মোবাইলে আর্থিক সেবা : গ্রাহক স্বার্থসংরক্ষণ জরুরি

মো. আবুল কাসেম
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডাক বিভাগের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’ নিয়ে সম্প্রতি এক সংবাদপত্রের করা একটি প্রতিবেদন আমার দৃষ্টিতে এসেছে। তা ছাড়া মোবাইলে আর্থিক সেবা দেওয়া আরও কোম্পানি নিয়েও এখন কথা হচ্ছে।
এসব বিষয় নিয়ে যেহেতু আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এ বিষয়ে কিছু লেখার প্রয়াস এটি। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য সার্বিকভাবে মোবাইল আর্থিক সেবা বা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থার সামগ্রিক বিশ্লেষণ করা এবং জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা।
এক্ষেত্রে আমার মনে হয়, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ক্ষেত্রে কীভাবে গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষা হয়, সেটিই সবার দেখা দরকার। সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা কী হওয়া উচিত-সে বিষয়টিতে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেওয়া দরকার।
প্রথমে বলে নিই, মোবাইলে আর্থিক সেবা একটি সম্পূর্ণ প্রযুক্তিগত লেনদেন ব্যবস্থা, বিশ্বব্যাপী যার যাত্রা শুরু হয়েছে জনগণের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। প্রচলিত আর্থিক বা ব্যাংকিং সেবা যেখানে গণমানুষের চাহিদা যথাযথভাবে পূরণে সক্ষম হয়নি, সেখানেই ফিনটেকের যাত্রা শুরু হয়েছে। এজন্যই সম্ভবত ফিনটেকের অপর নাম ডিজরাপটিভ সেবা, যা বিদ্যমান অচলায়তন ভেঙে মানুষের জন্য আর্থিক ক্ষেত্রে লাগসই সুবিধার প্রবর্তন করে।
আমরা যদি বিশ্বব্যাপী মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কিছু কেস স্টাডি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় নীতিমালা, বিধিবিধান তৈরি হওয়ার আগেই সেবা চালু হয়ে গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বাজারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বা সেবাপ্রদানকারী অপারেটরের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নীতিমালা তৈরি হয়েছে; যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়।
পরবর্তী সময়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নীতিমালাকে আরও জনবান্ধব করা হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিংসংক্রান্ত নীতিমালা বিশ্বজুড়েই আসলে ডায়নামিক এবং মার্কেটের চাহিদার ভিত্তিতে পরিবর্তনশীল।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সর্বপ্রথম ২০০০ সালে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস শুরু হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনে। শুরুতেই সার্ভিসটির যথাযথ নীতিমালা না থাকায় ২০০১ সালে মানি লন্ডারিং ও টেররিস্ট ফাইন্যান্সিং প্রতিরোধবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) ফিলিপাইনকে কালো তালিকাভুক্ত করে।
পরে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন এবং সে অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ২০০৫ সালে ফিলিপাইন এফএটিএফের কালো তালিকা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। একইভাবে কেনিয়ার এমপিসা এবং আমাদের দেশের বিকাশের কথা বলা যায়। এরাও কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালা চালুর আগেই ব্যবসা শুরু করেছে।
এখানে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস একটি নম্বর গেম। এ ব্যবসায় সফল হওয়া বা অন্তত টিকে থাকার অন্যতম কৌশল হলো দ্রুততম সময়ে একটি বিশালসংখ্যক গ্রাহককে সেবার সঙ্গে যুক্ত করা। এ সংখ্যাটি দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যাটি দু-তিন কোটি বলেই আমার অনুমান।
আবার ফিলিপাইন বা কেনিয়ায় এটি ৫০ লাখ বা এক কোটি হলেও হয়তো চলে। আর রেগুলেশন বা কঠোর বিধিনিষেধের বেড়াজালে উপর্যুক্তসংখ্যক গ্রাহক বেজ তৈরি করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এজন্যই যেসব দেশে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এখনো টিকে আছে, তারা রেগুলেশনের ফাঁকফোকরের সুবিধা নিয়েই টিকে আছে, অন্যরা মৃতপ্রায়।
বাংলাদেশেও আমরা দেখতে পাই, এ পর্যন্ত ১৬টি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও কিছুদিন আগ পর্যন্ত মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান একচ্ছত্র ব্যবসা করেছে।
একটি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা প্রতিষ্ঠান বাজারে থাকলে মনোপলির কারণে তার সার্ভিস চার্জ অত্যন্ত উচ্চ হয়। এ কারণে আমরা দেখছি কেনিয়ায় এক ডলারের লেনদেনেও এমপিসা প্রায় ৩০ সেন্ট চার্জ করে। বাজারের ৯০ শতাংশ তাদের দখলে থাকার কারণে সেদেশে গ্রাহকরা অসহায় হয়ে অতি উচ্চমূল্যের সেবা নিতে একরকম বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কি এর চেয়ে ভিন্ন কিছু? শুরু থেকেই একটি প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে বাজারের সিংহভাগ। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে তাদের বড় ভূমিকা আছে সেটি ঠিক, তবে বাজারটাকে তারা তাদের একচ্ছত্র করে নিয়েছে।
এ কথা বলতে আমার একটুও দ্বিধা হচ্ছে না, সেবার মূল্যের ক্ষেত্রেও তাদের আচরণ মনোপলিস্টিক; যার ফলে সার্বিকভাবে দেশের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে। বাজারকে আমরা যে প্রতিযোগিতামূলক করতে পারিনি এর দায় আমাদের সবাইকে নিতে হবে।
তবে সম্প্রতি সরকারের ডাক বিভাগের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘নগদ’ কিছুটা হলেও এ মনোপলির বেড়াজাল ছিন্ন করতে পেরেছে বলে আমার ধারণা। ইতোমধ্যে তারা কিছু সেবার মূল্য কমিয়েছে। আবার কিছু সেবার মূল্য ফ্রি করে দিয়েছে। ক্যাশআউট চার্জও অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে হাজারে ৯ টাকা ৯৯ পয়সায় নিয়ে এসেছে ‘নগদ’।
তা ছাড়া নগদ তাদের সার্ভিস চালুর পর থেকেই গ্রাহকদের ওয়ালেট স্থিতির ওপর সুদ দিয়ে আসছে। এতে উপকার হয়েছে গ্রাহকের।
আমাদের দেশের মোবাইল কলরেটের বিষয়টি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। সিটিসেল তখন প্রতি মিনিট ১৫ টাকা করে রেট চার্জ নিত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে মোবাইল ফোনের ব্যবসা উন্মুক্ত করে এবং গ্রামীণফোন, একটেল (পরে নাম বদলে রবি), সেবা (পরে নাম ও মালিকানা বদলে বাংলালিংক) লাইসেন্স পায়। কিন্তু সরকার যাতে আর কাউকে লাইসেন্স না দিতে পারে, সেজন্য সিটিসেল আদালত পর্যন্ত গিয়েছে।
টেলিটক ও এয়ারটেল আসে আরও পরে। শুরুতে গ্রামীণফোন, একটেল ও সেবাও প্রতি মিনিটে সাত টাকা করে চার্জ করত। এখন কলরেট ৫০ পয়সায় এসে দাঁড়িয়েছে শুধু মনোপলি ভেঙে দেওয়ার কারণে। আমরা মনে করি, মোবাইলে লেনদেনের বিষয়টি মনোপলি থেকে মুক্তি পেলে অবশ্যই গ্রাহকের তথা সাধারণ মানুষের সুবিধা হবে। এতে মোবাইলে লেনদেন অবশ্যই বাড়বে, বৃদ্ধি পাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিও।
সুতরাং নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর গ্রাহক স্বার্থের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। আর সেটি করতে গিয়ে যদি অন্য অপারেটরগুলোকে খানিকটা সহযোগিতা করতে হয়, তবে সেটি করতে হবে। শুধু নিজেদের সীমাবদ্ধতার দোহাই দিলে হবে না; দেশের যে প্রতিযোগিতা আইন আছে, সেটিও কিন্তু বিবেচনায় রাখতে হবে।
‘নগদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ডাক বিভাগের রেগুলেশন্সের আওতায়। এটিও একটি সরকারি বিভাগ, সেটি ভুললে চলবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব ধরনের রেগুলেশন মেনে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসসংক্রান্ত লাইসেন্সের আবেদন তারা করেছে এবং ইতোমধ্যে অনাপত্তিপত্র পেয়েছে। পূর্ণাঙ্গ লাইসেন্সিংও পেয়ে যাবে বলেই জানি। ‘নগদ’ বা ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
সব মিলিয়ে গ্রাহকের স্বার্থে ও বাজার প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে নগদকে রেগুলেশনের আওতায় এনে লাইসেন্স প্রদান করাটাই জরুরি। এক্ষেত্রে আরও দুটি বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে-এক. বাজারে ‘নগদ’ চালুর ফলে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
দুই. সরকারও এ খাত থেকে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব পাচ্ছে। সুতরাং উত্তরোত্তর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সরকারের রাজস্ব আয়ের বিষয়টিও সবাইকে মাথায় নিতে হবে।
আর সবকিছুর উপরে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে দেশের আর্থিক অগ্রগতিতে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই আন্তঃসংযোগ বা ইন্টার-অপারেবিলিটি চালু করতে হবে। সেটি হলে এক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা সহজেই অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করতে পারবেন। চিন্তা করেন তো একবার, যদি এক অপারেটরের মোবাইল থেকে অন্য অপারেটরে কল করা না যায়; শুধুই নিজেদের অপারেটরের মধ্যে কল করার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে পরিস্থিতিটা কী দাঁড়ায়?
গ্রাহকের বাড়তি খরচ ছাড়াই যেমন গ্রাহককে এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে কল করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, এখানেও তাই করতে হবে। বাড়তি খরচ ছাড়াই এক এমএফএস থেকে আরেক এমএফএসে লেনদেনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইন্টার-অপারেবিলিটি চালু করার একাধিক নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। আবার এমনভাবে তারা কাজটা করতে চেয়েছে, ছোট-বড় সবাই যার বিরোধিতা করেছে।
এতে করে বড় অপারেটরের একচ্ছত্র আধিপত্য সুনিশ্চিত হয়েছে। আমি নিশ্চিত করে বলছি, কার্যকর ইন্টার-অপারেবিলিটি চালু হলে বাজারে প্রতিযোগিতা অনেক বাড়বে, সেবার মান বাড়বে এবং মনোপলি নিরুৎসাহিত হবে। তাতে আখেরে লাভ হবে গ্রাহকের এবং সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির। সুতরাং, প্রতিযোগিতার স্বার্থেই যত দ্রুত সম্ভব ‘নগদ’কে সমুদয় লাইসেন্স দিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা আবশ্যক।
মো. আবুল কাসেম : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর