প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘উন্নয়ন’ কোনো প্রাত্যহিক বুলি নয়। উন্নয়ন হল একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর মাত্রা যাই হোক না কেন, গতকালের তুলনায় আজ অধিকতর ভালো থাকতে হবে এবং আজকের তুলনায় আগামীকাল আরও বেশি ভালো থাকতে হবে- উন্নয়নের এটাই হল সাদামাটা কিন্তু পরিষ্কার ধারণা।
সেই মতে আমাদের দেখা প্রয়োজন ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে আমরা কেমন ছিলাম এবং ২০২০ সালে কেমন থাকতে চাই। এ তুলনামূলক আলোচনা থেকেই আমাদের প্রকৃত প্রত্যাশার বাস্তব মাত্রাটা বেরিয়ে আসবে।
আমাদের ভাগ্য নিয়ন্তা সরকার ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব নেয়। সে হিসেবে সরকারেরও এক বছর পূর্ণ হল বলা যায়। এ সময়ের মধ্যে এমন অনেক কাজই হয়েছে, যা আগ বাড়িয়ে বলার মতো। আবার এমন অনেক কাজই হয়েছে, যা রীতিমতো অপ্রত্যাশিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে মুখ লুকিয়ে রাখার মতো। অসাধারণ একটি সাফল্যময় দিন দিয়ে ২০১৯ সাল শুরু করেছিল সরকার- সেটা হল বই উৎসব। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি সারা দেশে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৮৬৫ শিক্ষার্থীর মাঝে বিনা মূল্যে ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২টি বই অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা হয়। সন্দেহ নেই এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ বছরও তা-ই করা হয়েছে। এ কৃতিত্ব সরকারকে দিতেই হবে। সরকারের নেয়া মেগা প্রকল্পগুলো অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই এগিয়ে চলেছে। এ পর্যন্ত প্রকল্পগুলোয় খরচ করা হয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। মোট টাকার প্রায় ৪৬ শতাংশ নিজস্ব তহবিল থেকে এবং বাদবাকি ৫৪ শতাংশ বৈদেশিক ঋণ থেকে খরচ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সাফল্য দেখিয়েছে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এ প্রকল্পের প্রায় ৭৩ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আলোচিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ এগিয়েছে ৫৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি ৪১ দশমিক ২১ শতাংশ, মেট্রোরেল ৩৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ, দোহাজারি-ঘুমধুম পর্যন্ত রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ২৯ শতাংশ। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ হয়েছে ২৬ দশমিক ৭২ শতাংশ, পদ্মা সেতুতে সংযোগ সড়কের কাজ এগিয়েছে ১৭ দশমিক ১৫ শতাংশ আর অতি আলোচিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ১৮ শতাংশ। যদি উল্লিখিত প্রকল্পগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পাদন করা যায়, তাহলে আমরা একটি আশাবাদী অর্থনীতি পেতে পারি।
উন্নয়ন কাজ এমনই যে তা যেমন অর্থনীতিকে সাফল্য এনে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিরও পাহাড় গড়ে তোলে। দুর্নীতির মাত্রা দিনকে দিন লাগাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ সত্য মেনে নিয়েই বর্তমান সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তব সত্য হল সারা বছরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেমন কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। তবে হ্যাঁ, বছরের তৃতীয়াংশে এসে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান কিছুটা হলেও মানুষের মনে আশার সঞ্চার করতে পেরেছিল। প্রায় ৬ শতাধিক ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এটাকে আমরা প্রশংসনীয় বলতে পারি। তবে এ কথাও ঠিক, যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে তার তুলনায় ব্যবস্থা গ্রহণ অতি সামান্য। সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নকে অনেকেই সাফল্য বলে বিবেচনা করেন। যদিও এর কৌশলগত দিক নিয়ে সমালোচনা আছে। আইনটি এমনভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে যে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিক যেন একে অপরের প্রতিপক্ষ।
অনেকদিন থেকেই ব্যাংক খাতের ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী সুদের হার ৯ শতাংশ ধার্য করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং তা আগামী এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কোনো কাজে সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয় না। যদি ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হয় তাহলে বিনিয়োগকারীরা সুবিধা ভোগ করবেন, পাশাপাশি আমানতকারীরা ৬ শতাংশ সুদ পেয়ে সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। তারপরও বলা যায়, অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং তা থেকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনা ধনাত্মক প্রভাব ফেলবে।
সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতার উদাহরণও কম নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৯ সালটি ব্যাংকিং খাতের জন্য ছিল একটি অভিশপ্ত বছর। প্রবাসী আয় ছাড়া নিজেরা ভালো কিছু করতে পারেনি। দুর্নীতি আর অনিয়মের অন্যতম উদাহরণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ব্যাংকিং খাত। ঋণখেলাপিতে পঙ্গু হতে চলেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। তারা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। আরও বেশকিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও নাজুক। এ ধরনের নাজুক অবস্থার মধ্যে আরও চারটি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন ছিল ২০১৯ সালের আলোচিত বিষয়।
দুর্নীতির মাত্রা তো কমেইনি বরং দিনকে দিন এর আকার ও ধরন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একটি মাত্র উদাহরণ দিয়েই সার্বিক অবস্থার কথা জানান দেয়া সম্ভব। ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কেনাকাটায় যে দুর্নীতি হয়েছে, তা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। ওই প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে। নিয়ম অনুসারে ৩০ কোটি টাকার নিচে কেনাকাটা হলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অনুমোদন লাগে না। এ সুযোগ নিয়ে ১৬৯ কোটি টাকার কাজ ছয়টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। সেখানে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর প্রতিটি বালিশ আবাসিক ভবনের খাটে তোলার মজুরি দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। কভারসহ কমফোর্টারের (লেপ বা কম্বলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত) দাম ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা। একইভাবে বিদেশি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৩৬ টাকায়। পাঁচটি ২০ তলা ভবনের জন্য এসব কেনাকাটা হয়েছে। প্রতি তলায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। প্রতি ফ্ল্যাটের জন্য কমফোর্টার শুধু বেশি দামে কেনাই হয়নি, কেনার পর দোকান থেকে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছাতে আলাদা ট্রাক ব্যবহার করা হয়েছে। মাত্র ৩০টি কমফোর্টারের জন্য ৩০ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া দেখানো হয়েছে। আর একেকটি কমফোর্টার খাট পর্যন্ত তুলতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ হাজার ১৪৭ টাকা। কমফোর্টার ঠিকঠাকমতো খাট পর্যন্ত তোলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য তত্ত্বাবধানকারীর পারিশ্রমিক দেখানো হয়েছে প্রতিটির ক্ষেত্রে ১৪৩ টাকা। ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ লাভ ধরে সম্পূরক শুল্কসহ সব মিলিয়ে প্রতিটি কমফোর্টারের জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২২ হাজার ৫৮৭ টাকা’ (যুগান্তর, ৩১.১২.২০১৯)। এখানে পরিমাণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল দুর্নীতির ধরন। এমন আরও শত শত উদাহরণ দেয়া যাবে। তাই ২০১৯ সাল ছিল দুর্নীতিবাজদের উৎসবের বছর।
আমরা বিজয়ের মাস দিয়েই বছর শেষ করি। ২০১৯ সালের বিজয়ের মাস শেষ করেছি দুটি কলঙ্কিত অনুভূতির ভেতর দিয়ে। প্রথমটি হল, আমরা জাতিকে একটি বিতর্কিত রাজাকারের তালিকা উপহার দিয়েছি, যা অতিশয় নিন্দনীয়। আর দ্বিতীয়টি হল, আমরা মর্যাদাপূর্ণ ডাকসুর ভিপি নূরুল হক নূরকে ডাকসু ভবনেই লাঠিপেটা করেছি। আমাদের কাণ্ডজ্ঞানে যে কোনো সভ্য মানুষ লজ্জায় মুখ লুকাতে বাধ্য।
আমার মতে, গেল বছরে আমাদের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটি ছিল ‘ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা’(Centralization of Power)। রাস্তা ঝাড়ু থেকে শুরু করে মশক নিধন পর্যন্ত সব কাজই নাকি হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। তাহলে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন তাদের কাজ কী? প্রায় ২৭ লাখ কোটি টাকার অর্থনীতিকে এককভাবে পরিচালনা করা সম্ভব? যদি আমরা সেদিকে এগোই তাহলে সার্বিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে। সে ক্ষেত্রে সমস্যা যত সামান্যই হোক সামাল দেয়া দায় হয়ে পড়বে। এবং তা হয়েছেও। এক রাতের গুজবে লবণ নিয়ে কোটি টাকার মুনাফা করে ফেলল একদল ব্যবসায়ী। পেঁয়াজের কথাই ধরুন। এ খাতটি আমদানিনির্ভর। এবারে আমরা যেসব উৎস থেকে আমদানি করি সেখানে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তাই জোগানে একটা বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। যদি তাই হয় তাহলে তো ১৭ কোটি মানুষেরই সংকটে পড়ার কথা, সেখানে গুটিকয়েক মানুষ কীভাবে রাতারাতি কোটি কোটি টাকা বাগিয়ে নিল? পর্যাপ্ত চাল থাকা সত্ত্বেও কেন চালের বাজার হঠাৎ করে গরম হয়ে উঠল? তার মানে হল মনিটরিং ঠিকমতো হয়নি। মনিটর করবেই বা কে, সবাই তো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন। ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা সে কারণেই সবসময় মঙ্গলজনক হয় না, এর বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। এ কেন্দ্রিকতার ফলে পেশাজীবীদের মধ্যেও দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টার অভাব লক্ষ করা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলুন, ডাক্তার বলুন, ইঞ্জিনিয়ার বলুন, সবাই পেশাগত দায়িত্ব ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টিতে আশার নেশায় মত্ত। বিএনপি-জামায়াত এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়, তাই নিজেদের দলের সমর্থককেই রাতারাতি ‘রাজাকার’ বানিয়ে দিচ্ছে। ফলে পেশাদারিত্বের অবনতি ঘটছে, ছুটছে সবাই ক্ষমতার কেন্দ্রিকতার দিকে। এটাই হল হালের নেতিবাচক দিক।
অথচ আমাদের একটি গতিশীল ও ক্রমবর্ধমান উদ্যোক্তা শ্রেণি আছে। শিল্পে বৈচিত্র্য আনার মতো শ্রমজীবী শ্রেণি আছে। প্রবাসে আমাদের কর্মজীবীরা দিনরাত সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। গেল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তারা রেকর্ড পরিমাণ ১৬.৪৬ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। আমাদের কৃষক বারবার অর্থনৈতিক ভোগান্তির শিকার হয়েও কৃষি উৎপাদনকে সচল রেখেছেন। আমাদের নারীরা, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা শ্রেণি অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। সে হিসেবে ২০২০ সালকে আমাদের অধিকতর সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে ভাবতে অন্যায় কীসের? ‘তবে আমাদের সম্পদের উৎপাদনশীলতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে প্রতিযোগিতামূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ভিত্তিতে একটি জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও সৎ শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জরুরি হল একটি শক্তিশালী, স্বাধীন গণমাধ্যম এবং অধিকতর সমতাভিত্তিক, ন্যায্য উন্নয়ননীতি’ (রেহমান সোবহান, প্রথম আলো, ০১.০১.২০২০)।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়