পূর্ব বাংলার নিষ্পেষিত মানুষের দিশারি,
মানবতাপ্রেমী,
বাঙালি
জাতীয়তাবাদের কবি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা-স্থপতি, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন আপন ভূমে আপন দেশের মুক্ত মাটিতে পা রেখেছিলেন হতভাগ্য জাতিকে বাঁচাবেন বলে, শত্রুমুক্ত দেশকে বিশ্বের আসরে মর্যাদার আসনে বসাবেন বলে, আর সর্বোপরি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে বসবাসযোগ্য করে তুলবেন বলে। হানাদারদের কয়েদখানা থেকে প্রায় নয় মাস বন্দি থাকার পর সারা জীবন ধরে যে মানুষগুলোকে ভালোবেসেছিলেন তাদের মাঝে পাকিস্তানের কয়েদখানার সামনে খুঁড়ে রাখা কবরের কিনারা থেকে ফিরে এলেন সেদিন, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর মেঘমুক্ত শীতের রোদেলা বিকালে। হাজারও-লাখো আবেগাপ্লুত জনমানুষের দিগন্তবিদারী ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির সুমধুর আবহে তিনি শুধু অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়েছিলেন আর অবিরল অশ্রুধারায় বুক ভাসিয়েছেন। তার সঙ্গে বুক ভাসিয়েছে লাখো জনতা তাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে।
বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান। কয়েক ঘণ্টা লাগিয়ে এ পথটুকু পার হয়ে গাড়িবহর যখন থামল সেই ময়দানে, লাখো লাখো মুক্ত বাঙালি, মুক্তিসেনা হাত উঁচিয়ে গর্জে উঠল জয় বাংলা স্লোগানে, যে স্লোগান তাদের শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে। নৃত্যরত হাতগুলোকে সম্বোধন জানিয়ে তিনি আবেগে ভাসলেন, কম্পিত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন : ‘গত ৭ মার্চ এ ঘোড়দৌড়ের ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আপনারা বাংলার মানুষ সেই স্বাধীনতা এনেছেন। আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই একতা বজায় রাখুন, ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালিও প্রাণ থাকতে এ স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নেই।’
এদিন থেকেই শুরু হলো তার স্বাধীন দেশে পথচলা। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের দায়িত্ব কাঁধে নিলেন। শূন্য দেশ। নেই রাস্তাঘাট, নেই চলাচলের বাহন, নেই খাবার সাড়ে সাত কোটি মানুষের, পৌষের তীব্র শীতে নেই গায়ে দেওয়ার বস্ত্র, ব্যবসা নেই, বাণিজ্য নেই, চাষের গরু নেই, বীজ নেই, সার নেই। চারদিকে শুধু নেই নেই। এ নেই নেই-এর মধ্যেই জাত বীরের মতো হাতে তুলে নিলেন দেশ চালানোর দায়িত্ব। পরদিন থেকেই নেমে পড়লেন কাজে। জানতেন, সামনে শুধু কাজ আর কাজ। করতে হবে সব দ্রুত। বাঁচাতে হবে মানুষকে। থেমে থাকার কোনো জো নেই। চলতে হবে অনবরত, অবিরত; চোখ রাখতে হবে শুধু সামনের দিকে। গড়ে তুলতে হবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে, সাহস জোগাতে হবে দিশেহারা মানুষগুলোর মনে।
শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর আরেকটি যুদ্ধ, সবকিছু পুনর্গঠনের যুদ্ধ, দেশ গড়ার যুদ্ধ, বেঁচে থাকা মানুষদের নিয়ে টিকে থাকার যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ। দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশসেবা করার মানসিকতা যিনি পোষণ করেছেন সারা জীবন, সেই তিনিই স্বদেশে ফিরে এসেই দেশপ্রেমিকের দৃষ্টিটি বিস্তৃত করে দিলেন ভবিষ্যতের দিকে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বহুমুখী ষড়যন্ত্রের মধ্যে ডুবে থেকেও তিনি এক এক করে হাত দিলেন বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কারের কাজে। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন; এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু পুরোপুরি বিপর্যস্ত দেশকে অভাবনীয় দক্ষতার সঙ্গে পুনর্গঠন করেন।
প্রথম সংস্কারমূলক প্রয়াস কৃষি খাতে। বিপুল জনগোষ্ঠী জড়িত যে কৃষি খাতে, সেটিতে সংস্কারের লক্ষ্যে কৃষকের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জামির খাজনা মওকুফসহ ব্যক্তিমালিকানায় পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেন। এছাড়া তার স্বল্পকালীন প্রশাসনিক আমলে তিরিশ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ, কৃষকের মধ্যে এক লাখ আশি হাজার গাভি বিতরণ এবং চল্লিশ হাজার পাম্পের ব্যবস্থাকরণ, ভারতের সঙ্গে আলোচনাক্রমে শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীতে চুয়ান্ন হাজার কিউসেক পানির নিশ্চয়তা লাভসহ গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প চালু করার মতো অভাবনীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়। অবিশ্বাস্য কম সময়ের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান তৈরি করেছেন তিনি, পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নিয়ে বাস্তবায়ন শুরু করেছেন এবং সংবিধানের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে জবাবদিহির বোধ তৈরি করেছেন। এমনকি, আইনের শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে এক বছর সময়ের মধ্যে প্রায় দেড়শ আইন প্রণয়ন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
কালোটাকার মালিকরা ক্ষিপ্ত হবে আর মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা অভিশাপ দেবে, এটা জানা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু একশ টাকার নোট অচল ঘোষণা করেছিলেন মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমিয়ে জনমানুষকে স্বস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে। তিনি ফিরে আসতে না পারলে হয়তো এত কম সময়ের মধ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) তৈরি হতো না। এ পরিকল্পনাতেই তিনি পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান হিসেবে দেশের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা এবং উন্নয়নে প্রাধিকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তার স্বপ্নের বিষয়গুলো তিনি লিখে দিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশের এ মূল্যবান দলিলটিতে : দারিদ্র্য হ্রাসের লক্ষ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, জাতীয় আয় বৃদ্ধি, সমতাভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিতকরণ, কৃষি শিল্পের পুনর্গঠন, উৎপাদন বৃদ্ধি, উন্নয়নমুখী স্থানীয় সরকার-কাঠামো শক্তিশালীকরণ, অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ সমাবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট বৃদ্ধি আর সামাজিক চেতনা বিকাশ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করাসহ বহুবিধ জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ। এমনিভাবে তিনি স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ উন্নয়ন লক্ষ্য আর কৌশল নির্ধারণ করে দেন। ফিরে আসার দেড় বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সরকারি কর্মচারীদের জন্য বেতন কমিশন গঠনসহ দশ স্তরবিশিষ্ট বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করেন, শ্রমিকদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করেন, চারটি সেক্টর করপোরেশন আর তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক গঠন করেন, সারা দেশে ধ্বংসপ্রাপ্ত সব ব্রিজ আর সেতুর নির্মাণ সমাপ্ত করাসহ ৯৭টি নতুন সড়ক সেতু নির্মাণ করেন। আর এভাবে অর্থনেতিক পুনর্গঠন নিশ্চিত করার ফলে তার শাসনামলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাত শতাংশের বেশি অর্জিত হয়।
তিনি ফিরে না এলে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হতো না; ৩৭ হাজার প্রাথমিক স্কুলও সরকারীকরণের আওতাভুক্ত হতো না; ১১ হাজার প্রাথমিক স্কুল নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো না; এক লাখ পঁয়ষট্টি হাজার প্রাথমিক শিক্ষকও সরকারি হতে পারতেন না; রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রায় শূন্য থাকা সত্ত্বেও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক পেত না কিংবা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষিত হতো না; দেশের সব শিক্ষক নয় মাসের বকেয়া বেতন পেতেন না; নয়শ কলেজ ভবন আর চারশ মাধ্যমিক স্কুলভবন পুনর্নির্মিত হতো না; এমনকি মাত্র পাঁচ মাস সময়ের মধ্যে যুগান্তকারী ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনও গঠিত হতো না। সব শ্রেণির মানুষের সন্তানসন্ততিদের প্রাইমারি শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার মতো গণমুখী উদ্যোগ আমরা দেখতে পেতাম না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কী, তা দেশবাসী বুঝতেই পারত না। বঙ্গবন্ধুই তখনকার ৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে কালাকানুনের রাহুগ্রাস থেকে বের করে এনে ৭৩ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠনের অনুমোদন দিয়েছেন এবং শিক্ষকতা পেশার একজনকে শিক্ষা সচিব হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার মতো নজিরবিহীন কাজ করেছেন। এর আগে শিক্ষার টেকসই উন্নয়নের ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামায়নি। বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য, (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’- ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে এমন রূপকল্প অন্তর্ভুক্ত করা একমাত্র তার মতো মহামানব উপস্থিত থাকার কারণেই সম্ভব হয়েছে।
তিনি যদি নেতৃত্বে না থাকতেন, তাহলে কি ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি শরণার্থী দেশে এসে এত অল্প সময়ে পুনর্বাসিত হতে পারতেন? আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর রাজাকার-দালালের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত তেতাল্লিশ লাখ বাসগৃহ নির্মাণের ব্যবস্থা কেউ করতে পারত কি? তিনি না থাকলে মাত্র আড়াই বছরের মাথায় চুয়াত্তর সালের জুনে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে প্রথম আদমশুমারি সম্পন্ন করার মতো দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করে দিত কে? কে দুই মাস সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতের সোয়া লাখ সেনাকে ভারতে ফেরত পাঠাতে পারত কিংবা কিংবা কয়েক মাস ধরে ভারতীয় সেনাসহ আত্মসমর্পণকৃত ৯০ হাজার হানাদার সেনা আর গ্রেফতারকৃত ৩৭ হাজার রাজাকার-দালালের খাদ্য সরবরাহ করতে পারত? বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বলেই এসব সম্ভব হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে তো বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল এককথায়-অসাধারণ। ১২১টি দেশের স্বীকৃতি আদায়সহ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করা ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি অনন্য অর্জন, যা পৃথিবীর কোনো নব্য-স্বাধীন দেশের পক্ষে সম্ভব হয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।
বাংলাদেশের যাত্রা শুরু বঙ্গবন্ধুর যেসব দিকনির্দেশনায়, সেসব নির্দেশনার ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, করোনা মহামারিতেও তারই সুযোগ্যকন্যার পরিশীলিত দূরদর্শী নেতৃত্বে। আরও এগিয়ে যাবে অনেক দূর, বহুদূর।
ড. এম এ মাননান : কলামিস্ট; উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়