জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি হ্রাসে পরিবেশবান্ধব ইট বাধ্যতামূলক করুন
ড. এমএ ফারুখ
প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২০, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরিবেশবিষয়ক সংস্থা এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি ২০১৮ সালে বিশ্বের ১৮০টি দেশের পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বাংলাদেশ শেষের দিক থেকে ২য় স্থানে অবস্থান করছে। বিশ্বে কৃষিজমি ও বনভূমি হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১ম এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্লাস্টিক দূষণে ১০ম।
সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ২৮ শতাংশই হয়েছে পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে ১৯৫টি দেশ চলতি শতকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর প্রায় ৮ শতাংশ হারে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। কিন্তু চুক্তির ৩ বছরের মধ্যেই ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার ৬০০ কোটি টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড নিঃসরিত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে চলতি শতকের শেষ নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। বাড়বে বন্যা, খরা, ঝড়, বজ্রপাত, দাবানল, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
আগস্ট, ২০১৭ থেকে জুলাই, ২০১৮ পর্যন্ত পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন বনের প্রায় ৭ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার পুড়েছে। বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ারভিজুয়ালের গত ২৬ নভেম্বর, ২০১৯-এর তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীর ৯১টি বড় শহরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর মানদণ্ডে ঢাকা শহরের অবস্থান দ্বিতীয়। এ প্রেক্ষাপটেই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলার সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত দেশে গত ৫ বছরে ইটভাটা বেড়েছে ৫৯ শতাংশ এবং সংখ্যায় এটি ৪ হাজার ৯৫৯ থেকে ৮ হাজার ৩৩টি হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৩৭টি ইটভাটার কোনো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নেই, পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই ২ হাজার ৫১৩টির এবং কোনোটিই নেই প্রায় ৩ হাজার ইটভাটার। উল্লিখিত ৫টি জেলায় ১ হাজার ৩০২টি ইটভাটা আছে। শুধু ঢাকা জেলায়ই আছে ৪৮৭টি ইটভাটা, যা ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের উৎস হিসেবে ভূমিকা রাখছে। পরিবেশ অধিদফতর গত ২৭ নভেম্বরের এক রিপোর্টে বলা হয়, দেশের ইটভাটাগুলোর প্রতি ৩টির ১টি অবৈধ। বিভাগওয়ারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগে ৬৮৮, চট্টগ্রামে ৫২৫, খুলনা ও রাজশাহীতে ৩০০টি করে এবং রংপুর বিভাগে ৩৭৪টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগের সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২৫টি অবৈধ ইটভাটা আছে, যার মধ্যে পরিবেশগত ছাড়পত্র আছে মাত্র ৪টির। এসব ইটভাটা বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন কয়লা এবং ২০ লাখ টন কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে প্রায় ১ কোটি টন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ এবং ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধিত) অনুযায়ী আবাসিক, সংরক্ষিত ও বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, বন ও জলাভূমি এবং কৃষিজমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। ইটভাটা হতে হবে এসব এলাকা থেকে কমপক্ষে ১ কিলোমিটার দূরে। অথচ বসতবাড়ির কাছে, আবাদি জমিতে, এমনকি তিন ফসলি জমিতেও ইটভাটা আছে। ইটভাটার কারণে অবিরত নির্গত কালোধোঁয়ার সঙ্গে ছাই ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের এলাকাগুলোয়। বাড়ির টিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আশপাশের সবকিছুই ধুলাবালিতে আচ্ছন্ন থাকছে। মাটি পোড়ানো ধোঁয়ায় পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, বন উজাড় ও ভূমিক্ষয়ের প্রভাবে জীবকুলের নানাবিধ ক্ষতি ও রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও শিল্পায়নের এ যুগে ইট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঁচামাল হল মাটি। আর এ মাটির সহজলভ্যতার জন্য বেশিরভাগ ইটভাটাই কৃষিজমির পাশে অবস্থিত এবং ইটের জন্য কৃষিজমির উর্বর মাটি ব্যবহার করে। এতে একটি আদর্শ কৃষিজমি অনুৎপাদনশীল পতিত জমিতে পরিণত হচ্ছে। কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি অপসারণ আমাদের পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিজমির উপরিভাগের (টপসয়েল) ৬ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি সরানো হলেও তা মাটির উর্বরাশক্তি কমিয়ে দেয়। অথচ ক্ষেত্রবিশেষে ইটভাটাগুলো ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি সরিয়ে নিচ্ছে। এ ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করতে না পারলে বায়ুদূষণ থেকে আমাদের শিগগির কোনো পরিত্রাণ হবে না।
এশিয়ায় ৪৫৪ কোটি লোকের মধ্যে ২০০ কোটির বেশি মানুষ নগরে বাস করেন। এসব মানুষের চাহিদা পূরণে প্রতিবছর এশিয়ায় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ইট তৈরি হয়, যা সমগ্র পৃথিবীর ইট উৎপাদন ও ব্যবহারে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি ইটের চাহিদা পূরণে কমপক্ষে ৪ কোটি কেজি মাটি কাটতে হয় এবং এ ইটশিল্প অনেক বেশি জ্বালানি ও শ্রমনির্ভর। চীন ৫০ বছর পূর্বে মাটি পোড়ানো ইট উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে। সিঙ্গাপুর, জাপান, কোরিয়া ও ভারতে ইট উৎপাদনে কৃষিজমির মাটির ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ সরকারের ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে ইটভাটায় কৃষিজমির উপরিভাগের মাটির ব্যবহার শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে এবং মাটি পোড়ানো ইটভাটা পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হবে। এ লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব মাটি ও জ্বালানিবিহীন ইট তৈরির জন্য হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইন্সটিটিউটকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাসে বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব ইটের মডেল হাউস তৈরি করা হয়েছে মানুষের কাছে এর উপযোগিতা তুলে ধরার জন্য। মাটি পোড়ানো ইট নিষিদ্ধ করে বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্রিক্স, কংক্রিট ব্লক, হল ব্লক, সেলুলার ব্লক, সলিড ব্লক, লিন্টেল, থার্মাল ব্লক, কম্প্রেসড স্টাবিলাইজড আর্থ ব্লক, স্যান্ড লাইম, ফ্লাই অ্যাশ ব্রিক, সয়েল স্টাবিলাইজড ব্লক, এএসি ব্লক, লাইটওয়েট ইট ইত্যাদি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ইট প্রস্তুতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম শ্রমিকের প্রয়োজন হয়, সিমেন্টের ব্যবহার কম হয়, ওজন কম ও সামগ্রিকভাবে ২০ শতাংশ নির্মাণ খরচ কম হয়।
সারা দেশে ৮ হাজারটি ইটভাটার বিপরীতে মাত্র ১৭টি বিকল্প বা পরিবেশবান্ধব ইট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আছে। অথচ এ খাতে বার্ষিক চাহিদা বৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ। পরিবেশবান্ধব ইট তৈরিতে মাটি একটি আবশ্যিক উপাদান হলেও এ ইট তৈরিতে মাত্র ৩০ শতাংশ মাটি লাগে তবে তা জমির উপরিভাগের মাটি নয় বরং নদী পাড়ের বা ইতিমধ্যে কেটে নেয়া হয়েছে এমন জায়গার মাটি। পরিবেশের ওপর পরিবেশবান্ধব ইটের প্রভাব (ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট) পোড়ানো ইটের ৯ শতাংশের ১ শতাংশ। উৎপাদন শক্তি খরচ প্রচলিত পোড়ানো ইটের ১০ শতাংশের ১ শতাংশ, যা জ্বালানীবিহীন ও আগুনে পোড়াতে হয় না। এতে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের নির্গমন হ্রাস হয় প্রায় ৭৫ শতাংশ। স্বয়ংক্রিয় প্রেস মেশিনে নির্মিত ইটের চাপ সহনক্ষমতা বা কম্প্রেশন রেট ৯ এমপিএ, যা একটি ১৩০ তলা ভবনের নিচতলার চাপের সমান। এ ছাড়া এ ইট সাধারণ ইটের চেয়ে মসৃণ, প্লাস্টার দিতে হয় না, প্রতি বর্গফুট দেয়ালে পোড়ানো ইটের চেয়ে সংখ্যায় কম লাগে, পোড়ানো ইটের তুলনায় বেশি মাত্রার তাপ ও আগুন প্রতিরোধী, আকারে বড় এবং সমান মাপের হয়, যা মানানসই ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয়।
সমাজের স্বল্পআয়ের মানুষের জন্য স্বল্প খরচে টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব বাড়ি নির্মাণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিরসনের লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব ইটের বহুল ব্যবহার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। সরকার নিজেই এ ইটের অন্যতম ভোক্তা। যদিও সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে পরিবেশবান্ধব ইটের ব্যবহার শতভাগে উন্নীত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে, তথাপি এখন থেকেই সরকারি ভবন নির্মাণে এটি বাধ্যতামূলক করা উচিত। চীনে পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণের হার মোট নির্মাণের ৩০ শতাংশ, ভিয়েতনামে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্মিত ভবনে ৮০ শতাংশ পরিবেশবান্ধব ইটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কাজেই আমাদের দেশে পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নসহ বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার থেকে আর্থিক প্রণোদনা, ভূমি বরাদ্দ ও ইট প্রস্তুত প্রযুক্তি হস্তান্তরে সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
ড. এম এ ফারুখ : প্রফেসর, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
mafarukh@gmail.com