Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিনা মূল্যে আইনগত সহায়তা পাওয়ার উপায়

Icon

ড. মো. রেজাউল করিম

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিনা মূল্যে আইনগত সহায়তা পাওয়ার উপায়

আজ ২৮ এপ্রিল। জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। আইনগত সহায়তাপ্রাপ্তির অধিকার মূলত একটি সাংবিধানিক অধিকার।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূল সংবিধানেই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারীসহ বিচার প্রক্রিয়ায় ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাইকে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার বিধান সন্নিবেশিত করে দেন।

সংবিধানে স্পষ্টভাবে সন্নিবেশ করা হয়- সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে (অনুচ্ছেদ ১৯.১)।

প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী (অনুচ্ছেদ ২৭)। কোনো ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না (অনুচ্ছেদ ৩৩.১)। প্রত্যেক নাগরিকের দ্রুত বিচার লাভের অধিকার থাকবে (অনুচ্ছেদ ৩৫.৩)।

সংবিধানে এসব বিধান অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে ধনী বা আর্থিক সামর্থ্যবান নাগরিকদের পাশাপাশি দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী তিন দশকে দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকারে আইনগত সহায়তা প্রদানের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো চালু হতে দেখা যায়নি।

ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি প্রথমবার সরকার গঠন করেই আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান করার লক্ষ্যে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ প্রণয়ন করে দেন এবং জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।

কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এ আইনের বাস্তবায়ন কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায়। এরপর ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করলে আইনি সহায়তা কার্যক্রমকে গতিশীল ও সেবাবান্ধব করার লক্ষ্যে ঢাকার বেইলি রোডে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয় এবং এর অধীনে প্রত্যেক জেলায় লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপনসহ বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট, চৌকি আদালত এবং শ্রম আদালতে লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম চালু করা হয়। বর্তমানে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে, এমনকি সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টেও লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা সারা দেশে সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এজন্য দেশের সব চৌকি আদালত এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রম আদালতেও বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে এখন শুধু আইনি সহায়তা প্রদানের কেন্দ্র হিসাবে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। মামলা জট কমানোর লক্ষ্যে এ অফিসগুলোকে ‘এডিআর কর্নার’ বা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্রস্থল’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এজন্য ২০১৫ সালে ‘আইনি পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ বিধিমালা প্রণয়ন করে লিগ্যাল এইড অফিসারদের এডিআর বা বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির আইনি ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

এ ক্ষমতাকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে দেওয়ানি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করা হয়েছে। বর্তমানে প্রত্যেক জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে একজন করে সিনিয়র সহকারী জজ/সহকারী জজকে লিগাল এইড অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং তারা আইনগত সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছেন। ২০১৬ সালে সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমকে ডিজিটাইজেশন করা হয়।

এ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করা হয় জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টার ১৬৪৩০। টোল ফ্রি এ নম্বরে ফোন করে যে কেউ আইনি পরামর্শ নিতে পারেন। সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় লিগ্যাল এইড সেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে চালু করা হয় লিগ্যাল এইড অনলাইন কার্যক্রম।

লিগ্যাল এইড অফিস থেকে যেসব আইনি সেবা প্রদান করা হয় : ১. যে কোনো ব্যক্তি, তার আর্থিক সামর্থ্য যা-ই হোক না কেন, সরকারি আইনগত সহায়তা কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত আইনগত তথ্যসেবা গ্রহণ, আইনগত পরামর্শ গ্রহণ কিংবা বিবদমান পক্ষসমূহের মধ্যে আপসযোগ্য বিরোধসমূহ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার সেবাসমূহ; ২, অসহায় ও দরিদ্র ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলা দায়েরের প্রয়োজন হলে সরকারি খরচে মামলা দায়ের ও পরিচালনা করা; ৩. মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ; ৪. আদালত থেকে প্রেরিত মামলাসমূহ মধ্যস্থতা করা;

৫. বিনা মূল্যে ওকালতনামা সরবরাহ; ৬. আইনজীবীর ফি পরিশোধ; ৭. মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক সব ব্যয় পরিশোধ; ৮. ফৌজদারি মামলার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যয় পরিশোধ; ৯. মধ্যস্থতাকারী বা সালিশকারীর সম্মানি পরিশোধ; ১০. ডিএনএ টেস্টের যাবতীয় ব্যয় পরিশোধ; ১১. বিনা মূল্যে রায় কিংবা আদেশের অনুলিপি সরবরাহ।

যারা আইনগত সহায়তা পাবেন : ১. অসচ্ছল বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি যার বার্ষিক গড় আয় সুপ্রিমকোর্টে আইনগত সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ১,৫০,০০০ টাকা এবং অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে ১,০০,০০০ টাকার ঊর্ধ্বে নয়; ২. কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন বা বার্ষিক ১,৫০,০০০ টাকার ঊর্ধ্বে আয় করতে অক্ষম এমন মুক্তিযোদ্ধা; ৩ কোনো শ্রমিক যার বার্ষিক গড় আয় ১,০০,০০০ টাকার ঊর্ধ্বে নয়; ৪ শিশু; ৫. মানব পাচারের শিকার কোনো ব্যক্তি; ৬. শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু; ৭. নিরাশ্রয় ব্যক্তি বা ভবঘুরে;

৮. ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের লোক; ৯. পারিবারিক সহিংসতার শিকার অথবা সহিংসতার ঝুঁকিতে আছেন এরূপ যে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি; ১০. বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এরূপ কোনো ব্যক্তি; ১১. ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মাতা; ১২. দুর্বৃত্ত দ্বারা এসিডদগ্ধ নারী বা শিশু; ১৩. আদর্শগ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তি; ১৪ অসচ্ছল বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা এবং দুস্থ মহিলা; ১৫. প্রতিবন্ধী; ১৬. আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন আদালতে অধিকার প্রতিষ্ঠা বা আত্মপক্ষ সমর্থন করিতে অসমর্থ ব্যক্তি;

১৭. বিনা বিচারে আটক এমন ব্যক্তি যিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে আর্থিকভাবে অসচ্ছল; ১৮. আদালত কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলে বিবেচিত ব্যক্তি; ১৯. জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল হিসাবে সুপারিশকৃত ব্যক্তি।

কোথা থেকে ও কীভাবে আইনি সেবা পাওয়া যায় : (ক) জাতীয় হেল্পলাইন কল সেন্টার থেকে। আইনি সেবা প্রদান আরও বিস্তৃত ও সহজ করার লক্ষ্যে সরকার ২০১৬ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে টোল ফ্রি জাতীয় হেল্পলাইন কল সেন্টার চালু করেছে।

অফিস চলাকালীন এই কল সেন্টারের ১৬৪৩০ নম্বরে যে কোনো মোবাইল/টেলিফোন থেকে ফোন করে আইনি পরামর্শ, আইনগত তথ্য, লিগ্যাল কাউন্সিলিং, মামলা করার প্রাথমিক তথ্য, সরকারি আইসি সেবা সম্পর্কিত যে কোনো পরামর্শ, সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে কোনো অভিযোগ কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণ সম্পর্কিত সেবা পাওয়া যায়।

এর জন্য কোনো কলচার্জ কাটা যায় না। (খ) লিগ্যাল এইড অফিস থেকে : জেলা পর্যায়ের মামলা পরিচালনায় আইনগত সহায়তা লাভের জন্য ৬৪টি জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থিত জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির কাছে আবেদন করতে হয়। সুপ্রিমকোর্টে সরকারি আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত ‘সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসের’ মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির কাছে আবেদন করতে হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে সরকারি আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য সেখানকার শ্রমিক আইন সহায়তা সেলের মাধ্যমে শ্রম আদালত বিশেষ কমিটির কাছে আবেদন করতে হয়। চৌকি আদালতে সরকারি আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট চৌকি আদালত বিশেষ কমিটির কাছে আবেদন করতে হয়।

(গ) বিডি লিগ্যাল এইড অ্যাপের সহায়তায়। অনলাইনে আইনি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার ২০১৮ সালে বিডি লিগ্যাল এইড অ্যাপ চালু করেছে। এছাড়া director-nlaso.gov.bd ই-মেইল ঠিকানায় এবং bdnlaso ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ করেও বিনা মূল্যে সরকারি আইনি সেবা নেওয়া যেতে পারে। বিদেশ থেকে +৮৮০৯১২৩১৬৪৩০ নম্বরে ফোন করে বিনা মূল্যে সরকারি আইনি সেবা নেওয়া যাবে।

ড. মো. রেজাউল করিম : গবেষক

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম