Logo
Logo
×

বাতায়ন

সামাজিক মূল্যবোধের সূচক এত নিম্নগামী কেন

Icon

ড. রুমানা আফরোজ

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সামাজিক মূল্যবোধের সূচক এত নিম্নগামী কেন

বয়ঃসন্ধিকালের সময়টা নিয়ে কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে অনেকেই অনেক কিছু লিখেছেন। কিন্তু এ যুগের বাচ্চারা যেন বড্ড বেশি ম্যাচিউরড। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেমেয়েকে দেখলে মনে হয় যেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতার নতুন করে নামকরণ করতে হবে ‘চৌদ্দ বছর বয়স’।

চারটি বছর এগিয়ে এসেছে এদের ম্যাচিরিউটির ক্ষেত্র। এরা এ বয়সেই স্কুল পালায়, অনলাইন প্রেম করে, চ্যাট করে, ধূমপানের মতো নেশার ভুবনে প্রবেশের দুঃসাহস দেখায়, মোবাইল দেখতে না দিলে মা-বাবার দিকে উদ্ধত ভঙ্গিতে তেড়ে আসে। প্রশ্ন জাগে, মানুষ কতটা খারাপ হলে এ কোমলমতি বাচ্চাদের হাতে কলমের মধ্যে ধূমপানের উপকরণ ঢুকিয়ে দেয় (ভেপ), তা-ও আবার বিভিন্ন ফ্লেভার দিয়ে। আর লেখাপড়া? সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জিনিস তাদের কাছে। কেন যে এটা করতে হয় এ প্রশ্নের উত্তরই তাদের মাথায় ঢোকে না। লেখাপড়া ছাড়া পৃথিবীর তাবৎ জিনিসে তাদের আগ্রহ। ফাঁকিবাজি করে কোনোভাবে নম্বর পেলেই তারা মহাখুশি। ভেতরে নেই কোনো অনুশোচনাবোধ। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করার চেষ্টা করে। কতরকম বাজে ও অন্যায় পদ্ধতি অবলম্বন করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যায়, তাতেই তাদের প্রবল উৎসাহ। অথচ এ লেখাপড়া তাদের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে। আহা, কেন এরা এগুলো বোঝে না?

এবারে আসি খাদ্যাভ্যাসের প্রসঙ্গে। মাংস ছাড়া অন্যকিছু তাদের মুখে রোচে না। সবজি? সেটা আবার কী? ইয়াক্! এটা মানুষ খায়? তাদের খেতে ভালো লাগে বিরিয়ানি, বার্গার, পিৎজা, শর্মা, চটপটি, ফুচকা, ভেলপুরি, মুড়ি-চানাচুর, কোমলপানীয়- আরও কত কী! এসব ছাড়া তাদের চলেই না।

জন্মদিনে ট্রিট চলে। মাথায় ডিম ভাঙা হয়, ময়দা মাখানো হয়, গণ দেয়া হয়। কী অদ্ভুত কালচার! কোথা থেকে এরা পায় এসব? রাস্তায়, শপিং মলে, খাবারের দোকানে স্কুল ড্রেস পরা সব ছাত্রছাত্রী- কখনও জোড়ায় জোড়ায়, কখনও দলবেঁধে হৈ-হুল্লোড় করতে দেখা যায় তাদের। অথচ চলছে স্কুল আওয়ার।

নতুন একটা উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শুরুটা যদিও শুভ চিন্তা নিয়ে হয়েছিল; কিন্তু এ প্রজন্ম এ শুভ চিন্তার অপব্যবহার করছে। বিভিন্ন ফেস্ট, অলিম্পিয়াড, কার্নিভাল ইত্যাদি সারা বছর লেগেই থাকে। আর এ ভালো পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সাক্ষাৎ আর আড্ডার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ নয়, একে অপরের সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা বলা, ছবি তোলা এগুলোই যেন মুখ্য বিষয়।

এদের পোশাকে নেই শালীনতা। ফ্যাশন নামের কলংকের টিপ কপালে তুলে অশ্লীলতায় ডুবে যাচ্ছে যেন এ প্রজন্ম। অশ্লীলতা শুধু পোশাকে নয়, আচরণেও। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছেলেমেয়ে তো আরও দশ ধাপ এগিয়ে। ফোন ছাড়া তাদের চলেই না। তা-ও স্মার্টফোন। নতুন মডেলের এবং দামি। যার সামর্থ্য নেই, তারও একটা সাধারণ ফোন রয়েছে। আর এর ব্যবহারের কথা এখানে বলা বাহুল্য হবে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এ সমস্যা। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত এ তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের শিকার। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে। ১০ শতাংশ মানুষ একে কাজে লাগাচ্ছে। Facebook, WhatsApp, Instagram, Snapchat, Messenger, Games আরও কত হাজারও Apps রয়েছে আবালবৃদ্ধবনিতাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তার খবর আমরা সবাই জানি। বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবেন, ‘ভালোটা গ্রহণ করছি’? ‘আমি নির্ধারিত সময় ছাড়া মোবাইল ফোন ব্যবহার করি না’- এ কথা কতজন চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন?

আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা দিন-রাত পরিশ্রম করছি। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে আসলে কোনো এক ধ্বংসের দিকে। সময় কি আছে এদের ফেরানোর? আহা! যদি উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও সরকারিভাবে বিদ্যালয়ে বা কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার সারা দিনে নির্ধারিত সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ করে দেয়া হতো! এমন যদি হতো- বাচ্চাগুলো সব মা-বাবার কথামতো সবকিছু করছে, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে, সুস্থ-সংস্কৃতির চর্চা করছে।

‘সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা

আশা তার একমাত্র ভেলা।’

এ আশার ভেলায় করে আমরা কি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব? ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আজকাল বাচ্চারা পর্নো ভিডিও দেখছে। কী অধঃপতন! এ বয়সে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি এসব। কেন তবে এ অধঃপতন? এ অধঃপতন তো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র- সবার। এ অধঃপতনের মূল কারণ প্রযুক্তির সহজলভ্যতা। আমরা কি সত্যিই উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি, নাকি নৈতিক অধঃপতন ও স্খলনের পথে পা বাড়াচ্ছি? নাকি প্রযুক্তির অপব্যবহার করছি? নাকি পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি? মনে হয় সবই। আসলে এর সমাধান কী? সবাই মিলেও কি আমরা পারব এর সমাধান করতে? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ আসলে কী? যে শিশু এসেছে নতুন কিংবা আসছে ভবিষ্যতে, তার কাছে কি বিশ্বকে বাসযোগ্য করে তুলে দিতে পারছি আমরা? পারব আমরা?

যে কিশোর-কিশোরী এগিয়ে যাচ্ছে যৌবনের পথে, তাকে সুপথ দেখাবে কে বা কারা? যে তরুণ বা তরুণী কিংবা বয়স্ক তরুণ-তরুণী পরকীয়া প্রেম বা মোবাইলের অপপ্রযুক্তির শিকার, তাদের এর পরিণতি দেখাবে কে বা কারা?

আজ আসলে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষার বড় প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। কারণ কোনো ধর্ম কোনোদিন খারাপ কিছু শিক্ষা দেয় না। কিন্তু আজকাল কিছু হুজুর, মাদ্রাসা- এদের নৈতিকতা নিয়ে যে প্রশ্নটি উঠেছে তা হল, কে তাদের নৈতিকতা শেখাবে? তারা কাদের নৈতিকতা শেখাবে?

তবে আশার কথা হচ্ছে, সমাজে এখনও অনেক অনেক ভালো মানুষ আছে, যার কারণে পৃথিবী টিকে আছে। সমাজের সব শিশু, কিশোর-কিশোরী বা পরিণত বয়সীরা এ অবক্ষয়ের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে না। তবে এসব ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রত্যেকে যদি নিজেকে প্রশ্ন করি- আমি কী করছি, যা করছি তার কতটুকু যৌক্তিক বা ভালো, নিজেকে কতখানি সংশোধন করা প্রয়োজন, তাহলে হয়তো ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতো। আসুন সবাই মিলে চেষ্টা করি। সাদা মনের মানুষ হই, আলোকিত মানুষ হই।

ড. রুমানা আফরোজ : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, প্রভাতি শাখা, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম