সৎ, দেশপ্রেমিক ও দক্ষ নেতৃত্বই পারে
মো. মইনুল ইসলাম
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আছে প্রায় এক যুগ। বিরোধী দল ও গোষ্ঠীগুলো বর্তমান সরকারের সমালোচনা ও নিন্দায় সোচ্চার। বিশেষ করে বিএনপির মতে এ সরকার অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী। তাই তারা এর পতন চায় এবং নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে একটি ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ চায়। আরও দু-একটি ক্ষুদ্র বিরোধী দল ও গোষ্ঠী সরকারের অগণতান্ত্রিকতার সমালোচনা করে। প্রশাসনের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং জনস্বার্থবিরোধী কাজকর্মের সমালোচনা সুশীলসমাজের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও মাঝেমধ্যে করে থাকে। জনগণ এটাকে স্বাভাবিকভাবেই নেয়।
কারণ একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল ও মত থাকবেই। তবে বিএনপির প্রতিবাদ-সমালোচনা এবং আন্দোলন মূলত তাদের নিজস্ব এবং পছন্দের সরকারপ্রাপ্তির জন্য। এখন তার সঙ্গে প্রাধান্য পাচ্ছে দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মতে, বেগম জিয়া যেহেতু দু-দুটি দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত; তার জামিন ও মুক্তি আইনি প্রক্রিয়ায়ই হতে হবে। মামলা দুটি যদি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল হয়ে থাকে, তবে তা আদালতেই প্রমাণ করতে হবে। কারণ বিচার দুটি যথেষ্ট স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। দেশের বিচারব্যবস্থা এবং বিশেষ করে উচ্চ আদালতের ওপর আমাদের যথেষ্ট আস্থা আছে।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর কারণেই মনে হয়, মওদুদ সাহেবসহ তার দলের ফখরুল ও রিজভীদের নিয়মিত নানা হুমকি-ধমকি জনমনে কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারছে না। তাই রাজপথে তাদের পক্ষে জনগণ নেমে আসছে না। বিএনপির জন্ম যে সেনানিবাসে একজন সামরিক স্বৈরশাসকের উদ্যোগে, তা কারও অজানা নয়। তাদের আমলে নানা নির্বাচনে দুর্নীতির অনেক ঘটনাও দেশবাসীর জানা। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের মাধ্যমে ২০০৬ সালে নির্বাচনের নামে তারা যে বিরাট প্রহসনের আয়োজন করেছিল, তা কারও অজানা নয়।
আমরা গণতন্ত্র চাই। গণতন্ত্রের স্বার্থেই আমরা একটি সত্যিকার বা সঠিক নির্বাচন চাই; যার অপর নাম অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন। নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের যাত্রা শুরু। তারপর তাদের কাজ হচ্ছে দেশবাসীকে সুশাসন এবং আইনের শাসন প্রদান; আর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না করে তাকে বিকেন্দ্রীকরণ। সব অঞ্চলের মানুষের কাছে সরকারের সেবা ও শাসন পৌঁছে দেয়া। তবে বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি দরকার উন্নয়ন ও সুশাসন। এ দুটোর নিরিখেই মানুষ দেশের সরকারকে বিচার করে থাকে। যে কোনো শিক্ষিত, সচেতন ও বিবেকবান মানুষ স্বীকার করবেন, শেখ হাসিনা সরকার গত প্রায় ১২ বছরে দেশকে সত্যিকার উন্নয়নের পথে ধাবিত করেছে।
আমরা উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে চলতে শুরু করেছি। এটা যেমন সরকার বলে, তেমনি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোও বলে থাকে। আর আমরা যারা এ দেশে বাস করি, তারা নিজরাও দেখি। সবকিছু সঠিকভাবে চলছে, তা বলা যাবে না; তবে সার্বিকভাবে বলতে গেলে বলতে হবে, দেশব্যাপী উন্নয়নের এক বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে। এ বিরাট এবং মহতী প্রচেষ্টা এবং তার পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতাকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারা যায় না।
আমাদের মতো দেশে দেশপ্রেমিক, সৎ এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ। কোনো মানুষই ফেরেশতা নয়। কাউকে মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করে তাকে স্বেচ্ছাচারী করে তোলাও হবে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। তবে যার যা পাওনা, তা তাকে দিতে হবে। এ পর্যন্ত উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় মানুষ সন্তুষ্ট, এ কথা বলা যায়।
আমাদের মতো দরিদ্র দেশে সৎ, দেশপ্রেমিক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব যে বেজায় দরকার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিগত প্রায় এক যুগ ধরে যে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে, তাতে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের একটি রোল মডেল বা অনুকরণীয় আদর্শ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের কাছে উন্নয়নের মানে হচ্ছে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষার মতো মৌলিক প্রয়োজনীয়তাগুলোর অভাব থেকে যে যাতনা আমাদের নিরন্তর পোহাতে হয়; উন্নয়ন তার ছোবল থেকে রেহাই দেবে। ফলে আমরা সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের মুখ দেখব। ‘দারিদ্র্য সব অপরাধের জননী’ বলেছেন একজন পশ্চিমা মনীষী। আমার মতে, দারিদ্র্য আমাদের সুস্থ জীবনযাপন এবং সুষ্ঠু মানবিক বিকাশের বড় শত্রু। এর বিতাড়ন ছাড়া আমাদের মুক্তি নেই। উন্নত জীবনযাপনের উপায় নেই। মহৎ মানবিক বিকাশের সুযোগ নেই। আর শুধু উন্নয়নই একে বিতাড়িত করতে পারে।
উন্নয়নের কথা বলা আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের একটি ফ্যাশন ও লোকভোলানো স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নকে শুধু কথায় নয়, কাজেও বাস্তবায়ন করে চলেছেন; এটাই মানুষকে মুগ্ধ করেছে। সম্প্রতি তিনি অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নের দিকেও মনোনিবেশ করেছেন। তার সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিমান, যা ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মাধ্যমে শুরু- তা দেশবাসীকে আশান্বিত করেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, দুর্নীতি-সন্ত্রাস যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে, তেমনি সামাজিক উন্নয়নকেও ব্যাহত করে।
বস্তুত উন্নয়ন সমাজবদ্ধ মানুষের জন্য। সত্যিকার উন্নয়ন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের সম্মিলিত ফলন। ধরা যাক দুর্নীতির কথা, যা দেশবাসীর জীবনে এক বিরাট অভিশাপ। এর অর্থনৈতিক কুফল হচ্ছে, এসব সামাজিক অনাচার আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতির বিরাট ক্ষতি করে। বিশ্বব্যাংকের মতে, দুর্নীতি আমাদের বার্ষিক জিডিপি বা মোট উৎপাদনের ২.৫০ থেকে ৩ শতাংশ নষ্ট করে। এ সামাজিক ব্যাধি শুধু অর্থনীতি নয়, সামাজিক উন্নয়নেরও মহাক্ষতি করে। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত জাতি নৈতিকভাবে অধঃপতিত। সে জাতি উন্নত এবং সভ্য জাতি বলে দাবি করতে পারে না; বিশ্ব সভায় সামান্যভাবেও মর্যাদার আসন লাভ করতে পারে না। উন্নয়নের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হল, একটি সভ্য জাতি গঠন ও সৃষ্টি।
চলমান দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিমান তাই দেশবাসীর জীবনে এক শুভসূচনা। এর ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের দাপট হ্রাস পাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। আলোচ্য শুদ্ধি অভিযানে বেশকিছু ‘দেশ-ডাকাতের’ সন্ত্রাস এবং দুর্নীতির যে অবিশ্বাস্য এবং রোমাঞ্চকর কর্মকাণ্ড ও বিপুল ধনসম্পদের বিবরণ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা মানুষের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে। দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের কথা মানুষ জানত।
কিন্তু এর ভয়াবহতার বাস্তব একটি চিত্র এতদিনে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে। ক্যাসিনো বাণিজ্যের আড়ালে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য, মাদক ব্যবসা, গুম, খুন ও দখল বাণিজ্যের মতো হরেক রকম অন্যায় এবং অবৈধ পথে কিছুসংখ্যক মানুষ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে- এ সত্যটি মানুষের কাছে স্পষ্ট ছিল না। এ মানুষগুলো কারা এবং এদের মদদদানকারী রাজনীতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদেরও বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেটাও কম কথা নয়। সুশাসন ও আইনের শাসনের অভাবের মূলনায়করা যে কিছুসংখ্যক রাজনীতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা, তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।
তাই দোষী রাজনীতিক এবং আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রীর এ ‘শুদ্ধি’ অভিযান মানুষকে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত ও আশান্বিত করেছে। গত কয়েক মাস ধরে তিনি প্রকাশ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনের কথা যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি তার নৈতিক শক্তি, দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি ভালোবাসারই পরিচয় বহন করছে।
‘চুরির টাকায় বিরিয়ানি খাওয়ার চেয়ে সৎ আয়ে নুনভাত খাওয়া ভালো’ বা ‘চুরির টাকায় ভোগবিলাস সহ্য করা হবে না’ জাতীয় বক্তব্যগুলো এমন স্পষ্টভাবে আর কোনো প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়নি। এ মহতী উদ্যোগের জন্য তাকে যেমন ধন্যবাদ জানাতে হয়, তেমনি চাই দুর্নীতি, অসততা ও অনিয়মের বিরোধিতা জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পাক। বিশেষ করে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করুক। সরকারি অফিসে অফিসে মানুষ ঘুষ-দুর্নীতির কারণে হেনস্তা না হয়ে ন্যায্য সেবা পাওয়াটা নিয়ম হয়ে দাঁড়াক।
শেষ করার আগে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের একটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করব; সেটা হল, দেশে বিরাজমান ও ক্রমবর্ধমান ধন-বৈষম্য। এটি সরকারি পরিসংখ্যানে যেমন প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনগুলোতেও তা প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে সবচেয়ে গরিব ২০ লাখ পরিবারের মাসিক গড় আয় ৭৪৬ টাকা এবং সবচেয়ে ধনী ২০ লাখ পরিবারের মাসিক গড় আয় ৮৯ হাজার টাকা। যার অর্থ হল, উপরোক্ত গরিবের তুলনায় ধনী পরিবারের আয় ১১৯ গুণ বেশি।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির নিরিখে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে; কিন্তু সে উন্নয়নের সুফল সবাই সমানভাবে পাচ্ছে না। বরঞ্চ পাচ্ছে বিরাট অসমান বা বৈষম্যমূলকভাবে। এর ফলে দেশে যে মুষ্টিমেয় ধনিক-বণিকের সৃষ্টি হচ্ছে, তাদেরকে জাতীয় বুর্জোয়াও বলা যায় না। জাতীয় বুর্জোয়ারা তাদের ধন দেশে বিনিয়োগ করে। কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় ও কর্মসংস্থান হয়। আমাদের নব্যধনিক গোষ্ঠী মুৎসুদ্ধি বুর্জোয়া। তারা দেশের ধন বিদেশে পাচার করে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার মতে, বাংলাদেশে যত কর ও রাজস্ব আদায় হয়, তার ৩৬ শতাংশের সমান টাকা বিদেশে পাচার হয়।
এ হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। তাই এ ধনীদের দেশপ্রেমিক বলা যায় না। প্রকৃত দেশপ্রেমিক হল এ দেশের খেটে খাওয়া গরিব মানুষ; যাদের মধ্যে প্রধান হল কৃষক, শ্রমিক (বিশেষ করে গার্মেন্ট শ্রমিক) এবং প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা। গরিব মানুষের কল্যাণে সরকার ব্যয় এবং বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশে বিরাজমান ধন-বৈষম্য হ্রাস করুক, এটাই আমাদের দাবি।
সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় এ দেশের খেটে খাওয়া গরিব মানুষের কল্যাণের বিষয়টি যাতে প্রাধান্য পায়, এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কয়েক বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন পণ্ডিত অধ্যাপকের Why Nations Fail বইটি বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগিয়েছিল। তাদের মূল বক্তব্য ছিল, একটি জাতি অসফল বা ব্যর্থ হয় নেতৃত্বের কারণে। সৎ, দেশপ্রেমিক ও দক্ষ নেতৃত্বই আমাদের মতো একটি দেশকে সফল করতে পারে; অর্থাৎ উন্নয়নের মাধ্যমে দেশবাসীর দারিদ্র্য বিমোচনের ফলে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন উপহার দিতে পারে। জাতি এ ধরনের নেতৃত্বই চায়।
মো. মইনুল ইসলাম : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়