করোনার টিকা : বাংলাদেশের করণীয়
ভ্যাকসিন কূটনীতি আরও জোরদার করতে হবে
ডা. শাহরিয়ার মোহাম্মদ রোজেন
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল একটি নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন। মূলত একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত আমরা নিশ্চিন্ত নই; যদিও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের বৈশ্বিক প্রচেষ্টা ঠিক কবে নাগাদ সফল হবে তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।
তবে এখন পর্যন্ত ৩৮টি ভ্যাকসিন বিভিন্ন ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে, যা আমাদের আশান্বিত করে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকা ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে শেষ ধাপ বা ফেজ-৩ ট্রায়ালে রয়েছে পাঁচটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির তৈরি ভ্যাকসিন- সেগুলো হল যুক্তরাজ্যের অ্যাস্ট্রাজেনেকা, রাশিয়ার গ্যামালিয়া, চীনের সিনোভ্যাক, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না এবং ফাইজার।
আবিষ্কার হওয়া মাত্রই কীভাবে দ্রুততার সঙ্গে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে, সে বিষয় নিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো বাংলাদেশও কাজ করছে। ইতোমধ্যে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। পাশাপাশি চীনের সিনোভ্যাক বাংলাদেশে ভ্যাকসিন ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের যে প্রচেষ্টা, তাতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকও রয়েছে এবং প্রাথমিক পরীক্ষায় তারা সফলতার দাবি করেছে।
কোভ্যাক্স গ্লোবাল ভ্যাকসিন ফ্যাসিলিটির আওতায় তালিকাভুক্ত ৯২টি নিু ও নিুমধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। কোভ্যাক্স ২০২১ সালের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত দেশগুলোর ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিন সরবরাহের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কাজেই, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রচেষ্টা যেমন চলছে, অন্যদিকে পর্দার অন্তরালে বিশ্বজুড়ে চলছে ভ্যাকসিন কূটনীতি, বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা এবং ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। ভ্যাকসিন দৌড়ে এগিয়ে থাকা পাঁচটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির সঙ্গে লাখ লাখ ডোজের ভ্যাকসিন কেনার আগাম চুক্তি করেছে ধনী দেশগুলো।
বেসরকারি সংস্থা অক্সফামের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কিছু ধনী দেশ (আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশ, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, ম্যাকাও, জাপান, সুইজারল্যান্ড) সম্ভাব্য করোনা ভ্যাকসিনের অর্ধেকেরও বেশি ডোজ কেনার আগাম চুক্তি সেরে ফেলেছে। অথচ জনসংখ্যার বিচারে সেসব দেশে পৃথিবীর মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষের বসবাস। ফলে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে তা ধনী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিহাস পর্যালোনা করলেও দেখা যায়, ২০০৯ সালে H1N1 মহামারীর সময় যেসব দেশে সংক্রমণ বেশি ছিল, তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পায়নি; বরং ধনী দেশগুলোই আগে টিকা পেয়েছিল।
অতএব, বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন কূটনীতি আরও জোরদার করতে হবে। ভ্যাকসিন দৌড়ে এগিয়ে থাকা বন্ধুপ্রতিম ভারত, রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, ট্রায়ালে সব ধাপ অতিক্রম করা প্রথম ভ্যাকসিনটি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য নাও পেতে পারে। এ কারণে সম্ভাব্য সব উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ ও ভ্যাকসিন সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
টিকা আমদানি ও বিতরণে সরকারি-বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেক্সিমকোর সঙ্গে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের চুক্তি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক একটি বিষয়; কিন্তু ওষুধ কোম্পানিটি যাতে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ভ্যাকসিন অনেক বেশি দামে বিক্রি করতে না পারে, সে বিষয়টি সরকারি নজরদারিতে রাখতে হবে। পাশাপাশি ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির আগেই বিতরণ এবং ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কৌশল (ভ্যাকসিন ডিপ্লয়মেন্ট প্ল্যান) চূড়ান্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রথমদিকে খুব সীমিত আকারে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে; এ কারণে কাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেয়া হবে, সে বিষয়টি আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্যাকসিন দেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মী, বয়স্ক এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অধিক সংক্রমিত অঞ্চলগুলোয় আগে ভ্যাকসিন দেয়া যেতে পারে। এছাড়া ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের (সিরিঞ্জ, অ্যালকোহল প্যাড) ব্যবস্থা আগে থেকেই নিশ্চিত করতে হবে।
জনগণের মধ্যে ভ্যাকসিন পৌঁছে দেয়ার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল টিকা সংরক্ষণে ‘কোল্ড চেইন’ কাঠামো। এখন যেসব টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে, সেগুলোর জন্য পৃথক তাপমাত্রার কোল্ড চেইন দরকার। চীনের ভ্যাকসিনসহ অন্য আরও কিছু ভ্যাকসিনের জন্য বিভিন্ন জেলার ইপিআই ভ্যাকসিন কোল্ড চেইন ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এ সীমিতসংখ্যক কোল্ড চেইন দিয়ে বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছানো যাবে না।
অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ও ফাইজারের ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য অনেক বেশি ঠাণ্ডা তাপমাত্রা (মাইনাস ডিগ্রি তাপমাত্রার-হিমশীতল তাপমাত্রা) লাগে এবং এত ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় বাংলাদেশের ভ্যাকসিন সংরক্ষণের সক্ষমতা খুবই সীমিত। ‘কোল্ড চেইন’ কাঠামো ঠিক করে না রাখলে টিকা অকার্যকর হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এ কারণে আমাদের ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও পরিবহনের সক্ষমতাও তৈরি করতে হবে।
কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে নিকট অতীতে পরিলক্ষিত পরিকল্পনার দুর্বলতা এবং সমন্বয়ের অভাব ভ্যাকসিন বিতরণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন আমাদের শঙ্কিত করে তুলে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ জোনিংয়ের পরিকল্পনা করলেও সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকদের মধ্যে পিপিই বিতরণ নিয়ে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অ্যন্টিজেন টেস্টিং বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতেও অনেক বিলম্ব হয়েছে। অতীতের এসব ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভ্যাকসিন বিতরণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে যথাযথ পরিকল্পনা এবং সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে- এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। একদিকে একাধিক উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ ও ভ্যাকসিন সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে; অন্যদিকে, ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির পর জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে যাতে অযাচিত বিলম্ব না হয়, সেজন্য অগ্রিম পরিকল্পনা এবং কৌশল চূড়ান্ত করতে হবে।
ডা. শাহরিয়ার মোহাম্মদ রোজেন : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র পলিসি বিশ্লেষক, আলবার্টা মিনিস্ট্রি অব হেলথ, কানাডা