বিশ্বসমাজ, ঐতিহ্য ও রাজনীতির ভূগোলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভিষেক নানা মানদণ্ডে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সুস্পষ্ট আদর্শ ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে স্থির করে সর্বাত্মক ত্যাগের মধ্য দিয়ে কীভাবে একটি নিয়মতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলন স্বাধীনতার শ্রেয়তর ধারণাকে মূর্ত করে তুলতে পারে- এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ’৪৮-৭১ পর্যন্ত বাঙালির রাজনৈতিক অনুশীলনের কেতাবি ধারাপথ।
নতুন এ উদার, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি বা গর্ভকাল আরও যে কারণে ইতিহাস পরিক্রমার পথে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে- তা হল অসাধারণ নেতৃত্বের মুগ্ধতা, দুর্ভেদ্য সামাজিক ঐক্য আর অতুলনীয় দেশপ্রেম।
শিক্ষা-মননে অনগ্রসর, বঞ্চনা-শোষণে জর্জরিত একটি জনগোষ্ঠীকে জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার নানা চড়াই পার করিয়ে মুক্তির সৌধে পৌঁছে দেয়ার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে অতিব্যক্তিক সত্তার প্রস্ফুরণ ঘটেছে, তা মানব ইতিহাসের এক দুর্লভ আবিষ্কার।
ধর্মীয় বিভাজনের অক্ষরেখায় জন্ম নেয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের দার্শনিক বিচ্যুতি থেকে মুক্ত হয়ে ন্যায় ও সমতাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতিগঠনের পথে যেভাবে বিশ্বমানচিত্রে একটা দুর্দান্ত ভাষাগোষ্ঠীর সপ্রাণ আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তা-ও ইতিহাসের একজন পাঠকের অন্তহীন কৌতূহলের উৎস হয়েই থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধকালে ৩০ লাখ বাঙালির নৃশংস গণহত্যা, নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিচারে অকথ্য নির্যাতন, ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি, ১ কোটি দুর্গত মানুষের প্রতিবেশী দেশে উদ্বাস্তু হওয়ার মতো যে ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় গোটা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে, তা-ও অসভ্যতা, বর্বরতা, পাষণ্ডতা, নিষ্ঠুরতায় মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল। তবে নিয়তির পরিহাস, ইতিহাস লেখা
মুক্তিদূত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রক্তেই রঞ্জিত হয়েছিল সদ্যস্বাধীন হওয়া বাংলার পবিত্র এ মাটি। অকৃতজ্ঞতা ও নৈতিক ভ্রষ্টাচারের এ-ও বোধহয় এক নজিরবিহীন কলঙ্কতিলক।
আর স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আজও বাঙালির গভীর দীর্ঘশ্বাস- বঙ্গবন্ধুকে যদি পঁচাত্তরের অভিশপ্ত রাতে পৈশাচিক বর্বরতায় হত্যা করা না হতো- তবে এ দেশ আজ হয়তো এতদিনে সোনার বাংলায় পরিণত হতো।
চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান বা কোরিয়ার উন্নয়ন উপাখ্যান-বাঙালির স্বপ্নসফরের পথনকশা হতো না। এটা ঠিক যে, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে শুধু কপর্দক শূন্য করে রেখে যায়নি, দেশের রাস্তাঘাট, শিল্প-সেতু, ব্যাংক-বীমা, বাণিজ্য-বিপণি- সবকিছুই নারকীয় ও পরিকল্পিত তাণ্ডবের মুখে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।
এমন একটি বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন আপৎকালীন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালে লালিত সাম্যের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে পরিকল্পিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন অস্বাভাবিক দ্রুততায়।
সামাজিক ন্যায়, বৈষম্য নিরসন, আধুনিক ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন- এমনকি জাতিগোষ্ঠীর মানস গঠনেও ভূমিকা রেখেছিলেন।
বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও তার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও আন্তর্জাতিকতাবোধ দেশকে সম্ভাবনার এক রুপালি দিগন্তের সন্ধান দিয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ড বিশ্বের সমগ্র বাঙালি জাতিকে শুধু শোকস্তব্ধ করেনি, দেশকে আদর্শিকভাবে উল্টোপথে চালিত করেছিল।
২১ বছরের শীতনিদ্রার পর বাংলার সংগ্রামী জনতা আবার আপন ছন্দে মুক্তির সোপানতলে, উন্নয়নের অভিসারে দুরন্ত, দুর্বার। দেশের স্বপ্ন আজ আকাশছোঁয়া, ২০৩০ থেকে ’৪১ হয়ে ২১০০ অবধি আমাদের চিত্রকল্পের প্রলম্বিত বিস্তার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলা কষ্টকল্পনা নয়; তবে বাঙালির এ ইতিহাসযাত্রায় বাধাগুলোকে শনাক্ত করা ও জয় করাই সমসময়ের বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ।
যে ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই, তা হল দেশের মানুষের সক্ষমতা, সামর্থ্য বেড়েছে। জীবনযাত্রায় উন্নতি নজর কাড়ছে সর্বত্র। দারিদ্র্য নিরসন, সামাজিক নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন, মা-শিশুর স্বাস্থ্য, সর্বজনীন শিক্ষা, ট্রান্সজেন্ডার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মর্যাদা বৃদ্ধি বিশেষ করে প্রতিবন্ধিতাকে জয় করায় মদদ দিয়েছে রাষ্ট্র।
পরিসংখ্যান বলে নাগরিকের মাথাপিছু আয়, ক্রয়ক্ষমতা, জাতীয় উৎপাদন, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। অর্থনীতির আকার বর্ধনশীল, সম্ভাবনার পরিধি ক্রমশ প্রসারমান। বিদ্যুৎসেবার নাগালে এখন প্রায় পুরো দেশ।
কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ কিংবা ব্যবস্থাপনা- প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিশ্বজনীন। অপ্রচলিত জ্বালানির উৎস সন্ধানে পরমাণু প্রযুক্তির বিস্তার, মহাকাশ গবেষণা, সমুদ্র সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার, অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, বন্দরের নাব্যতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি অনাগত ভবিষ্যতের জন্য অযুত সম্ভাবনা তৈরি করছে।
পদ্মা সেতু-মেট্রোরেল-এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, নৌ-সড়ক ও বিশেষ করে দেশব্যাপী রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনে বৈপ্লবিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে দেশ। আগামী দিনের বিশ্ব ব্যবস্থা ও কাজের প্রকৃতির কথা আমলে এনে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনে দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উত্তরপর্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দাপট অনিবার্য। এ সন্ধিক্ষণে গতানুগতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ জনশক্তি যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে না পড়ে, সেজন্য প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার পরিসরকে উর্বর রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে দেশের সাফল্য অনেক। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সীমান্তচুক্তি, রোহিঙ্গা বা এনআরসি ইস্যুতে জাতীয় উদ্বেগকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেয়া ও জলসীমা নির্ধারণ করার মতো সাফল্য অবশ্যই অসাধারণ অর্জন। আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এত মর্যাদার, এত সম্মানের কখনই ছিল না- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
যে চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের উন্নয়নের স্রোতকে শ্লথ করে তুলছে, তা যথেষ্ট মনোযোগ দাবি করে। প্রধানত আজ যে সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে, তা নিঃসন্দেহে দুর্নীতি। আর এ দুর্নীতির চরিত্রেও বৈচিত্র্য আছে। আদর্শিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, মতলববাজি, ভোগবাদী ও কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার জন্ম দেয়।
স্বল্পতম বিনিয়োগে সর্বনিু সময়ে সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের মোহ মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। মুক্তবাজার অর্থনীতি এমন মানসিকতার সৃজনক্ষেত্র বলে ধরে নেয়া হলেও দেখা গেছে নিয়ন্ত্রিত অর্থব্যবস্থায়ও মানুষের আদিম যে প্রবৃত্তি জাগতিক লালসাকে উসকে দেয়- তাকে প্রশমিত করা যায়নি।
আবার অনেক কল্যাণ রাষ্ট্র আছে যেখানে অর্থনীতি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নয়, সেখানে দুর্নীতির আকার খুবই নগণ্য। আবার অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আছে, যেখানে দুর্নীতি আছে, শাসনও আছে। আসলে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে দুর্নীতি বা অপরাধ করার প্রবণতা কমে আসতে বাধ্য। অপরাধী দায়মুক্তি পেলে সমাজের কাছে ভুল বার্তা যায়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দুর্নীতির আরেকটি রূপ কপটতা। সে চেহারাটি খুবই বিভ্রান্তিকর। অর্থাৎ মানুষ এককভাবে বা গোষ্ঠীগতভাবে মুখোশ পরে অভিনয় করে। মুখে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের কথা বলে। মনেপ্রাণে ভোগ ও কর্তৃত্বের পক্ষে থাকে।
প্রকাশ্যে ধর্মনিরপেক্ষ সাজলেও প্রকৃতপক্ষে নিজ দেশে সে আদর্শের প্রতিফলন দেখতে চান না। পার্বত্য চট্টগ্রাম, আসাম, মিয়ানমার বা কাশ্মীর- অভিন্ন ইস্যুতে স্থানভেদে অবস্থান বদল নিঃসন্দেহে একটি আদর্শিক দ্বিচারিতার নিদর্শন।
অর্থাৎ ব্যক্তিমানুষ অন্যের ক্ষেত্রে যে নীতির প্রয়োগ দেখতে চান, নিজের জন্য তা চান না। কখনও আঞ্চলিক সত্তা, কখনও ধর্মীয় পরিচিতি, কখনও আদর্শিক অবস্থানকে আমরা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করি। ব্যক্তিজীবনে এ সুবিধাবাদী চরিত্র যখন গোষ্ঠী বা সমাজকে আক্রান্ত করে, তখন সংকট গভীর আকার ধারণ করে।
সমাজের ভেতর বেশকিছু পরিবর্তন ঘটে চলেছে এ মুহূর্তে। আর্থিক সামর্থ্য, ক্ষমতার বিন্যাস, নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি- সর্বত্রই এ রূপান্তর ঘটছে। মানুষের এ ক্ষমতায়ন বিশেষ করে বৈষয়িক সক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয়েছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে অন্তত সীমিত একটি শ্রেণির ক্ষেত্রে।
হঠাৎ বিত্তের মালিক হওয়া নব্য ধনিক শ্রেণির আরও ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা ক্রমাগত বেড়েছে, লালসা দায়িত্বশীলতাকে চূর্ণ-বিচুর্ণ করেছে। সে পরিবারের দিকে উদাসীন, সমাজের দিকে তো বটেই। প্রতিযোগিতা, অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সে অন্ধ।
নিকট অতীতে যে বিত্তশালী সামন্তশ্রেণি এ অবস্থার সুবিধা পেয়েছিল তারা বিত্তের অধিকার লাভ করেছিল দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে; হঠাৎ করে নয়। ফলে সে বিত্তের চুঁইয়ে পড়া সুবিধা নাগরিক পেয়েছে। কিন্তু এখন সেটি ঘটছে না।
গগনভেদী উচ্চাকাক্সক্ষা সমাজে অস্থিরতার একটি কারণ। আর্থিক সামর্থ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার গাণিতিক ব্যবধান অনেক সংকটের সূত্রপাত ঘটিয়েছে বলে মনে হয়।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান সমাজমননের আরেকটি ক্ষতচিহ্ন তুলে ধরছে। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বর্তমান সময়টা খুব সুবিধার নয়। দেশের শিশু থেকে পরিণত বয়স্ক- বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্ন।
যৌথ পরিবারে ভাঙন, একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা, স্বার্থপরতা, সম্পদের প্রতি সীমাহীন লালসা এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতা- এমন বিকৃতির পেছনে এ ধরনের নানা কারণ চিহ্নিত হচ্ছে। হিংসা, খুন অথবা আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। শিক্ষার্থী নিগ্রহ বা অমানবিক আচরণ এমনকি নজিরবিহীন নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য কথাচ্ছলে রাজনীতি করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে উদ্ভূত মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্য থেকে রাজনীতি সম্পর্কে সমাজের সমকালীন ধারণার আভাস পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে সমাজ বুননের পরিবর্তন মানুষের চাহিদা ও প্রত্যাশার ধরনকেও পাল্টে ফেলে।
মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা দেখেছি, রাজনীতিকে মানুষ মহত্তম একটা ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিল; সে পরিসরে ত্যাগ, আদর্শ, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কর্তৃত্ব প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী বা নির্লোভ মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের দাপট রাজনীতির পরিমণ্ডলে অপ্রতিরোধ্য ছিল।
কিন্তু আজ রাজনীতি শব্দটি আমাদের মনোজগৎকে ক্রমাগত নেতিবাচক ধারণায় আচ্ছন্ন করে। অথচ গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতিই নীতিনির্ধারণ করবে, দেশ পরিচালনা করবে, দেশকে এগিয়ে নেবে।
তাহলে একজন শিক্ষক কেন রাজনীতির অঙ্গনে এমনভাবে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাবেন। কেন আমরা আইডিয়ালিস্টিক্যালি ধরে নিচ্ছি রাজনীতি একটি অচ্ছুত, অস্পৃশ্য ও ভ্রষ্ট অনুশীলন।
অবশ্যই ভিসি পদ বিশেষ ভার ও গরিমার আধার; কিন্তু রাজনীতি করতে চাইলেই তিনি পতিত হবেন- এ সমাজ যদি রাজনীতিচর্চাকে এমন দৃষ্টিতে দেখতে চায়, তবে তা কখনই পরিণত গণতন্ত্রের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না।
দেশের অর্থনৈতিক সূচকে এগিয়ে থাকার বিষয়ে কারও মনে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে আয় ও সম্পদের বণ্টনে বৈষম্যের বিষয়টি আজ খুবই আলোচিত একটি বিষয়। ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহরভেদে নাগরিকদের মাঝে সুযোগের বৈষম্য এখনও প্রকটভাবে বিদ্যমান। রাষ্ট্রীয় সেবার নিরঙ্কুশ সুবিধা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পায় না।
অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অভিঘাতও এ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপরই আছড়ে পড়ে। সাধারণ মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবী রাষ্ট্রের কর জালের আওতায়। অথচ অতি ধনী, ব্যবসায়ী এমনকি ঋণখেলাপিরা পর্যন্ত সঠিক প্রযোজ্য করের আওতামুক্ত।
জনসংখ্যার আকারের তুলনায় করদাতার সংখ্যাও নগণ্য। দুর্নীতি, অপচয় ও কর ফাঁকির সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারলে দেশ লাভবান হবে। উন্নয়ন হবে বেগবান। আর্থিক ব্যবস্থাপনা সঠিক হলে এ বাড়তি সুবিধা পৌঁছে যেতে পারে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নাগালে।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের পথে শ্রেণি-লিঙ্গ-বর্ণ-বর্গ নির্বিশেষে ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’- এমন অন্তর্ভুক্তি ও বহুত্বের দর্শনকে ধারণ করে সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে দেশকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন বিশেষ করে শিশুমৃত্যুর হার কমে আসায় গড় আয়ু বেড়েছে।
ফলে আগামী দিনে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বর্ধিত আকার যাতে দেশের জন্য বোঝা না হয়ে জাতীয় অগ্রগতিতে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে তার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। দেশের বিশাল তারুণ্যকে আগামী দিনে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির উপভোক্তা হিসেবে তৈরি করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর বাজারের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।
পরিবর্তনশীল জলবায়ু উপকূলীয় জনপদে জীবনধারণের জন্য কী ধরনের হুমকি সৃষ্টি করতে পারে, সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞান এবং সে দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি রাখতে হবে। সমকালীন বিশ্বে জঙ্গিবাদ ও মাদকাসক্তি সভ্যতার জন্য একটি নতুন সংকট বয়ে আনতে পারে।
বিশ্বব্যাপী মৌলবাদ, ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার বিস্তার সামাজিক সংহতি ও বৈশ্বিক স্থিতি বজায় রাখার পরিবেশকে ক্রমাগত বিষাক্ত করে তুলছে। আগামী দিনে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় উগ্রবাদ আদর্শিকভাবে মোকাবেলার জন্য ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ বা কৌশলী কর্মপরিকল্পনা জরুরি।
মানবিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার পক্ষে এখন বিশ্বজনমত জোরাল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিকানায় আজ শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অংশীদারিত্ব স্বীকৃত। কেন্দ্রীভূত পুঁজির বিকেন্দ্রীকরণ এখন সময়ের চাহিদা।
মতপথ, ধর্মবর্ণ, নারী-পুরুষ- সবার অংশগ্রহণে একটি সহিষ্ণু, স্বনির্ভর, সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আগ্রাসী অতিজাতীয়তা নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন; মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদতা নয়; উদার ও জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বজনীনতাই হোক এবারের বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।
অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ
principalffmmc@gmail.com