
প্রিন্ট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩২ এএম

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
পৃথিবীতে পাঠিয়ে মহান আল্লাহ মানুষকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে চলেছেন। কাউকে ক্ষমতা দিয়ে, কাউকে ধনসম্পদ দিয়ে তাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে। আবার কাউকেবা দারিদ্র্যের কশাঘাতে ফেলেও ইমানি পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে। আর ফেরেস্তাকুলের মাধ্যমে সব বান্দার কর্মফল মহান আল্লাহর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এবং এসব ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই রোজ হাশরের ময়দানে মানবসমাজ শেষ বিচারের সম্মুখীন হবেন। মহান আল্লাহ সেদিন সবার আমলনামা দেখে যার যার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবেন। আর এভাবে কেউ জান্নাতে যাবেন আবার কেউবা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবেন। আমরা মুসলমানরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এ ধারণায় বিশ্বাসী। এজন্য আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ ইসলাম ধর্মের সব নিয়মাচার পালন করি। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে হৃদয়ে ধারণ করি।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, এই ইসলামি বিশ্বেই ফেতনা-ফ্যাসাদ বেশি! ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক অনাচার, মানুষের ওপর জুলুম-অত্যাচার, একনায়কতন্ত্র- সবকিছুই মুসলিম বিশ্বে সমধিক! সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। ক্ষমতা লাভের বা ধরে রাখার জন্য ওইসব দেশে সব ধরনের অমানবিকতা, অত্যাচার, জুলুম চালানো হচ্ছে। এমনকি বছরের পর বছর পার করেও তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। ওইসব দেশের নারী ও শিশুসহ সবাই নিরাপত্তাহীনভাবে জীবনযাপন করে চলেছেন। সিরিয়ার নির্যাতিত পরিবারের যুদ্ধাহত একটি শিশু এই সেদিন মৃত্যুর আগে বলে গেল, ‘তোমাদের অন্যায়-অত্যাচার, নির্যাতন, দুষ্কর্মের কথা আমি আল্লাহর কাছে গিয়ে বলে দেব!’ তার মুখে উচ্চারিত সে কথাটি টক অব দ্য ওয়ার্ল্ডে পরিণত হলেও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিন্দুমাত্র এর প্রভাব পড়েনি। বরং দিনের পর দিন সেখানে লাশের সংখ্যা বাড়ছে। সারা দেশ একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। নিহতদের পরিবার-পরিজনের আর্তনাদে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হচ্ছে। তবু ক্ষমতা দখল ও ধরে রাখার যুদ্ধ সেখানে অব্যাহত রয়েছে।
অন্য আরও দু-একটি মুসলিম রাষ্ট্রের উদাহরণ তুলে ধরে লেখাটি ভারি করে তুলতে চাই না। কারণ কোনো মুসলিম রাষ্ট্রকে খাটো করে দেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য হলো, ইসলাম ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ভেতরে যেসব ফেতনা-ফ্যাসাদ, বিবাদ-বিসম্বাদ, লোভ-লালসা- সেসব বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা। আর সেজন্য আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ নিয়েও এ বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অঞ্চল, যা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ। প্রাচীন রোমান ও গ্রিকদের কাছে এ অঞ্চল গঙ্গারিডি নামে পরিচিত ছিল। হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাসসমৃদ্ধ এ দেশটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও শক্তি দ্বারা শাসিত হয়েছে। পাল সাম্রাজ্য, সেন সাম্রাজ্যের পর মধ্যযুগীয় বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটে। দিল্লি সালতানাত এবং শাহি বাংলার সুলতানদের সময় ইউরোপীয়রা বাংলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ হিসাবে গণ্য করত। এরপর বাংলা মুঘলদের অধিকারে চলে আসে। মুঘল আমলে বাংলা ছিল সবচেয়ে সম্পদশালী প্রদেশ। সে সময়ে সুবাহ বাংলা সমগ্র মুঘল সাম্রাজের শতকরা ৫০ ভাগ জিডিপির জোগান দিত। ক্রমে ক্রমে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে মারাঠা আক্রমণের পর বাংলায় প্রায় স্বাধীন নবাবদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর বাংলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে চলে যায়। অতঃপর খণ্ডিত আকারে বাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ এবং তারপর ১৯৭১ সালে তা স্বাধীন বাংলাদেশ রূপে আত্মপ্রকাশ করে।
এই বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি, আমার মাতৃভূমি। ব্রিটিশ আমলে আমার মা-বাবা এবং পাকিস্তান আমলে আমরা স্বামী-স্ত্রী এই বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আবার, স্বাধীন বাংলাদেশে আমার পুত্রকন্যারা জন্মগ্রহণ করেছে। সুতরাং এই বাংলা আমার। এ বাংলাকে নিয়ে আমার অনেক অহঙ্কার। আমার বাবার মুখে শুনেছি, স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করে তাদের তাড়িয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অনেক প্রাণের বিনিময়ে ব্রিটিশদের তাড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের বন্দুকের নল থেকে বাঁচতে আমার বাবাকে বনে-জঙ্গলে রাত কাটাতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের একদিন শেষরাতে চুপি চুপি যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে রওয়ানা হচ্ছিলাম, তখন আমার বাবার হাতে ধরা পড়লে তিনি আমাকে বলেছিলেন, যাচ্ছ যাও, কিন্তু মনে রেখ, স্বাধীনতার জন্য একসময় তোমার বাবাকেও বনে-জঙ্গলে, গাছে উঠে রাত কাটাতে হয়েছে! এ কথার মাধ্যমে সেদিন তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন, ওই বয়সে তা বুঝিনি বা এখনো বুঝি কিনা জানি না। তবে এ বয়সে এটুকু বুঝি যে, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে আমরা যারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে সম্মানিত, তেমনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামীদেরও সম্মান প্রাপ্য। কারণ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জিত না হলে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না। যাক সে কথা, এবারে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। তারপর তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশটি গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু তার নিজ দলের এবং তার খুব কাছের কিছু লোকজনই সে প্রচেষ্টা সফল হতে দেননি! ক্ষমতার লোভে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খন্দকার মোশতাকগং অত্যন্ত জঘন্য ও নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র করে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে প্রমাণ করেন তিনি কতটা বিশ্বাসঘাতক হতে পারেন!
খন্দকার মোশতাক ছাড়াও বঙ্গবন্ধু অন্য যাদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করেছিলেন! রিলিফের চাল, গম, ঢেউটিন, কম্বল ইত্যাদি চুরি করে বঙ্গবন্ধু সরকারের জনপ্রিয়তা ধ্বংস করে সদ্য স্বাধীন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ধ্বংস করেছিলেন! এ বিষয়ে আরও কিছু বলার থাকলেও লেখাটি দীর্ঘায়িত না করে দেশের বর্তমান অবস্থার কিছু কথা বলে শেষ করতে চাই।
বর্তমানে দেশের শাসনভার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর অর্পিত। তিনি সুষ্ঠুভাবে তার দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে চলেছেন। দেশের মানুষের সেবক হিসাবে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যাকেও অন্য অনেকের হাতে বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করতে হয়েছে। কিন্তু অতীত-বর্তমান মিলিয়ে তিনি যাদের হাতে এসব দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন, তারা সবাই নিষ্ঠা, সততা ও সক্ষমতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন কিনা, সে প্রশ্নটি বোধহয় করাই যায়। কারণ এ সময়ে ব্যাংকের টাকা হরিলুট, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান অবস্থায়ও অনেক এমপি-মন্ত্রীর খামখেয়ালি, দুর্নীতির কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলেও সরকারকে এ বিষয়ে নির্বিকার বলেই মনে হচ্ছে! মনে করা হচ্ছে যেন সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে! আসলে কিন্তু তা নয়। হিন্দু মহিলাদের নাম পর্যন্ত রাজাকারের তালিকাভুক্ত করে, এমনকি গোলাম আরিফ টিপুকে রাজাকার বানিয়ে আন্দোলনের মুখে তা প্রত্যাহার করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নামে বছরের পর বছর ধরে যা করা হচ্ছে, নতুন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির নামে যা করা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রয়োজনীয় সাক্ষীসাবুদ, সরকারি দলিলপত্র থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত এবং মন্ত্রণালয়ের ইস্যুকৃত সার্কুলার অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সব সনদ থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের যে কাজটি করা হচ্ছে, তা সঠিক কিনা সে বিষয়টি সময়ই বলে দেবে। কারণ, এমন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাদের জন্য যুদ্ধকালীন সহযোদ্ধারা সাক্ষী দিয়েছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সনদসহ মন্ত্রণালয়ের চাহিদাপত্র অনুযায়ী সঠিকভাবে সবকিছু আছে, সেসব মুক্তিযোদ্ধাকেও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কারণে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে! অথচ এসব ঘটনা যেন দেখার কেউ নেই। আমরা কেউ এসব নিয়ে লিখলেও তা কেউ পড়েন বলেও মনে হয় না। এ অবস্থায় সময়মতো মুক্তিযোদ্ধা তালিকারও যে পরিবর্তন হবে সেটিও নিশ্চিত! কারণ খন্দকার মোশতাকের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব না হলেও খামখেয়ালি করে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে!
পরিশেষে বলতে চাই, দেশের বর্তমান অবস্থায় অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি খামখেয়ালিপূর্ণ কাজকর্ম করলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেসবের অনেক কিছুই জানেন না। অথচ ওই শ্রেণির মন্ত্রী-এমপির কারণে অতীতে অনেক সরকারকেই খেসারত দিতে হয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। ইতিহাস কিন্তু এ ধরনের অন্যায় আচরণ ক্ষমা করে না। আর মহান আল্লাহও এসব বরদাস্ত করেন না। অতএব, সাধু সাবধান!
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট