জয় বাংলা শুধু স্লোগান নয় একটি দর্শনও
মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ১০ ডিসেম্বর বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি এএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে হাইকোর্ট এক অভিমত প্রকাশ করেন যে, ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহার হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ অভিমত একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে। বইপত্র ঘেঁটে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, ১৯৬৯ সাল থেকেই জয় বাংলা স্লোগান ব্যবহার শুরু হয়।
১৯৭০-এর নির্বাচনকালে বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিটি জনসভায় জয় বাংলা বলেছেন। নির্বাচনের পর ১৯৭১-এর ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন যখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন জয় বাংলার বহুল ব্যবহার শুরু হয়।
১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেষ করেন জয় বাংলা বলে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ শুরু করেন জয় বাংলা বলে। যুদ্ধের বিজয়োল্লাসও করেন জয় বাংলা বলে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর সব রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে জয় বাংলা বলেই বক্তব্য শেষ হয়।
মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ শুভেচ্ছা বিনিময়ও করেন জয় বাংলা বলে। এ কারণে ১৯৭১ সালের ১৩ মে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা জয় বাংলাকে কটাক্ষ করে সংবাদ ছাপে- ‘জয় বাংলা নামে নতুন ধর্মমত’।
এর মাধ্যমে সংগ্রাম সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়িয়ে দেয়। শিরোনামের পর এই পত্রিকা লেখে, ‘এ নতুন জাতির নাম হলো ‘জয় বাংলা’ জাত। তাদের কলেমা ও সালাম কালাম হল ‘জয় বাংলা’, তাদের দেশের নাম ‘বাংলাদেশ, তাদের ধর্মের নাম ‘বাঙালি ধর্ম’, এর প্রবর্তকের নাম দিয়েছে তারা বঙ্গবন্ধু।’
বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের পরও জয় বাংলা নিয়ে অপপ্রচার চলতে থাকে। বিশেষ করে ভাসানীর হক কথা কৌশলে জয় বাংলার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। তবুও বঙ্গবন্ধুর সরকার সব রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে জয় বাংলা বলে বক্তব্য শেষ করে।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খোন্দকার মোশতাক তার জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তৃতা ‘জিন্দাবাদ’ বলে শেষ করেন। অতঃপর জাসদও জয় বাংলা ছেড়ে দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে জয় বাংলার জায়গা জিন্দাবাদ দখল করে।
ব্যাপক অর্থে দেখলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হবে যে, এটি শুধু একটি স্লোগান বা শব্দের পরিবর্তন নয়, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সত্তা কীভাবে আবার পেছন দিকে চলে যায়, কীভাবে আবার পাকিস্তানি ভাবধারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে যে বাঙালির আবহমানকালের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য মুছে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সব মূল্যবোধকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে, তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
যতদূর মনে পড়ে, ১৯৯১-এ ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে শেখ হাসিনা একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘যারা জিন্দাবাদ স্লোগান দেয় তারা পাকিস্তানের সমর্থক।’
তখন এ নিয়ে অনেক প্রতিবাদ হয়েছিল। বর্তমান ১৪ দলীয় জোটের অনেকেই এর প্রতিবাদ করেছিলেন। একটা সময় দেখা যায়, আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী সংগঠন বা এর অনুসারী ছাড়া অন্য কেউ জয় বাংলা স্লোগান দেয় না; বরং জয় বাংলাকে ‘জয় হিন্দে’র সঙ্গে তুলনা করে এর মধ্যে হিন্দুয়ানির গন্ধ ছড়িয়ে দেয়া হয়।
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ নতুন করে জয় বাংলাকে ফিরিয়ে আনে। শাহবাগে আন্দোলন চলাকালে নতুন যে শিশুটি কথা বলতে শুরু করেছিল, তার মুখেও জয় বাংলা স্লোগান শোনা যায়। এ ছিল এক অন্যরকম বিপ্লব।
১৯৭১-এর পর মানুষের চেতনার জগতে এত বড় বিপ্লব আর হয়নি। অথচ এটি ছিল অস্ত্রশস্ত্রবিহীন একটি আন্দোলন। এরপর বাংলাদেশবিরোধী ছাড়া আর প্রায় সবাই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে।
‘জয় বাংলা’ একটি বাংলা শব্দ। ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি উর্দু। শব্দের প্রতি, ভাষার প্রতি কারও কোনো ঘৃণা বা আপত্তি থাকার কথা নয়। তাহলে জয় বাংলাকে নিয়ে এত ষড়যন্ত্র কেন? জয় বাংলা ভীতিই বা কেন? একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের সবকিছু আবর্তিত হয় তার ভাষাকে ঘিরে।
সে জন্য সর্বস্তরে বাংলা চালুর দাবি বহুকালের। এ জন্য আমাদের দেশের সব আদালতও বাংলায় রায় প্রদান করছেন। অথচ জয় বাংলা বললে তখন এর মধ্যে হিন্দুয়ানির গন্ধ পাওয়া যায়। আসলে আপত্তির বিষয়টি বোধহয় সেখানে নয়।
জয় বাংলা এক শক্তির নাম। জয় বাংলাকে পাকবাহিনী ভয় পেত। মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকাররা বলত ‘জয় বাংলা বাহিনী’। বাংলাদেশপন্থীদের বলত জয় বাংলার লোক। এ জন্য কোনো মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনী বা রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে তাকে জিন্দাবাদ বা নারায়ে তাকবির বলার জন্য শক্তি প্রয়োগ করত।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা অটল থাকতেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা জয় বাংলা বলে ঘাতকদের হাতে নিহত হয়েছেন। কিন্তু জিন্দাবাদ বলেননি। জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধুই ছিল তাদের প্রেরণার উৎস। তাই জীবন দিয়ে হলেও তারা জয় বাংলাকে ধারণ করেছে, রক্ষা করেছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এটিকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।
জয় বাংলা মূলত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্লোগান। জয় বাংলা মানে বিজয়ী বাংলা। অর্থাৎ বাংলা-বাঙালি কখনও পরাজিত হতে পারে না। বাঙালির বিজয় ঘণ্টা বাজবে সর্বত্র, সর্বক্ষণ। বাঙালি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, শিল্পে এগিয়ে যাবে, শিক্ষায় অগ্রগামী হবে- এই হল জয় বাংলার মর্মার্থ।
বাঙালি কোথাও পিছিয়ে থাকবে না; বাঙালির কণ্ঠ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে- এটাই জয় বাংলার মূল কথা। জয় বাংলা অর্থ ‘বাংলার জয় হোক’, ‘বাঙালির জয় হোক’। জয় বাংলা নজরুলের ‘ভাঙ্গার গান’ কবিতার ছত্রে উদ্ধৃত।
তিনি বিপ্লবী পূর্ণ চন্দ্র দাসের উদ্দেশ্যে [যতদূর মনে পড়ে] কবিতাটি রচনা করেন। অথচ এখন নজরুলকে যারা ইসলামী কবি বলছেন, তারা জয় বাংলার বিরোধিতা করেন কেন? তার কারণ তারা বাঙালির রাষ্ট্রে বিশ্বাসী নন।
অথচ তুর্কিদের রাষ্ট্র আছে, আরবদের রাষ্ট্র আছে, গ্রিক, ফরাসি ও জার্মানদের রাষ্ট্র আছে। কিন্তু জয় বাংলাবিরোধী গোষ্ঠী বাঙালির রাষ্ট্র চায় না, কারণ তারা তাঁবেদারি পছন্দ করে। তারা রাজাকার হতে চায়, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হতে চায় না। এ জন্যই তাদের জয় বাংলা ভীতি।
জয় বাংলা মানে বিদ্যাসাগর, রামমোহন আর বঙ্কিম চন্দ্র; জয় বাংলা মানে লালন-হাছন আর বিজয় সরকার; জয় বাংলা মানে বিষাদ সিন্ধু আর বনলতা সেন; জয় বাংলা মানে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওইয়া; জয় বাংলা মানে ডিএল রায় আর রজনীকান্ত; জয় বাংলা মানে তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা; জয় বাংলা মানে ‘কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।’
জয় বাংলা অর্থ সমস্ত নৈরাজ্য থেকে নিয়মের দিকে, সকল পশ্চাৎপদতা থেকে অগ্রসরতার দিকে, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এবং নিরাশা থেকে আশা ও স্বপ্নের দিকে বাঙালির এগিয়ে যাওয়া।
জয় বাংলা মানে কৃষকের গোলাভরা ধান ও গোয়ালভরা গরু, জয় বাংলা মানে দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে সমৃদ্ধির পথ রচনা করা। জয় বাংলা হল রক্ষণশীলতা ও কূপমণ্ডূকতা থেকে উদারতার দিকে অগ্রসর হওয়া। জয় বাংলার অর্থ কৃষকের ক্ষেতে সোনালি ধান, কুলকুল রবে মাঝির নৌকা বেয়ে যাওয়া।
জয় বাংলা মানে মোটা ভাত, মোটা কাপড় আর বিদ্যুতের আলোয় বসবাস। জয় বাংলা মানে প্রশস্ত পদ্মার ওপর এক বিশাল সেতু, জয় বাংলা মানে ভাঙাচোরা রাস্তার পরিবর্তে সুদৃশ্য চারলেন। জয় বাংলা মানে যানজটহীন ঢাকা শহর।
জয় বাংলা মানে বাংলাদেশ থেকে নিমিষেই আমেরিকার সঙ্গে কথা বলা। জয় বাংলা মানে ইন্টারনেটে যা চাই, তাই পাই। জয় বাংলা মানে হাতের মুঠোয় পৃথিবী। জয় বাংলা মানেই ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং জয় বাংলাই মূলত রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা। অতএব, জয় বাংলার ক্ষয় নেই।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়