Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

লিজে পাটকল রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা করবে কি?

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লিজে পাটকল রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা করবে কি?

গত বছরের ১ জুলাই থেকে বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো চালু করা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী সম্প্রতি যুগান্তরকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

তার সাক্ষাৎকারে যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক. পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) এসব পাটকল চালুর আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে লিজ বা ভাড়ার ভিত্তিতে চালুর জন্য সেগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেওয়া; খ. এসব পাটকলের দায়দেনা পরিশোধ; গ. লিজ গ্রহীতা কর্তৃক এসব পাটকলের শ্রমিকদের নিয়োগ প্রদান; এবং

ঘ. লিজ গ্রহীতা কর্তৃক এসব পাটকল সফলভাবে চালু করা ও তা ধরে রাখা। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো পিপিপি পদ্ধতিতে চালু করার বন্ধ-পূর্ব প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসে সরকার এখন এগুলো লিজভিত্তিতে চালুর সিদ্ধান্ত কেন নিল এবং এতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ কতটা সুরক্ষিত থাকবে, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকদের ছেড়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয়করণকৃত ৮২টি পাটকল নিয়ে স্বাধীনতার পরপর গঠিত হয় বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)। ব্যবসা-বাণিজ্যে অনভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের এসব পাটকলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান, দুর্নীতি, মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে এ খাতে বিপর্যয় দেখা দেয়।

১৯৭৫-পরবর্তী সরকার বিজেএমসির আওতাধীন এসব পাটকলের বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে, যা পরবর্তী সময়ে অব্যাহত থাকে। গত বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের সংখ্যা ছিল ২৬, যার মধ্যে চালু ছিল ২৫টি। সুষমকরণ, আধুনিকায়ন, প্রতিস্থাপন ও বিস্তারের (বিএমআরই) মাধ্যমে পাটকলগুলোকে স্বাবলম্বী করে তোলার উদ্যোগের কথা সরকার ২০১৮ সাল পর্যন্ত বলে আসছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত বলেন, উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর পাট ও পাটবীজ উৎপাদন এবং সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিজেএমসিকে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে মিলগুলোর বিএমআরই করা হচ্ছে।

২০২০ সালে সরকার অনেকটা হঠাৎ করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ওই বছরের ১ জুলাই থেকে এসব পাটকল বন্ধ করে দেয়। সরকারি ভাষ্যমতে, জন্মলগ্ন থেকে এসব পাটকল ক্রমাগতভাবে লোকসানে থাকাই এগুলো বন্ধের কারণ। তবে পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণার আগে সরকার পিপিপির মাধ্যমে সেগুলো চালু রাখার কথা বলে।

২০২০ সালের ২৫ জুন অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বলেন, ‘পিপিপির মাধ্যমে জুট মিল থাকবে, এটা ডিসাইডেড।’ ২০২০ সালের ১ জুলাই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণার এক মাস পর ৩ আগস্ট বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠককালে বলেন, ‘সম্প্রতি বন্ধ ঘোষিত দেশের পাটকলগুলোকে আবার চালু করতে যাচ্ছে সরকার। সরকারি নিয়ন্ত্রণে পিপিপির মাধ্যমে পাটকলগুলো চালু করা হচ্ছে।’ এরকম আরও উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এসব খবর সে সময় গুরুত্বসহকারে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

বন্ধ ঘোষিত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর কর্মপন্থা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ সম্পর্কিত নীতিনির্ধারণী কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার এগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাছে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যায়।

তবে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এসব পাটকলের প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে সব পাওনা পরিশোধ করে বিদায় (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মন্ত্রী তার সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, গত জুলাইয়ে বন্ধ হওয়া ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মধ্যে জাতীয়, খালিশপুর, দৌলতপুর ও কেএফডি- এই চারটি মিলের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা হয়েছে এবং বাকি ২১টি মিলের ৯৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, পাটকলগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাছে লিজ প্রদানের ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত আরোপ করা হবে। এগুলো হলো- এক. লিজ দেওয়া পাটকলগুলো বিজেএমসির ‘তত্ত্বাবধানে’ থাকবে।

দুই. লাভ-লোকসানে কোনো অংশীদারিত্ব থাকবে না। তিন. লিজ প্রদানের পর সরকারের দেওয়া শর্তাদি পালিত হচ্ছে কিনা তার তদারকি করবে বিজেএমসি। তাছাড়া অগ্রাধিকার হিসাবে অবসায়িত শ্রমিকদের নিয়োগ দেবে লিজ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি।

যুগান্তরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বলেছেন, বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো প্রথমে পিপিপির মাধ্যমে দেওয়ার চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু সেভাবে চালু করতে গেলে মিল হস্তান্তর করতে চার থেকে পাঁচ বছর লেগে যাবে। সেখান থেকে বেরিয়ে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। লিজের অর্থ হলো মিলগুলো বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে এবং মালিকানায় থাকবে সরকার। পাটকলগুলো ২০ বছর মেয়াদে লিজ দেওয়া হবে। তবে লিজ নিয়ে ভালো করতে পারলে মেয়াদ আরও বাড়ানো হবে।

কিন্তু চালু করতে না পারলে তা ফেরত নেওয়া হবে। বন্ধ পাটকলগুলোর দায়দেনা কে পরিশোধ করবে এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেছেন, দায়দেনা পরিশোধ করবে সরকার। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে।

মিলগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার সময় সেগুলো পরিশোধ করে দেওয়া হবে। লোকসানি পাটকল শ্রমিকদের লিজগ্রহীতা কাজে লাগাতে চাইবে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেছেন, অভিজ্ঞ লোক ছাড়া মিল দ্রুত চালুর কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃত পাটকল মালিকরা মিল চালুর সময় এসব অভিজ্ঞ ও দক্ষ শ্রমিককে খুঁজে বের করবে। তার বিশ্বাস, মিল মালিকরা দক্ষ শ্রমিকদের খুঁজে বের করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দেবে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাছে ভাড়াভিত্তিক লিজ প্রদানের ভিত্তিতে বিজেএমসির অধীন বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো লিজ পদ্ধতিতে চালু করার পক্ষে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে তা হলো- লিজ পদ্ধতিতে এগুলো দ্রুত চালু করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে পিপিপি বা যৌথ উদ্যোগ পদ্ধতিতে চালু করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে অন্য কথা। ১৯৭৭-১৯৯৬ সময়কালে ৪৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর আরও কয়েকটি মিল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বিজেএমসির অধীনে থাকে, যার মধ্যে ২৫টি চালু অবস্থায়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এসব পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার ফলাফল মোটেই সুখকর হয়নি। বেসরকারি খাতে কম দামে ছেড়ে দেওয়া পাটকলগুলোর সম্পদ বিক্রি করে বেসরকারি মালিকরা লাভবান হয়েছেন।

মিল বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, মিল যথাযথভাবে চালাননি, শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন। যেসব পাটকল বেসরকারি উদ্যোক্তারা লিজ নিয়েছিলেন, সেগুলোও চলেনি। এখন যে ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাছে লিজ দেওয়া হবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে যে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?

এদিকে মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) প্রস্তাব করেছে, পাটকলগুলোর লিজের মেয়াদ হতে হবে ৯৯ বছর। তাদের যুক্তি, দীর্ঘ মেয়াদের লিজ হলে বড় পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে বাণিজ্যিকভাবে মিলগুলোকে লাভজনক করার সুযোগ আছে।

স্বল্পমেয়াদি লিজে ব্যাংক ঋণ পাওয়া যাবে না। যেহেতু সরকার-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাছে পাটকলগুলো লিজ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু তাদের দাবি পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে পাটকলগুলোর ওপর সরকারের কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হবে না। সরকারের মালিকানা হবে একটা কাগুজে ব্যাপার মাত্র।

সরকার বলছে, পিপিপির মাধ্যমে এসব পাটকল চালু করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ খাতে পিপিপি পদ্ধতি চালু রয়েছে। পরিবহণ খাত, অর্থনৈতিক জোন, পর্যটন খাত, স্বাস্থ্য খাত, আবাসন ও নগরায়ণ খাত, শক্তি খাত, আইটি খাত, শিক্ষা খাত এবং শিল্প খাতে ৫৬টি প্রকল্প পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া হয়েছে। শিল্প খাতে গৃহীত চারটি প্রকল্প হলো- ডেমরা টেক্সটাইল মিল উন্নয়ন, টঙ্গী টেক্সটাইল মিল উন্নয়ন, টাঙ্গাইল টেক্সটাইল মিল উন্নয়ন এবং বিটিএমসির ১৩টি টেক্সটাইল মিল প্রোগ্রাম (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৯)। দশ মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো পিপিপির মাধ্যমে চালুকরণ কিছুটা সময়সাপেক্ষ হলেও এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকত।

বিজেএমসির অধীন বন্ধ থাকা ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মধ্যে ১৭টিকে লিজে দিতে সংস্থাটি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র (এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট) আহ্বান করেছে। এতে আগ্রহী দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে আগামী ১৫ জুনের মধ্যে দরপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে। পরে বাছাইয়ের পর সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চাওয়া হবে। কোনো মিলের জন্য সমমানভিত্তিক কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাবে সর্বোচ্চ বিবেচিত দরদাতাকে সেটি লিজ দেওয়া হবে। সরকার এসব পাটকল চালুর জন্য লিজ পদ্ধতি বেছে নিয়েছে এবং সেপথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সেখান থেকে ফেরা সম্ভব হবে না।

এখন সরকারকে যা নিশ্চিত করতে হবে তা হলো লিজ প্রদানের ক্ষেত্রে শিল্প খাতে, বিশেষ করে পাটশিল্পে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। শুধু বেশি ভাড়া প্রদানের জন্য লিজ দেওয়া সঠিক হবে না। দেখতে হবে, সর্বোচ্চ দরদাতা কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের এ ফিল্ডে অভিজ্ঞতা আছে কিনা।

কারণ অভিজ্ঞতাহীন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ভাড়া প্রদান করে লিজ পেলেও মিল চালু করতে নাও পারে বা পারলেও তা অনেক দেরিতে। বিদেশি দরদাতা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাছে লিজ প্রদান অগ্রাধিকার পেতে পারে। এতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) উৎসাহিত হবে। আর যে বিষয়ে সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে তা হলো লিজ গ্রহীতা কর্তৃক অবসায়িত পাটকল শ্রমিকদের নিয়োগদান। মোট কথা, পাটকলগুলো লিজ প্রদানে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সুরক্ষায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম