মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ কি অত্যাসন্ন?

লিন্ডা এস হার্ড
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইরাকের ঘনিষ্ঠ মিত্র- যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বৈরিতার লড়াই ঘনীভূত হচ্ছে ইরাকের মাটিতে। যদিও শিয়া অক্ষরেখাকে ইরান থেকে লেবানন পর্যন্ত সম্প্রসারণের মূল নায়ক জেনারেল কাসেম সোলেমানির মৃত্যু পশ্চিমে কিছুটা শোরগোল তৈরি করেছে, এটি ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরকে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে; কিন্তু অশেষ হুমকি সত্ত্বেও যুদ্ধ-সংঘাত নির্দিষ্ট একটি সীমারেখার দুই পাশেই রয়ে গেছে। ৪০ বছর ধরে উভয় পক্ষই সর্বাত্মক একটি যুদ্ধের সীমা অতিক্রম করার বিষয়টি এড়িয়ে গেছে বর্তমান সময় পর্যন্ত; এখন প্রতিটি দিন এভাবে যাচ্ছে যেন তারা একে অপরকে ঘুষি মারছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্ররা, বিশেষত ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি ক্ষুব্ধ এ কারণে যে, ইসরাইলের সঙ্গে আগাম পরামর্শ করা হলেও যে ড্রোন হামলায় সোলেমানি ও ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা বৃহৎ শিয়া-মিলিশিয়া গ্রুপ- হাশদ আল-শাবির জ্যেষ্ঠ কমান্ডার আবু মাহদি আল মুহান্দিস খুন হন, সে হামলার বিষয়ে তাদের সঙ্গে আগাম পরামর্শ করা হয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলছেন, উপরোক্ত মিত্র দেশগুলোর প্রতিক্রিয়ায় তিনি হতাশাই খুঁজে পাচ্ছেন।
সুনির্দিষ্টভাবে নাম উল্লেখ না করলেও মুখোমুখি অবস্থানে থাকা ইরাকের অনেক প্রতিবেশী দেশের উভয় পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমন ও শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে ইউরোপ ও জাতিসংঘ; কিন্তু এটা বলা যতটা কঠিন, করে দেখানো তার ধারে কাছেও নেই। সোলেমানি ইরানিদের কাছে হিরো হিসেবে বিবেচিত, কারণ আইএসকে ইরানের সীমান্ত থেকে দূরে রেখেছেন তিনি এবং ইরাকিদের কাছে প্রশংসিত; কারণ গ্রুপটির কথিত খেলাফত ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে তার ভালো ভূমিকা ছিল। ফলে তার প্রভাব মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে না; বরং তা আরও মহিমান্বিত হতে পারে।
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকার ঝোঁক ও বেপরোয়াভাবে চলার মানসিকতাপ্রবণ ইরানি শক্তিগুলো অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়াতে পারে যে, তাদের অবশ্যই উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে হবে। সোলেমানিকে গুপ্তহত্যার পেছনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও যে আমেরিকানদের নিরাপত্তা হুমকির ও নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা বলছেন, বাস্তবে ঘটনা তার বিপরীত; অন্তত আপাততদৃষ্টিতে হলেও। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ‘নিষ্ঠুর প্রতিশোধে’র হুমকি দিয়েছেন।
ইরাকের মিলিশিয়া কাতায়েব হিজবুল্লাহ ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে অশুভ একটি বিবৃতি জারি করেছে, যাতে তাদের বলা হয় সর্বশেষ রোববার খোলা থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলো থেকে দূরে থাকার জন্য। দলে দলে আমেরিকান নাগরিকরা ইরাক ছেড়ে যাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে থাকা মার্কিন দূতাবাস, সামরিক ঘাঁটি ও অন্য কেন্দ্রগুলো সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে এবং অতিরিক্ত ৩ হাজার মার্কিন সেনা ওই অঞ্চলে দ্রুত পাঠানো হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যদি নিজেদের দাবিতে সঠিক হন যে, মার্কিন স্বার্থের ওপর তীব্র হামলা করার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন সোলেমানি (ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেয়ার গোয়েন্দা রিপোর্ট), তাহলে যে কারও এমনটি ভাবা উচিত হবে যে, তার অনুপস্থিতিতে এ সংক্রান্ত আগাম পরিকল্পনাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তবায়নের পথে এগোবে।
নিজেদের পক্ষ থেকে সোলেমানির গুপ্তহত্যাকে ‘যুদ্ধের কর্মকাণ্ড’ এবং ইরাকি সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে ইরাক। ইরাকের রাজনৈতিক মহলজুড়ে এবং দেশটির রাজপথেও তীব্র স্লোগান উঠেছে দেশটির মাটি থেকে মার্কিন সেনাদের সরিয়ে নেয়ার জন্য এমন অভিযোগ আনার মধ্য দিয়ে যে, আইএসবিরোধী যুদ্ধে ইরাককে সহায়তা করার সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছে পেন্টাগন।
অনেক ইরাকি বাগদাদের তাহরির স্কয়ারে জড়ো হয়েছেন ইরাকের ওপর ইরানি প্রভাবের প্রতিবাদ জানাতে। অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তারা এখন উভয় পক্ষ থেকে নিজেদের দেশের সত্যিকারের স্বাধীনতার দাবি জানাচ্ছেন। ইরাকের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিসহ আরও অনেকে ইরানের পক্ষাবলম্বন করছেন, যাদের অনেকে প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পাশাপাশি নিহত সোলেমানিকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও তার জানাজার মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন। সব গোত্র ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ইরাকি ও ইরানিরা সাময়িকভাবে নিজেদের বিভেদ ভুলে নিজ নিজ পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।
ট্রাম্পের মধ্যে শান্ত ও নমনীয় হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ইরান যদি মার্কিন স্বার্থ ও সম্পদের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুত প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে তবে ইরানের ৫২টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান মার্কিন সামরিক বাহিনীর নিশানায় রয়েছে, যেগুলোতে খুব কঠোরভাবে হামলা করা হবে। ইরাকে মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে মিসাইল হামলা চালিয়েছে ইরান। সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি ইরানের ওপর অনেক হামলার গ্রিন সিগন্যাল দিতে বাধ্য হবেন, নাকি পরাজিত মুখে থাকবেন?
কঠিন বাস্তবতা হল, কোনো পক্ষই যুদ্ধ বাধাতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু উভয় পক্ষ বা একপক্ষকে বেরিয়ে আসার চিন্তা করতে হবে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং পর্যটন খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে যাওয়া যুদ্ধ মনে হচ্ছে অপরিহার্য। ইতিমধ্যে আমেরিকার রাজনীতিক ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা ট্রাম্পের খেলার শেষ কী হবে তা বোঝার জন্য ঘাম ঝরাচ্ছেন। তার কৌশল কী? তার কি কোনো লক্ষ্যমাত্রা আছে? ইরানের নেতৃত্ব শান্তির বার্তা হাতে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসছে- এমন কোনো বিবেচনা কি তার আছে? নাকি সব সময় যুদ্ধবিরোধী এ ব্যক্তি, যিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজেদের সেনা ফিরিয়ে আনার শপথ করেছিলেন, তিনি নিজের মত পরিবর্তন করেছেন?
গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তর : সাইফুল ইসলাম
লিন্ডা এস হার্ড : ব্রিটিশ রাজনৈতিক কলামিস্ট, মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক