Logo
Logo
×

বাতায়ন

দিল খুলবে পরে, আগে খুলুক হাত

Icon

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দিল খুলবে পরে, আগে খুলুক হাত

ফাইল ছবি

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হলো জাকাত। রোজা আত্মার শুদ্ধি এনে দেয় আর জাকাত নিয়ে আসে সম্পদের শুদ্ধি। সৎপন্থায় উপার্জিত সম্পদের ওপর নির্দিষ্ট সময় শেষে সুনির্দিষ্ট হারে জাকাত দেওয়ার বিধান রয়েছে। এটি ইসলামের একটি অবশ্য পালনীয় বিধান। পবিত্র কুরআন শরিফের ৮২ জায়গায় নামাজ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে জাকাত দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। জাকাত দেওয়ার মাধ্যমে একজন মানুষের বদান্যতা ও পরোপকারিতার প্রকাশ ঘটে। তাছাড়া এতে দুস্থ মানুষের কল্যাণ আনয়নের মাধ্যমে সহমর্মিতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। ফলে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্যপূর্ণ একটি দুর্বল ও ভঙ্গুর সমাজ হয়ে উঠে শান্তিময়।

যে ব্যক্তি রোজা রাখে ও সঠিকভাবে জাকাত দেয়, তার জন্যই কল্যাণের বার্তা রয়েছে। কারণ দেহ, মন ও চিন্তা-চেতনার আসল শুদ্ধি শুধু রোজার মাধ্যমেই সম্ভব। অন্য কোনো বাহ্যিক ইবাদতের সঙ্গে এখানেই রোজার পার্থক্য। ঈমানদার মুসলমানরা নামাজ আদায় করেন, রোজা রাখেন, জাকাত দেন। জাকাতের মাধ্যমে দুস্থ-অসহায় মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, উদারতা ও সহানুভূতি প্রকাশিত হয়। সাধারণত প্রতি বছর রমজান মাসে মুমিনদের জমাকৃত বার্ষিক সম্পদের ওপর ধর্মীয়মতে নির্দিষ্ট হার হিসাব করে জাকাত দেওয়ার তৎপরতা বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠে।

কিন্তু বর্তমানে ভোগবাদী জীবনে অভ্যস্ত ক’জন মানুষ অপরের কথা ভাবেন? মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা মুসলিম বিশ্বের বিত্তশালী অনেক মানুষ এখন চাকচিক্যময় আধুনিক অট্টালিকা তৈরি, দামি ব্রান্ডের নতুন গাড়ি ক্রয়, বিদেশি রিসোর্টে অবসর যাপন ও দরিদ্র প্রতিবেশীদের ওপর যুদ্ধ করার জন্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ক্রয়ে বেশি তৎপর। তারা দরিদ্র-নিরীহ প্রতিবেশীদের সাহায্য-সহযোগিতা না করে বরং যুদ্ধ বাধাতেই বেশি আগ্রহী। অপরদিকে দরিদ্র প্রবাসী শ্রমিকদের কম বেতন দেওয়া, নিম্নমানের আবাসন, ছাঁটাই, গৃহকর্মীকে পাশবিক নির্যাতন করা ইত্যাদি যেন তাদের নিত্যসঙ্গী।

আমাদের দেশেও শত শত কোটিপতি মুসলমান আছেন। যারা বাহ্যিক ইবাদতে নিয়মিত; কিন্তু সুদ-ঘুসেরও চর্চা করেন অবিরত। এ বিত্তশালীদের অনেকেই জাকাত দিতে চান না। অনেকে সরকারি ট্যাক্স দিতে গিয়ে নানা কৌশল অবলম্বন করে বিরাট অঙ্কের টাকা ফাঁকি দেন। এত বড় সংখ্যক ধনীদের মধ্যে মাত্র ক’জন হাতেগোনা ভালো মানুষ জাকাত দেন! অন্যদের অবস্থা কোনো ভালো হিসাবেই মেলানো যাবে না। তারা সবাই ঠিকমতো ট্যাক্স এবং জাকাত দিলে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিদেশি কারও কাছে অর্থ ঋণের জন্য হাত পাতার প্রয়োজন হতো না।

আমাদের দেশে বিত্তশালী মানুষের সংখ্যা এবং জাকাত দেওয়ার উপযুক্ত মানুষের সংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তারা অনেকে নামে-বেনামে ব্যাংকে অথবা ট্যাক্স দেওয়ার ভয়ে বালিশের মধ্যে অর্থ লুকিয়ে রাখেন। তাদের কতজন জাকাত দেন? দিলেও কতজন সঠিক পরিমাণ হিসাব করে জাকাত আদায় করেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। দুর্নীতি, কপটতা, কৃপণতা, বখিলতা ইত্যাদি যেন এক শ্রেণির উঠতি বিত্তশালীদের মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতি বছর ঈদুল ফেতরের আগে যারা লোকদেখানোর জন্য সামান্য অর্থ বণ্টন করতে মাইক লাগিয়ে প্রচারণা করেন, যারা নিম্নমানের বস্ত্র কিনে বণ্টনের নামে ভিড় সৃষ্টি করে দুস্থ-অসহায় মানুষের প্রাণ কেড়ে নেন, তারা মুমিন হতে পারেন না। মুসলমান হিসাবে পরিচয় দিতে তাদের লজ্জা হওয়া উচিত। এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আগেভাগে সরকারি কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। লোকদেখানো জাকাত বণ্টন নিয়ে ভয়াবহ পদদলনে মৃত্যু বা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে ওঠে।

নামাজ ও জাকাত এক অপরের পরিপূরক। দু’টোই অবশ্য পালনীয় ইসলামী বিধান। এর দ্বারা সম্পদের পবিত্রতা আনয়ন ও দরিদ্রদের হক আদায় করা হয়। হজরত আলামা ইবনে মাসুদ বলেছেন- ‘কেউ জাকাত আদায় না করলে তার সালাত আদায় হবে না।’ পৃথিবীতে দুর্যোগ, রোগ-শোক, মহামারি ইত্যাদি সবসময় লেগেই আছে। হয়তো চিরদিন সেগুলো কোনো না কোনোভাবে হতেই থাকবে; আর এর নেতিবাচক প্রভাবে ধনীরা দরিদ্র হবে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী ধনী হতে থাকবে। দরিদ্র, দুঃস্থ ও নিরীহ মানুষ সাহায্য বা দান-খয়রাত না পেলে বেঁচে থাকবে কীভাবে? অথচ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে কল্যাণের কথা বলা হলেও দানের কথা নেই। ঋণের কথা ও সুদের মাধ্যমে ধার-দেনার কথা বিভিন্ন অর্থসূত্রে বলা হলেও শর্তবিহীন ও সুদবিহীন অর্থ সাহায্য করার কল্যাণকর পদ্ধতি হলো জাকাত। এটি যেহেতু গ্রহীতার জন্য ফেরত প্রদানের শর্তে আবদ্ধ নয়, সেহেতেু এখানে দেউলিয়া হয়ে পথে বসার কোনো ঝুঁকি নেই। সুতরাং যে কোনো বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেও জাকাতের অর্থ শুধু কল্যাণই নিশ্চিত করতে পারে।

তবে জাকাতের অর্থ খেয়ে সাবাড় করার পর পুনরায় হাত পাতার মনোভাব পরিহার করতে হবে। জাকাত গ্রহণের মাধ্যমে একজন গ্রহীতা যেন তার নিজস্ব সম্পদ বৃদ্ধি করতে পারে এমন কর্মসূচি থাকা দরকার। এজন্য দেশের দরিদ্রদের মোট সংখ্যা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে দৈহিক ও মানসিক অবস্থা যাচাই করে শ্রেণি বিভাগ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে জাকাত দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। অভাবী মানুষকে যেনতেনভাবে না ঠকিয়ে মানসম্মত বস্ত্র, পরিমাণমতো দ্রব্য ও অর্থ সাহায্য করতে হবে; যাতে এটি গ্রহণের মাধ্যমে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে ও ফি বছর সাহায্যের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ধরনা না দেয়।

এজন্য সমাজের সচেতন সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এক ভিখারির ভিক্ষার পরিবর্তে ছাই চাওয়ার গল্প অনেকেই হয়তো জানেন। তবুও বলছি- এক ভিখারি ধনী গৃহস্থ বাড়িতে ভিক্ষা চাইতে গেলে তাকে গৃহিণী বারবার নানা অজুহাতে খালি হাতে ফিরিয়ে দিত। একদিন ভিখারি বলল- আজও ফেরালেন মা। আজ ভিক্ষা না দেওয়ার কারণটা কি জানতে পারি? গৃহিণী নিজের অতি ব্যস্ততা দেখিয়ে ‘চুলার ছাই ফেলতে বাইরে যাচ্ছে’ বলে কড়া স্বরে উত্তর দিল। একথা শুনে ভিখারি বলেছিল, আমাকে ভিক্ষার পরিবর্তে একমুঠো ছাই দিন মা। ভিখারির আবদারে গৃহিণী আশ্চর্য হয়ে বলল- ছাই দিয়ে কী হবে তোমার! ভিখারি উত্তরে বলেছিল, আমাকে ছাই দিতে দিতে মহান আল্লাহ আপনাকে হয়তো কিছু দান করার অভ্যাস সৃষ্টি করে দিবেন মা। আর তাতে হাত খুলে গিয়ে একদিন প্রাণ খুলে ভিক্ষা দিতে পারবেন মা। নিজের ভুল বুঝতে পেরে গৃহিণী লজ্জা পেয়ে সেদিন থেকে সব ভিখারিকে ভিক্ষা দেওয়া শুরু করেছিল। আমাদের সমাজে অনেক বিত্তশালী; কিন্তু ভীষণ কৃপণ ও বখিল লোকদের জন্য এ গল্পটি নিঃসন্দেহে শিক্ষণীয় উদাহরণ।

এভাবেই হাত খুলুক সবার। কৃপণতা ও কপটতা যেন কারও মনের মধ্যে ধোঁকা দিতে না পারে, সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে সব মুমিন মুসলমানকে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গজলের মতো তাই আজ বলতে ইচ্ছে করছে- ‘দে জাকাত দে জাকাত। দিল খুলবে পরে তোর আগে খুলুক হাত।’

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান

fakrul@ru.ac.bd

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম