Logo
Logo
×

বাতায়ন

আমাদের উন্নয়নে কূটনীতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ

Icon

এম হুমায়ুন কবির

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের উন্নয়নে কূটনীতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ

গত এক বছর ধরে আমাদের অর্থনীতির চাকা বেশ সচল আছে এবং বেশ শক্তিশালীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত বছর ৮ শতাংশের মতো আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

এ বছর আরও একটু বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার ফলে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু দেশে আশানুরূপ বিনিয়োগ হচ্ছে না। দেশের বড় বড় প্রকল্পে সরকারিভাবে খানিকটা বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগের একটা সীমাদ্ধতা আছে।

কেননা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়নসহ অনেক ক্ষেত্রেই সরকারকে ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। তবে প্রাইভেট সেক্টরে আমরা যে পরিমাণ বিনিয়োগ আশা করেছিলাম, সে পরিমাণ বিনিয়োগ আসছে না। গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ একট শ্লথ পর্যায়ে রয়েছে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের একটা সম্পৃক্ততা আছে। এর কারণ হল, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ যেমন আছে তেমনি প্রযুক্তিরও একটা বিষয় রয়েছে। কাজেই বিনিয়োগের সঙ্গে আমাদের বহির্র্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের একটা সম্পর্ক আছে।

অর্থাৎ কোন দেশের সঙ্গে আমরা কী ধরনের সম্পর্ক রাখব, কোন দেশ থেকে কী ধরনের বিনিয়োগ সহযোগিতা পাব সে বিষয়গুলো মাথায় রেখেই আমাদের এগোতে হবে। যে কোনো দেশের প্রবৃদ্ধির চাকাকে সচল রাখতে হলে এ বিষয়গুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমরা খানিকটা ইতিবাচক, খানিকটা নেতিবাচক।

যে কোম্পানিগুলো আমাদের দেশে আছে, সে কোম্পানিগুলোর লাভটাকেই তারা রিসাইকেল করে। অর্র্থাৎ লাভটাকেই আবার পুনঃবিনিয়োগ করছে। সুতরাং নতুন করে কোনো বিনিয়োগ আসছে না। কাজেই বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে।

একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, বিদেশি বিনিয়োগ পেতে হলে দেশে বিনিয়োগের উন্নত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, বিশেষ করে, দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বাড়াতে হবে এবং এর জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুই সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে।

আমাদের নীতিগত অবস্থানের বলিষ্ঠতা কম, যার ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। কখনও কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে সেটি নিরসনের জন্য কোনো ভালো পদ্ধতি আমাদের এখানে নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে লাভের আশায়।

লাভের জায়গাটায় যখন প্রতিকূলতা তৈরি হয় তখন বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যায়। সুতরাং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এ বিষয়গুলো আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

বাংলাদেশের সঙ্গে পররাষ্ট্র সম্পর্ক বা পররাষ্ট্রনীতি যাই বলি না কেন, এর সবকিছুরই কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে দেশের উন্নয়নের ধারাটাকে শক্তিশালী করা। আর এ উন্নয়নের একটা বড় মাধ্যম হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ।

বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ অভ্যন্তরীণ সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। সুতরাং আমাদের উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখতে হলে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের পরিধি আরও বাড়াতে হবে।

উন্নয়নের আরেকটি অনুষঙ্গ হল দেশের তরুণ প্রজন্ম। বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী তরুণ। এ তরুণরাই আগামীর ভবিষ্যৎ।

সুতরাং আমাদের ভাবতে হবে, এদের ভবিষতের জন্য কতটা তৈরি করতে পারছি, ভবিষ্যৎ এদের জন্য কতটা প্রস্তুত হচ্ছে। তরুণদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য এ তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের কাজে লাগতে হলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। তাদের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে।

কিন্তু উন্নয়নের গতির সঙ্গে কর্মসংস্থানের সমন্বয় আমরা করতে পারছি না। ফলে দেশে জবলেস গ্রোথ বাড়ছে। জবলেস গ্রোথ বাড়তে থাকলে দেশে বিনিয়োগ কমবে, বেকার সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করবে। সেটি দেশের জন্য কখনই মঙ্গল বয়ে আনবে না।

আরেকটি অভিযোগ রয়েছে, দেশের তরুণ প্রজন্মকে আমরা উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারছি না এবং তাদের যোগ্য করে তুলতে পারছি না। তারা যে শিক্ষা পাচ্ছে সে শিক্ষা দিয়ে তারা তেমন কোনো কাজ পাচ্ছে না। আমরা পরিকাঠামোগতভাবে অনেক উন্নয়নই দেখছি এবং এ উন্নয়নগুলো যাদের জন্য অর্থাৎ যারা এর ফল ভোগ করবে সেই তরুণ প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারছি না।

শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানের কোনো সমন্বয় নেই। আমাদের প্রজন্মে আমরা যেটুকু শিক্ষা পেয়েছি, সেই শিক্ষাটাকে কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছি।

গত ৪০ বছরে অর্থনীতির ধারার পরিবর্তন হয়েছে, কর্মসংস্থানের চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে, কৌশলের পরিবর্তন হয়েছে, কর্মসংস্থানের জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন, সে দক্ষতার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এ পরিবর্তনগুলো আমাদের শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে ধরাতে পারিনি।

আর এ কারণে যত উপরের দিকে ডিগ্রিধারী হচ্ছে, ততই তারা আন-এমপ্লয়মেন্ট হচ্ছে। অর্থাৎ যত বেশি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, ততই তারা কর্মহীন। এ এক অদ্ভুত কাঠামোর মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

অপরদিকে যারা লেখাপড়া জানে না বা স্বল্পশিক্ষিত, তারা এমন একটা পরিবেশে কাজ করছে যেখানে তাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই, ভবিষ্যতেরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে দক্ষতার অভাব। দক্ষতার অভাবের কারণেই আমাদের এ অদ্ভুত চিত্রটি দেখতে হচ্ছে।

সামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্রিটিক্যাল থিংকিং বা একটা বিষয়কে বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করার মতো দক্ষতা বা ক্ষমতা আমাদের মধ্যে কতটা আছে সেটা ভাবতে হবে। আমাদের শিক্ষা কাঠামোয় এটি মোটেও পড়ানো হয় না। আমরা মুখস্থ পড়ছি, সেটা রি-প্রডিউস করছি। চিন্তা করে নতুন কিছু মতামত দেয়ার সুযোগ এখানে নেই। এ বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেমন নেই, তেমনি আমাদের পারিবারিক জীবনে নেই, বাইরের সমাজব্যবস্থায়ও নেই এবং এর জন্য তেমন কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনাও নেই। মোটকথা, ভিন্নমত আমরা কেউ পছন্দ করছি না।

পরিবার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত সর্বত্রই এটি বিস্তৃত। এটি না হওয়ার ফলে ক্রিটিক্যাল থিংকিং ফ্যাকাল্টি আমাদের মাঝে অনুপস্থিত। ফলে এনালিটিক্যাল স্কিলস আমাদের মধ্যে ডেভেলপ করে না। টিম বিল্ডিংয়ের দক্ষতা আমরা দিতে পারছি না।

কমিউনিকেশন স্কিলসেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে যে দক্ষতাগুলো কাজের জন্য প্রয়োজন, তার বেশিরভাগই আমাদের মাঝে অনুপস্থিত। কাজেই ডিগ্রি হয়তো আমরা নিচ্ছি, কিন্তু এ ডিগ্রি নিয়ে যখন কাজে হাজির হই তখন সেই ডিগ্রিটাকে কাজে লাগাতে পারছি না।

এটি গেল আমাদের অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের বিষয়। বিদেশে যারা কাজ করছে, তাদের ক্ষেত্রেও একটা অনগ্রসরতা কাজ করছে। প্রতিবছর আমাদের জনসংখ্যার দশ লাখ লোক কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ৫-৬ লাখ লোক বিদেশে যাচ্ছে কর্মসংস্থানের জন্য।

যারা বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যাচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই অদক্ষ ক্যাটাগরির। সেখানে নিম্ন মজুরির কাজগুলোই তাদের করতে হচ্ছে। ফলে আশানুরূপ রেমিটেন্স থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। বিদেশে কর্মরত প্রায় এক কোটি লোকের কাছ থেকে আমরা মাত্র ১৫ মিলিয়ন ডলার পাচ্ছি। এর চেয়ে অনেক কম লোক বিদেশে নিয়োগ করে ফিলিপাইনের মানুষ অনেক বেশি আয় করছে। কারণ তারা শিক্ষায় যথেষ্ট অগ্রসর ও দক্ষ।

বিদেশে আমাদের এই যে এক কোটি কর্মীবাহিনী আছে, তাদের যদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মীতে পরিণত করে পাঠানো যেত, তাহলে দেশে রেমিটেন্সের পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে যেত এবং দেশের প্রবৃদ্ধিতে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। কিন্তু আমরা সেটি করতে পারিনি।

বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম সূত্র হচ্ছে আমাদের স্বদেশি যারা বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তারা। তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আমরা পেতে পারি। কিন্তু আমরা তা পাচ্ছি না। কারণ তাদের বিনিয়োগের সঠিক ব্যবহারের নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারছি না।

বিনিয়োগের ভালো পরিবেশ আমরা সৃষ্টি করতে পারছি না। চীনে যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তার ৭০ শতাংশই আসে বিদেশে কর্মরত চীনা লোকদের কাছ থেকে। কেননা চীনে বিনিয়োগের যথেষ্ট কর্মপরিবেশ রয়েছে। চীন পারলে আমরা কেন পারি না? আমাদের ব্যর্থতা কোথায়?

আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, কর্মসংস্থান প্রয়োজন- এসবের সঙ্গে আমাদের বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের একটা সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু আমরা পারস্পরিক নির্ভরশীল বিশ্বে বাস করছি, সেহেতু এগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। উন্নয়ন ও কূটনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

উন্নয়ন ও কূটনীতিকে যত বেশি আত্তীকরণ করতে পারব, ততই আমরা ভালোভাবে আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হব।

এম হুমায়ুন কবির : সাবেক রাষ্ট্রদূত

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম