Logo
Logo
×

বাতায়ন

করোনাকালে রবীন্দ্রনাথ

Icon

মফিদুল হক

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

করোনাকালে রবীন্দ্রনাথ

ফিরে ফিরে আসে পঁচিশে বৈশাখ, কবি নিজেই বলেছিলেন ডাক দেয় চির নতুনের। এই ডাকের অর্থ রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনা, নতুন বাস্তবতায় সংকটে সম্ভাবনায় যে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন আমাদের সহায় ও নির্ভর। বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে, বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায় খুঁজে পেয়েছে তার দুঃখদিনের নির্ভরতা, তবে এ দুঃখ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিমানবের নিবিড়তম অনুভূতি, যেখানে মেলে আপনার রবীন্দ্রনাথকে।

মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট-বেদনা নানাভাবে নেমে আসে, সেখানে ব্যক্তি মানুষ যখন খোঁজে সান্ত্বনা ও শক্তি, তখন দুঃখজয়ের বাণীমন্ত্র বাঙালি পায় রবীন্দ্রনাথের গানে। গান এবং তার এমন বিশ্লেষণ তো কতভাবেই না করা হয়েছে, এজন্য কতজনের কাছেই তো আমরা ঋণী- আবু সয়ীদ আইয়ুব, শঙ্খ ঘোষের পাশাপাশি বলতে হয় সন্জীদা খাতুন, আবদুস শাকুরের কথা।

‘মর্ত্য কাছে স্বর্গ যা চায়’- এমন রাবীন্দ্রিক শিরোনামে প্রবন্ধ-পাঠ করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ ঢাকায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানে ১৯৭৫ সালে। সম্প্রতি করোনায় তার প্রয়াণের পর পুনরায় মনে পড়ে সেই পাঠ, শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘এক মৃত্যুগহ্বর ঘিরে আছে আমাদের সমস্ত জীবন। কিন্তু সেই মরণলোক থেকে উঠে আসে স্মৃতির পর স্মৃতি, কানাকানি হতে থাকে এ-পারে ওই-পারে। জীবনের দায় থেকে পালাই না আমরা, দুহাত দিয়ে ধরতে চাই তার সমস্ত প্রত্যঙ্গ। মুখে নয় কোনো গ্লানির চিহ্ন, অমলের সৌন্দর্যে ভরে যায় দশদিগন্ত।’

এমন উপলব্ধির মধ্যে যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাই, তাকে আজকের বিশাল বৈশ্বিক মৃত্যুগহ্বরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কীভাবে নতুন করে পেতে পারি? এর কোনো সহজ উত্তর নেই, তবে আজ যখন কোভিড সংক্রমণে বিপর্যস্ত বিশ্বে রয়েছি সামাজিক দূরত্বে, প্রত্যেকে খুঁজছি উত্তরণের পথ, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, দৈশ্বিক, বৈশ্বিক তথা গোটা মানবসভ্যতার নিরিখে আমাদের তৈরি করতে হচ্ছে মুক্তির পথ, তখন ব্যক্তিগত অস্তিত্বের সংকটের পাশাপাশি মানবসভ্যতার দশা নিয়েও ভাবিত হতে হচ্ছে বৈকি।

এই নতুন বাস্তবতা নতুন পথানুসন্ধানের তাগিদ নানাভাবে মেলে ধরছে সামনে। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে ফিরে পাওয়ার অভিপ্রায়ে আমরা তাকাতে পারি ‘মুক্তধারা’ নাটকের প্রতি, এর পুনর্পাঠ নিলে মানবসত্তার স্বরূপ বিষয়ে অন্যতর উপলব্ধির পরশ আমরা খুঁজে পেতে পারি। এ পাঠ আমাদের প্রচলিত ভাবনাস্রোতে হঠাৎ হাওয়ার দোলা এনে দিতে পারে, হয়তো শোনাতে পারে বাণী- ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনোখানে’। দুর্যোগ-পীড়িত নব-বাস্তবতায় সেটাই বা কম কী!

করোনা আমাদের সভ্যতার সংকট বিষয়ে বড় রকম জিজ্ঞাসার মুখোমুখি করেছে। যন্ত্র, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের নব নব উদ্ভাবনী শক্তিতে প্রকৃতি থেকে সম্পদ আদায় করে জীবন উপভোগের উপাচারে প্লাবিত যে সভ্যতা আমরা নির্মাণ করেছি, সেখানে প্রকৃতির অভিশাপ আমাদের নানাভাবে আঘাত করছে। প্রকৃতির আর্তনাদ আমরা শুনিনি, প্রকৃতির প্রত্যাঘাতে আমরা আর্তধ্বনি উচ্চারণ করছি।

‘মুক্তধারা’ নাটকে কর্তৃত্ববান রাজপ্রভুর নির্দেশে প্রযুক্তির শক্তিতে বলীয়ান যন্ত্রবিদ বিভূতি নির্মাণ করেছিল মুক্তধারার ঝরনা আটকে দেওয়ার বাঁধ। যন্ত্ররাজের বন্দনায় মুখর মানবসম্প্রদায়ের কণ্ঠে অদ্ভুত এক গান বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘মডার্ন টাইমস’ চলচ্চিত্রে হাসির আবরণে যে কান্না শোনাতে চেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন আরও কিছুকাল পরে, সেখানে অন্যতরভাবে এমন উপলব্ধির অনুরণনই আমরা খুঁজে পাই।

‘নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র’ গানে মন্ত্রোচ্চারণের মতো অনুপ্রাস-শোভিত শব্দগুচ্ছ বারবার অনুরণিত হয়, সেই সূত্রে যে উপলব্ধি মেলে ধরা হয় তা শিল্পের এক অপরূপ সমন্বয়। রাজানুগত লোকবাহিনী গাইছে গান, ‘তব লৌহগলন শৈলদলন/অচল-চলন মন্ত্র/...তব খনি-খনিত্র-নখ-বিদীর্ণ/ক্ষিতি বিকীর্ণ-অন্ত্র/তব পঞ্চভূত-বন্ধনকর/ইন্দ্রজাল-তন্ত্র।’

সভ্যতার এমন অগ্রগমন বন্দনার পাশাপাশি আমরা পাই যুবরাজ অভিজিৎকে, ঝরনাতলায় কুড়িয়ে পাওয়া প্রকৃতির সন্তান। অভিজিতের সঙ্গে জোটে বাউল ধনঞ্জয়। তারা পাড়ায় পাড়ায় ক্ষেপিয়ে তোলে সবাইকে অন্য এক মন্ত্রে, যেখানে বারবার ফিরে আসে গান, অনেক পুরোনো গানও নতুন অর্থ নিয়ে দেখা দেয় নাটকে।

আকাশজুড়ে মোহন সুরে যে বাঁশি বেজে চলে সেই সুরই ধ্বনিত হয় যন্ত্র-নিনাদের বিপরীতে, আর তাই তো ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে তরী ভাসাতে আর দ্বিধা থাকে না। পথই দেখাবে পথ, দিন শেষে মিলবে দুঃখদিনের রক্তকমল। এমন নাট্যরূপে বাস্তব জীবনের সংকটের কোনো সমাধান মিলবে না, তবে জীবনে সামঞ্জস্য গড়ার তাৎপর্য ও পথরেখা এখানে খুঁজে পাওয়া যায়।

আজকের অতিমারি-পীড়িত বাস্তবতায় বিশ্ব সভ্যতার সংকটের পটভূমিকায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা নিতে পারি। করোনা মোকাবিলায় মানবসভ্যতার ঐক্য একান্ত জরুরি, কোনো মানব, কোনো দেশ, কোনো মহাদেশ বিচ্ছিন্নভাবে বাঁচতে পারবে না। অন্যদিকে এ সম্মিলিত সাধনা ও সংগ্রামের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সভ্যতার বিন্যাস; যেমন কর্তৃত্ববাদে তেমনি প্রকৃতি-সংহারক রূপে।

যে প্রতিষেধক টিকার ওপর মানবের বাঁচা-মরা নির্ভরশীল, তা আবিষ্কার মানবজ্ঞানের মিলিত ফসল; কিন্তু কতক দেশ ও কোম্পানি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছে একচ্ছত্র অধিকার। ভ্যাকসিন ডিভাইড যন্ত্ররাজ বিভূতির মতোই তৈরি করেছে শক্তিশালী বাঁধ, সবার অধিকার নেই জল-সিঞ্চনে কিংবা টিকা পাওয়ায়। আরও কতভাবেই না বাঁধ রয়েছে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশে, মানবের মুক্তিধারায়।

আজকের সংকটকালে এ মারের সাগর পাড়ি দিতে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন সহায়। সেই ডাক নিয়েই আসে পঁচিশে বৈশাখ।

মফিদুল হক : লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম