
সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি, বেতন নিয়ে কর্মচারীদের অভিযোগের যেন শেষ নেই। বেতন বৃদ্ধির সংগ্রাম যেন সেখানে জীবনের বড় একটি আন্দোলন। বেতন বাড়াতে হবে, বেতন বাড়াতে হবে। সশব্দে বলুক আর নিঃশব্দে, এ যেন প্রত্যেক কর্মচারীর মনের কথা। কিন্তু সেখানেও ব্যতিক্রম আছে। এমন সব ব্যতিক্রম আছে বলেই জীবননদীতে ভিন্ন স্রোতের ধারা খুঁজে পাওয়া যায় অনেক সময়।
পৃথিবীতে এমন একটি সংস্থা আছে, যেখানে না চাইতেই কর্মীদের বিপুল বেতন দেওয়া হয়েছে। তাও আবার এই কোভিড আবহে। আমেরিকার ওয়াশিংটনের বালার্ডে রয়েছে এ সংস্থার সদর দপ্তর। ‘গ্রাভিটি পেমেন্টস’ নামের এ সংস্থাটির সিইও ড্যান প্রাইস। ‘গ্রাভিটি পেমেন্টস’ একটি ক্রেডিট কার্ড প্রসেসিং সংস্থা। ২০০৪ সালে ড্যান প্রাইস এবং তার ভাই লুকাস সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তখন ড্যান প্রাইসের বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। তিনি তখন একজন কলেজছাত্র। কলেজের একটি ঘর থেকেই শুরু হয়েছিল ‘গ্রাভিটি পেমেন্টসে’র যাত্রা। মাত্র চার বছরের মধ্যেই ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বড় ক্রেডিট কার্ড সংস্থায় পরিণত হয় ‘গ্রাভিটি পেমেন্টস’। বর্তমানে সংস্থাটির গ্রাহকের সংখ্যা ১৫ হাজারেরও বেশি।
কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কোনো চাহিদা ছিল না। বেশ খুশিই ছিল সংস্থার শ দুয়েক কর্মী। কিন্তু সংস্থার সিইও চান তার কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হোক। আর এটা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের সিইও নিজের বেতন কমিয়ে দিয়েছেন অনেকটাই। কর্মীবান্ধব এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে সারা বিশ্বের নজরে এসেছেন সংস্থার সিইও ড্যান প্রাইস। ২০১৯ সালে তিনি প্রত্যেক কর্মচারীর বেতন ১০ হাজার ডলার বাড়িয়ে দেন।
ড্যান আগে সংস্থা থেকে বছরে ১০ লাখ ডলার বেতন নিতেন। এটা তিনি কমিয়ে নিতে এবং কর্মীদের সমান বেতন নেওয়ার অভিপ্রায়ে ২০১৯ সাল থেকে বছরে মাত্র ৭০ হাজার ডলার বেতন নিতে শুরু করেন। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার তিনি সংস্থায় ফেরত দেন। এ অর্থ যেন প্রত্যেক কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধিতে কাজ করে, সে ব্যবস্থা করেন তিনি।
২০১৫ সালে ছোট্ট এ সংস্থাটি সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ধাক্কা খেয়েছিল যেন সংবাদকর্মীরাও। ২০১৫ সালে সংস্থার সিইও ঘোষণা দেন, তার সংস্থার প্রত্যেক কর্মচারীর বার্ষিক বেতন হবে কমপক্ষে ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। সেই থেকে প্রতিবছরই তিনি তার কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করে চলেছেন। তারই হিসাবে ২০১৫ সালে প্রত্যেক কর্মচারীর বার্ষিক বেতন বেড়েছিল ১০ হাজার মার্কিন ডলার।
ইতোমধ্যে ড্যান ঘোষণা করেছেন, ২০২৩ সালের মধ্যে তার সংস্থার প্রত্যেক কর্মীর বেতন হবে কমপক্ষে ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। কঠিন সময়ে এবং মূল্যবৃদ্ধির আবহে কোনো কর্মচারীকেই যাতে সমস্যায় পড়তে না হয়, সেজন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সিইও ড্যান। আর এজন্য তিনি নিজের বেতন কর্তন করেছেন অনেকাংশে। ড্যানের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারেননি সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং তার ভাই লুকাস।
লুকাসের সঙ্গে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার একপর্যায়ে বিষয়টি আদালতে গিয়ে পৌঁছে। আইনি লড়াই করতে হলেও ড্যানের সিদ্ধান্তের কোনো তারতম্য হয়নি। আইনি লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন ড্যান। কারণ তিনি বেতন বাড়িয়েছেন সংস্থার ক্ষতি করে নয়, বরং তার বেতন কর্তন করে সেখান থেকে বড় অঙ্কের অর্থ অনুদানের মাধ্যমে। তবে দুই ভাইয়ের সঙ্গে মতবিরোধ থাকলেও ড্যানের সিদ্ধান্তের ফলে সংস্থার লাভ হয়েছে অনেকটাই।
২০১৪ সালে সংস্থাটি যা লাভ করেছিল, তার থেকে দ্বিগুণ লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল ২০১৫ সালে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯-এর প্রভাব পড়ার আগে কোম্পানি প্রতিমাসে ৪০ লাখ মার্কিন ডলার আয় করেছিল। ড্যানের বর্তমান বয়স ৩৬ বছর। ৩১ বছর বয়স থেকেই ড্যান কোটিপতি হয়ে গিয়েছিলেন। ড্যানের সহজ বক্তব্য, কর ফাঁকি দিতে কোনো জনসেবায় বিশ্বাসী নন তিনি। নিজের আয় কমিয়ে সংস্থার অন্যান্য কর্মীদের আয় বৃদ্ধি করাই তার উদ্দেশ্য।
আমেরিকার ফ্লোরিডার এক সৈকতে সাঁতার কাটতে বেরিয়েছিলেন এক ব্যক্তি। পানিতে নেমেই তিনি অবাক হয়ে যান। তার চোখে পড়ে অন্য এক বস্তু। তিনি দেখেন, একটি বড় কালো বস্তুর মতো কিছু সৈকতের দিকে ভেসে আসছে। শুরুতে তার কিছুটা দ্বিধা হয়। কিন্তু দ্বিধা কাটিয়ে একসময় তিনি সেটিকে তুলে আনেন সৈকতে। বস্তা খুলে ওই ব্যক্তির চোখ কপালে ওঠে।
বস্তার ভেতরে ইটের মতো ২৫টি পার্সেল। পার্সেলগুলোতে ছিল কোকেন। পুরো পর্সেলটির ওজন ছিল ৩১ কেজি। কোকেনগুলো পেয়েই তিনি স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সব কোকেন তুলে দেন ইউএস বর্ডার প্যাট্রলের নিরাপত্তা কর্মীদের হাতে। স্থানীয় প্রশাসন, মনরো কাউন্টি শেরিফ অফিস নিশ্চিত করে, এ কোকেনের বাজারমূল্য দেড় লাখ মার্কিন ডলার। কিন্তু সাঁতার কাটতে যাওয়া ব্যক্তিটি এ বেওয়ারিশ সামগ্রীর লোভ না করে সরকারের হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করেননি।
ভারতের মানুষ তাদের মিডিয়ার গুণে সাক্ষী হতে পেরেছে, যা তাদের চোখে শান্তির পরশ বয়ে এনেছে। দক্ষিণ ভারতের কয়ম্বাটোরের পুলিয়াকুলাম। ছোট্ট একটি জায়গা। তার মধ্যে ছোট্ট একটি দোকান। রাস্তার পাশে বিরিয়ানি বিক্রেতা। সেই ছোট্ট দোকানটিই ক্ষুধার্ত মানুষকে বিনা মূল্যে বিরিয়ানি খেয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
দোকানটি সাধ্যমতো গরিবদের মাঝে বিনামূল্যে বিরিয়ানি দান করে যাচ্ছে। রেডিও জকি এবং অভিনেতা বালাজি টুইটার করে জানিয়েছেন, ‘কয়ম্বাটোরের পুলিয়াকুলামের ছোট্ট রাস্তার ধারের এ বিরিয়ানির দোকানটি কত বড়! মানবতা তার সেরা সময়ে আছে।’ দোকানের বিলবোর্ডে তামিল ভাষায় লেখা বিজ্ঞাপন-‘আপনি কি ক্ষুধার্ত? তাহলে ভালোবাসার সঙ্গে বিরিয়ানি গ্রহণ করুন।’
বাংলাদেশের পুরান ঢাকার পল্টন মোড়ে মুক্তি ভবনের নিচে শ্রমজীবী ক্যান্টিন। বামপন্থি ছাত্র ও যুব সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের উদ্যোগে বিনা মূল্যে প্রতিদিন দুবেলা খাবার পাচ্ছেন কিছু গরিব মানুষ। করোনা মহামারিতে আয় কমেছে, প্রতিদিনের সংসার খরচ জোগাড় করা কঠিন, ফুটপাতের সস্তার হোটেলগুলো বন্ধ। এ অবস্থায় ঢাকার হতদরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে শ্রমজীবী ক্যান্টিন।
ঢাকায় একটি সাড়া জাগানো এনজিও’র নাম ‘বিদ্যানন্দ’। তাদের স্লোগান-পড়ব, খেলব, শিখব। তাদের দাবি অনুযায়ী, তারা ১০ লাখ রোজাদারকে রমজানে খাওয়াতে চায়। প্রস্তুত করা খাবার পরিবেশন করতে চায় ইফতার ও সাহরির সময়। ইতঃপূর্বে তারা এক টাকায় আহার পরিবেশন করেছে পথশিশুদের। এ মহৎ কাজে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে অনেক স্বেচ্ছাসেবক। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে চলছে এমন বড় মানের মানবতার সেবা। সাহায্য চাচ্ছে তারা দাতাদের কাছে। আর অভাবীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে রান্না করা খাবার।
শত বছর আগে রোমান দার্শনিক লুসিয়াস আনায়েস সেনেকার বলেছিলেন-‘মানুষ যেখানেই আছে, সেখানেই দয়া করার সুযোগ রয়েছে।’ মহান কিছু মানুষ আর সংস্থার কাজ দেখে মনে হচ্ছে তার কথাটা আজও সত্য। মানুষ যেখানে আছে, আপনার সাহায্যের হাত বাড়ানোর সুযোগ সেখানেই আছে। ‘মানুষ সব সময়ই মানুষের জন্য’-এ চরম সত্যটি প্রমাণ করার জন্য সব সময়ই আমাদের চারপাশে কিছু মহান সত্তা এসেছে।
আমরা তাদের না চিনলেও তারা তাদের চারপাশের মানুষগুলোকে ঠিক চিনে নিচ্ছে; মানুষ হয়ে তারা ঠিক পাশে দাঁড়াচ্ছে মানুষের। তাদের কাজটুকু কত মানুষের উপকারে লাগছে, তা খুব বড় বিষয় নয়। বড় বিষয়টি হলো, তাদের কাজ অনেক বড় মাপের মানবতার নিদর্শন স্থাপন করেছে। তারা গরিবের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করছে। কষ্ট কতটা লাঘব হচ্ছে, তার চেয়েও বড় তাদের অনুভূতির প্রকাশ।
কারণ গরিবের অসহায়তার উলটা পিঠে থাকে অবহেলার বাস্তবতা। আজকের এ অন্ধকারের মধ্যেও আমরা তাই নতুন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। এমন উদাহরণ আরও অনেক আছে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সমাজে। বেছে বেছে এমন কয়েকটি চিত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে আয়োজনটি নয়, বরং উদ্দেশ্যটিকে বড় করে দেখানোর প্রয়াস রয়েছে।
দেখতে পাচ্ছি অনেক নতুন মানুষকে, যারা বস্তা পচা বিভেদের সমাজব্যবস্থাকে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করে কাজের কথা বলছেন, মানবতার কথা বলছেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাহস জোগাচ্ছেন। তাদের এসব উদাহরণ আমাদের আগামী সমাজকে রাঙিয়ে দেবে আরও বেশি করে-এমন আশাবাদ নিয়ে বাঁচতে চাই সামনের দিনগুলোয়।
মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক
ceo@ilcb.net