মহামারীর সংক্রমণ বনাম গুজবের আক্রমণ
মনিরা নাজমী জাহান
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
সামাজিক মনোবিজ্ঞানী গর্ডন অলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যান যথার্থই বলেছেন, ‘প্রতিটি গুজবেরই শ্রোতা থাকে।’ একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি মহামারীর সময় গুজব এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে।
একটু সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে আমরা দেখব, একটি কুচক্রী মহল ইচ্ছাকৃতভাবে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠান কিংবা একটি দেশে অথবা সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ এবং ধ্বংস করার নিমিত্তে গুজব এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো সমাজে ছড়িয়ে থাকে।
সর্বপ্রথম যে বিষয়টি জানা প্রয়োজন তা হল গুজব কী? কোন বিষয়টিকে আমরা গুজব নামে অভিহিত করব? গর্ডন অলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যানের মতে গুজব বলতে সেসব বিশ্বাসকে বোঝায় যেসব বিশ্বাস কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও মানুষের কথার মাধ্যমে সমাজে বিস্তার লাভ করে।
তবে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ গুজব বিস্তারের মাধ্যমেও এসেছে পরিবর্তন। এখন মানুষের মুখে মুখে ছড়ানোর পরিবর্তে গুজবের মাধ্যম হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া।
এরপর যে বিষয়গুলো আমাদের জানা প্রয়োজন তা হল, এ গুজব বিষয়টি কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে সমাজে এমন ভয়ানক ধ্বংসলীলা চালাতে পারে? কী উদ্দেশ্য নিয়ে এ গুজব ছড়ানো হয়?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের আলোকপাত করতে হবে পৃথিবীতে বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী কর্তৃক প্রণীত গবেষণাগুলোর দিকে।
মনোবিজ্ঞানী যমুনা প্রসাদ উত্তর ভারতে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ার গুজবের বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণা শেষে মনোবিজ্ঞানী যমুনা প্রসাদ গুজবের উৎপত্তি ও সংক্রমণের বিষয়ে সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন।
সেই তত্ত্বে তিনি গুজবের ৫টি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন, বৈশিষ্ট্যগুলো সমাজকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
তিনি এ ৫টি বৈশিষ্ট্যর কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন- ১. গুজবটি অবশ্যই অনেককে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করবে। ২. গুজবটি একেবারেই অপরিচিত ঘটনা দ্বারা সৃষ্ট হবে।
৩. গুজবে যে ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত দেখানো হবে তার অনেক বিষয় অজানা রাখা হবে ৪. এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হবে যা যাচাইযোগ্য নয়। ৫. কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য গুজবটি সমাজে ছড়ানো হবে।
আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে দেখব এ করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে যেসব গুজব ছড়ানো হয়েছে সেই গুজবগুলোর মধ্যেও উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান।
মনোবিজ্ঞানী রবার্ট এইচ ন্যাপ তার ‘সাইকোলজি অব রিউমার’ নামক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, গুজবকে কেন ছড়ানো হয় অথবা গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী? তিনি ভ্রান্ত আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছড়ানো গুজবকে ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন।
প্রথমটি হচ্ছে ‘পাইপ ড্রিম রিউমার’ অর্থাৎ যে শ্রেণির গুজব মূলত ছড়ানো হয় ভালো কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে। এ শ্রেণির গুজবে গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি চান গুজবটি যেন সত্য হয়। কারণ এ ধরনের গুজব ছড়ানোর পেছনে থাকে ভালো কোনো উদ্দেশ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমান সময়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, থানকুনি পাতা খেলে করোনাভাইরাস মারা যায় তাই বাংলাদেশে করোনাভাইরাস হওয়ার সম্ভাবনা কম।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ‘বুগি রিউমার’ যেটি ছড়ানো হয় সমাজে আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্দেশ্যে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাস নিয়ে অডিও ক্লিপের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের গুজব ছড়ানোর দায়ে ইফতেখার মোহাম্মদ আদনানকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
সর্বশেষ প্রকার হচ্ছে ‘ওয়েজ ড্রাইভিং এগ্রেশন রিউমার’। মূলত এ ধরনের গুজব ছড়ানো হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে।
একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি মহামারী এবং বিপর্যয়ের সময় এ ধরনের গুজব ছড়ানো হয় এবং প্রতিটি মহামারীতে ছড়ানো গুজবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রায় একই ধরনের।
যেসব কারণে মহামারীর সময়ে গুজব ছড়ানো হয় তার মধ্যে রয়েছে নিজেকে জাহির করার মানসিকতা অর্থাৎ যে বা যিনি গুজব ছড়ান, তার উদ্দেশ্য থাকে সমাজের কাছে জাহির করা যে তার কাছে এমন তথ্য আছে যার নাগাল চাইলেও কেউ পেতে পারবে না ।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে ইউটিউবার ডানা অ্যাশলি তার পোস্ট করা ভিডিও মাধ্যমে এ গুজব ছড়ান যে, চীনের উহান শহরে ৫এ মোবাইল প্রযুক্তি চালুর কারণে করোনা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য লক্ষ করা যায়, যেসব গুজবে আতঙ্ক ছড়ানো হয় সেসব গুজবের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে গুজবটি সমাজে ছড়িয়ে দেয়।
সর্বশেষ যে বিষয়টি দেখা যায়, তা হল গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি নিজেই আসন্ন বিপদ সম্পর্কে আতঙ্কিত হয়ে গুজবটি ছড়িয়ে ফেলেন।
শুধু যে মহামারীর সময় গুজব ছড়ানো হয় তা কিন্তু নয়। প্রফেসর চার্লেস রোজেনবার্গ তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, একটি সংক্রামক ব্যাধি মহামারী হওয়ার পেছনে গুজব কীভাবে কাজ করে। তিনি দেখিয়েছেন তিনটি ধাপে মূলত এ কাজটি হয়।
প্রথম ধাপে দেখা যায়, মহামারীকে কেন্দ্র করে এক ধরনের উদাসীনতা সৃষ্টি করা হয় বা বিষয়টিকে হালকা করে দেখার প্রবণতা সৃষ্টি করা হয়। যেমনটি করা হয়েছে আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে।
প্রথমে ছড়ানো হয়েছে যে, বিষয়টি চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, আমাদের দেশ থেকে চীনের দূরত্ব অনেক তাই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
যেহেতু একটি মহামারী খুব স্বাভাবিকভাবেই পুরো সমাজের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, তাই দ্বিতীয় ধাপে বোঝানো হয়, এ মহামারীর বিষয়টি দৈব এবং এর সমাধান ও দৈব সূত্রে পাওয়া যাবে।
করোনা মহামারীর সময় আমরা দেখেছি স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ, মূত্র পান ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে প্রতারণা ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় ধাপে আরেকটি বিষয় ঘটে তা হল, ধর্ম-বর্ণ জীবনযাত্রার ধরনকে কেন্দ্র করে পরস্পরকে দোষারোপ।
১৪শ’ শতকে যখন প্লেগ ইউরোপে মহামারী আকার ধারণ করে তখন হঠাৎ ইহুদিদের দোষারোপ করা হয়, তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করায় এ প্লেগ ছড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে করোনাকে কেন্দ্র করে আমরা দেখেছি কখনও বলা হচ্ছে বিশেষ ধর্ম আক্রান্ত হবে না, কখনও বলা হচ্ছে বিশেষ কারও খাদ্যাভ্যাসের কারণে হচ্ছে ইত্যাদি। এমনকি এখনও আমেরিকা করোনাভাইরাসের জন্য চীনকে দোষারোপ করছে।
এ ধাপে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ঘটে, তা অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। এ ধাপে কিছু ব্যবসায়ী মজুদ করে বিশেষ কোনো দ্রব্যের দাম বাড়ানোর কূটচক্রান্তে লিপ্ত হয়।
১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু যখন মহামারী আকার ধারণ করে, তখন নির্দিষ্ট কিছু ওষুধকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি করোনাভাইরাসের সময় মাস্ক, স্যানিটাইজারকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটতে।
সর্বশেষ ধাপে যেটি ঘটে তা হল, সরকার দ্বারা আরোপিত স্বাস্থ্যবিষয়ক নিয়মনীতিতে জনগণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যেমন বিদেশিদের প্রবেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি অনেকেই বিভিন্ন কারণে স্বাস্থ্যবিষয়ক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করেননি।
এমনকি অনেক দেশে যখন লকডাউন বা কারফিউ দেয়া হয়েছে তখন দেখা গেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া মহামারীর সময়ে সমাজের জন্য ভীষণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সর্বোপরি বলা যায়, ইতিহাসের প্রাচীনকাল থেকেই গুজবের সঙ্গে মহামারীর নিবিড় সম্পর্ক। একটি সংক্রামক ব্যাধি মহামারীতে পরিণত হওয়ার বিষয়ে গুজব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তাই মহামারীর সময় আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং মহামারী সংক্রান্ত যে কোনো খবর প্রচারের আগে চরম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
অবশ্যম্ভাবীভাবে সত্য যে, সরকার বা কোনো নির্দিষ্ট বাহিনীর পক্ষে মহামারী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের দায়িত্বশীল আচরণ পারে মহামারীর ভয়াবহতাকে রুখে দিতে।
মনিরা নাজমী জাহান : শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়