীবন যখন প্রায় বিবর্ণ ধূসর কুয়াশায় এক চরম অনিশ্চয়তায়, ঠিক তখন বিছানায় শুয়ে বন্দিজীবনে সেই আমার প্রিয় রাস্তাটি বারবার কাছে টেনেছে।
ঠিক এ সময় কৃষ্ণচূড়া দারুণ সাজে এক আনন্দযাত্রার পথ তৈরি করে ওই সড়ক। রাজধানীতে ওটি আমার সবচেয়ে প্রিয় সড়ক। এপ্রিল-মে এ দু’মাস ওই সড়কের তুলনা নেই। দু’ধারে শুধু কৃষ্ণচূড়া আগুন ছড়িয়ে দেয়। রূপ-সৌন্দর্য উজাড় করে দেয়। কী অপূর্ব সৌন্দর্য কৃষ্ণচূড়ায় লাল হয়ে যায় সড়কের দু’পাশ। প্রতিবছর এ সময়টায় গাছ থেকে যেন থোকা থোকা আগুন ঝরে পড়ে। আছে দু-চারটা রাধা চূড়া, জারুল। যাদের নয়ন আর মন আছে তারা ওই সৌন্দর্যটা উপভোগ করেন। বাকিরা শুধু সড়কে যাতায়াত করেন। হয়তো হেঁটে, কিংবা লেক্সাস, বিএমডব্লিউ গাড়িতে ছুটে যান। দু’পাশে ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া ওদের আকর্ষণ করে না। ধরেও রাখতে পারে না। ভুলেও গাছের দিকে তাকান না। সময় কোথায়? তাদের জীবন মানে কেবলই ছুটে চলা।
দুই.
করোনা জীবনে অখণ্ড অবসরে অনিশ্চিত সময়ের মুখোমুখি হয়ে ভাবনার পৃথিবীটা ডানা মেলে ধরে। সেখানে মানুষ বিশেষে নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও আইনের কোনো বেড়াজাল নেই। মামলা কিংবা জেল অথবা কারও রক্তচক্ষুর কোনো বালাই নেই। থাকুক বা না থাকুক, সংবিধান আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছে। ভাবতে কোনো বাধা নেই। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, সব দেশেই। ভাবতে পারবেন, কিন্তু কতটা চর্চা করতে পারবেন-সেটা আপেক্ষিকতায় সীমাবদ্ধ।
করোনাকালীন ঘরে থেকে কতজনের মৃত্যু সংবাদ পেলাম-যখন আমি সেই পথের যাত্রী। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি হাসান শাহরিয়ার করোনায় মারা গেলেন। মনে হলো, এই দফায় আমিও কি ওই পথের যাত্রী? মৃত্যুর আগে বেশ কিছুদিন কিংবা জানাজায় শাহরিয়ার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো না। ওই পাড়ে কি দেখা হবে? যেমন প্রেস ক্লাবে দেখা হতো-প্রায় প্রতিদিনই। এই ক’দিন আগে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের এক অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান স্যার, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী, ঢাবির সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর ও আমি একই মঞ্চে বসে কথা বলেছি। সেই শামসুজ্জামান খান স্যার চলে গেলেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। কী অদ্ভুত সময়। আসলে কেউই থাকে না। কিছুই থাকে না। এই চলে যাওয়া সুহৃদ স্বজনদের শোক সংবাদগুলো পড়ে মনে সান্ত্বনা খুঁজেছি গৌতম বুদ্ধের নিুোদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলোতে-
“জীবন
এক টুকরা মায়া
একপ্রস্ত খোয়াব
একখানা বুদবুদ
এক ফালি ছায়া।
চিরস্থায়ী কিছু নাই
রাগ করিবার কিছু নাই
বিবাদ করিবার কিছু নাই।
কিছুই নাই।”
[বুদ্ধের হৃদয়, পৃ. ৫৫]
কলামিস্ট বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ, চিত্রনায়িকা কবরীসহ সর্বশেষ ফিউরি খোন্দকার আরও অনেক কাছের মানুষ এ সময়ে মারা গেছেন করেছেন। পরিচিত কাছের প্রিয় মানুষদের মৃত্যু আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি একজন স্বজনের চলে যাওয়ার কষ্ট অনুভব করি একেবারে ভেতর থেকে। অনেক সময়ই যার প্রকাশ থাকে না।
তিন.
জীবনের ওপারে চলে যাওয়া কাউকেই আমি বলতে পারি না-‘ভুলব না। বেঁচে থাকবেন, আমাদের মধ্যে, আমার মধ্যে।’ কী এক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে। নিজেকে প্রশ্ন করি, এ কথা বলে তা কি আমি রক্ষা করতে পারব? পিতা-মাতার মৃত্যুর পর আমরা যারা সন্তান হয়ে তাদের কবরের কাছে যেতে সময় পাই না, বছরে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া মনেও রাখি না, তারা কি এ রকম একটি প্রতিশ্রুতি কাউকে দিতে পারি? সাংবাদিক সমাজের কথাই বলি, কাকে মনে রেখেছি আমরা? অন্তরের অন্তস্তল থেকে, হৃদয়ের গভীরতায় কতটা রাখতে পেরেছি? সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী, ওবায়দুল হক, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, আবদুল গণি হাজারী, আহমেদ হুমায়ুন, এনায়েত উল্লাহ খান, গিয়াস কামাল চৌধুরী, এসএম পারভেজ, মীর নূরুল ইসলাম, এবিএম মূসা, বজলুর রহমান, সন্তোষ গুপ্ত, এসএম আলী, মো. ইদ্রিস, গোলাম সারওয়ারসহ আরও অনেক নাম। কে মনে রেখেছেন? কী করেছেন? মানিক মিয়া, বজলুর রহমান, আবদুস সালামসহ দু-চারজনের মৃত্যুদিবসে তাদের ছেলেমেয়ে মিলাদ পড়ান। পত্রিকায় দু-একটি প্রেস রিলিজ দেন-ছাপা হয়। ওই পর্যন্তই। যাদের ছেলেমেয়ে নেই কিংবা থাকলেও গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট নন, তারা এক ধরনের হারিয়ে গেছেন। এসব বিশিষ্ট সাংবাদিকের জীবন ও কর্মের প্রামাণ্যদলিল নেই। কোনো স্মারক নেই। তাদের কর্ম ও অবদান নিয়ে আলোচনা নেই। এ প্রজন্ম জানেই না, তারা কারা। গণমাধ্যমকর্মীদেরও অনেকের কাছে এসব অজানা। এ কথাগুলো আমি বহুবার বলেছি। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হিসাবে বোধহয় ২০১৯-২০, দুবছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছি। যেন মৃত্যুর মিছিল ছিল। ক্লাবের টেনিস কোর্ট যেখানে টেনিস খেলা হয়নি, হয়েছে শুধুই জানাজা, সে স্থানটিকে আমি ‘জানাজা চত্বর’ নামে অভিহিত করেছি।
অনেক শোকসভা আর স্মরণসভায় মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের সামনেই আমি বলেছি, ‘ভুল বুঝবেন না, মনে কষ্ট নেবেন না। আমার কাছে বা আমাদের কাছে বেশি আশা করবেন না। আমরা বেশি কিছু করতে পারব না, বেশিদিন মনেও রাখব না। এখন ভালো ভালো কথা বলব, একটি-দুটি কাগজে ভালো লিখব- তারপর? নির্মম সত্য মনেও রাখব না।’
চার.
আমাকে ক্ষমা করবেন মূসা ভাই, সারওয়ার ভাই, শাহরিয়ার ভাই। ক্ষমা করবেন, আর অনেকের মতো আমি বলতে পারব না, আপনাদের ভুলব না। আমরা তো ভুলেই গেছি। মনে আছে বলে যা দেখছেন তা আসলে সত্যি নয়। মনে আছে বলে দেখাই। আসলে মনে নেই। সাংবাদিক, সমাজকর্মী বেবী মওদুদের জীবদ্দশায় তার সংগ্রামী, সাহসী জীবনকে যারা দুর্বিষহ করে তুলেছিল, তার মৃত্যুর পর তাদেরই কেউ কেউ ব্যানার টাঙিয়ে শোকসভা করেছেন। চোখের জলও ফেলেছেন। আহারে মানুষ!
মেকি এই সমাজে আত্মপ্রতারণার এক মহোৎসব চলছে। কোনো ব্যক্তির পদে যেতে কিংবা তার চেয়ারে বসতে কিংবা নিজের আখের গোছাতে সারাক্ষণ যে যার মৃত্যু কামনা করে; অথচ সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পর পদাকাঙ্ক্ষীর কান্নায় আকাশ ভারী করে তুলে স্মরণসভায় বলেন, ‘ভুলব না। ভুলব না।’
দিনরাত আমাদের চারপাশে থাকা সুবিধালোভীদের মুখে ভুলেও এখন আপনাদের নাম শুনি না প্রিয় মূসা ভাই, সারওয়ার ভাই। আফসোস হয়, বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে মন। আপনাদের যা কিছু তা সবই আপনাদের করা। আমরা কিছু লোক আপনাদের এখনো বিক্রি করে যাচ্ছি মাত্র। আসলে পুঁজিবাদী সমাজে সব সম্পর্কই যে সুতার ওপর টিকে থাকে। আপনারা কি দেখছেন আমাদের? কষ্ট পাবেন না। আবার বলি, ক্ষমা করবেন। আর এটুকু ভেবে শান্তি খুঁজবেন। আমাদের পরিণতি হবে একই। আমরাও এভাবে হারিয়ে যাব কালের অতল গহ্বরে। এ যেন নচিকেতার সেই বৃদ্ধাশ্রমের পিতা-পুত্রের কাহিনি।
তারপরও করোনাক্রান্ত বিষাদ মাখানো দিনগুলোতে আমাদের মহত্তম কবি রবীন্দ্রনাথের শাশ্বত সুরের স্পন্দনে বারে বারে আশায় উজ্জীবিত হয়েছি-
“দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক
তবে তাই হোক।
মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক
তবে তাই হোক।
পূজার প্রদীপে তব জ্বলে যদি মম দীপ্ত শোক
তবে তাই হোক।
অশ্রু-আঁখি ’পরে যদি ফুটে ওঠে তব স্নেহ চোখ
তবে তাই হোক॥’’
[গীত বিতান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পূজাপর্বের-১৯৩ সংখ্যক গান। পৃ. ৬২]
স্রষ্টার স্নেহ চোখ আমাদের করুণায় সিক্ত করে, জীবন প্রবহমান থাকে। আমরা থেমে যাই, আবার চলতে শুরু করি-এটাই জীবনের দাবি।
০২ মে ২০২১
ইকবাল রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
সাইফুল আলম : সম্পাদক, যুগান্তর
সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব