
প্রিন্ট: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪৩ পিএম
আর নয় সাপের কামড়ে মৃত্যু

সালাহ্ উদ্দিন নাগরী
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
সাপ নিয়ে মানুষের ভীতি, আতঙ্ক, উচ্ছ্বাস ও কৌতূহলের শেষ নেই। তাই তো কত ধরনের নাগ-নাগিনি আমাদের গল্প, সাহিত্য ও সিনেমার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। কত শ্রুতিকথা যুগ যুগ ধরে আমাদের মন-মননে গেড়ে বসেছে।
সে জন্য অনেকেই ঘরের আশপাশে সুগন্ধি ফুলের গাছ লাগাতে ভয় পায়, পাছে ফুলের গন্ধে যদি সাপ আসে। এখনও বিভিন্ন জায়গায় বাঁশি বাজিয়ে সাপের যে খেলা সাপুড়ে ও বেদেরা দেখিয়ে বেড়ায়, সাপ তার কিছুই শুনতে পায় না।
প্রকৃতপক্ষে সাপের দৃষ্টি, শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। আধুনিক শিক্ষিতরাও সাপে কাটলে ওঝা খোঁজে, ঝাড়ফুঁক ও পানিপড়া নেয়। ওঝা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিষ নামায়, তারপর ব্যর্থ হয়ে হাসপাতালে পৌঁছলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে। এ ধরনের অজস্র উদাহরণের পরও মানুষ বারবার ডাক্তারের পরিবর্তে তাদের শরণাপন্ন হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনমতে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে প্রায় ২৫-২৭ লাখ মানুষের শরীরে বিষ প্রবেশে প্রায় দেড় লাখের মৃত্যু ও প্রায় ৫ লাখ অন্ধ ও চিরস্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ছেন। খোদ ভারতেই বছরে সাপের কামড়ে মৃত্যু ঘটে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের। আফ্রিকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাপে কামড়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়।
গ্রামের বাঁশ, খড়, কাঠের বাসাবাড়িতে বসবাসকারী, খোলা আকাশের নিচে প্রাকৃতিক কর্মসম্পন্নকারী জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জনৈক কর্মকর্তা ড. উইলিয়াম, যিনি নিজে ৫ বার সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে এখনও গবেষণা করছেন, তার মতে, যাদের সাপে কাটে তারা এমনিতেই দরিদ্র এলাকার মানুষ। আর সাপে কাটার পর, যদি তারা বেঁচে থাকার মতো সৌভাগ্যবান হন, তবে তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। সাপ যত বিষাক্তই হোক না কেন, এর কামড়ে কারও মৃত্যু হওয়ার কথা নয়, যদি সময়মতো চিকিৎসা দেয়া যায়।
এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় নাগাপাড়া গ্রামে রাতের খাবার খেয়ে দু’ভাই শাহীন ও সোহান একই সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত অবস্থায় দু’ভাইকে সাপে কামড় দেয়, জ্বালাপোড়া শুরু হলে ঘুম থেকে উঠে ঘরের মধ্যে সাপ দেখতে পায়। তাদের উপজেলা হাসপাতালে নেয়ার পর অবস্থা খারাপ হলে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পথে এক ভাই এবং হাসপাতালে আরেক ভাইয়ের মৃত্যু হয়।
দেশে প্রতিবছর সাপের কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন ৭ লাখ মানুষ। আর এতে প্রতিদিন অন্তত ১৬-২০ জন মানুষ মারা যাচ্ছে, বছর শেষে সেই হিসাব ৬-৭ হাজারে গিয়ে ঠেকছে। বর্ষাকালে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে আনার পথে মৃত্যু ঘটে। গ্রামাঞ্চলে অ্যান্টিভেনম না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে মানুষজন বাধ্য হয়ে ওঝার শরণাপন্ন হচ্ছে। দেশে মাতৃমৃত্যু অপেক্ষা সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার বেশি।
অনেক মফস্বল এলাকায় জনগণকে ২৪ ঘণ্টাই সাপের আতঙ্কে থাকতে হয়। রাতের বেলা রাস্তাঘাটে চলাফেরা, নিজগৃহে ঘুমানো এবং ক্ষেত-খামারে ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয়। গ্রামীণ অঞ্চল যেখানে চিকিৎসা সুবিধা কম, সেখানে সর্প দংশন একটি সমস্যা। অথচ এত মানুষের শারীরিক ক্ষতি ও মৃত্যু হলেও বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সাপের কামড় হল সর্বোচ্চ অবহেলিত ‘ট্রপিক্যাল ডিজিজ’।
আমাদের দেশ অপেক্ষা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে আরও বেশি বিষাক্ত সাপ আছে। কিন্তু ওখানে সাপে কামড়ের সংখ্যা, পঙ্গুত্ববরণ ও মৃত্যু খুবই নগণ্য। কানাডায় বছরে প্রায় ১০০ লোককে সাপে কামড়ায়; কিন্তু মৃত্যুর হার শূন্য। বছরে ৭-৮ হাজার লোক সাপের কামড়ে আক্রান্ত হলেও আমেরিকায় মৃত্যু হয় ৪-৫ জনের মতো। তার কারণ ওদের বসবাসের এলাকা, বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কোনো ঘটনা ঘটে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে; তাই ওদের দেশগুলোতে এ ধরনের ক্যাজুয়ালটি খুবই কম।
পাপুয়া নিউগিনিতে ২০০৩ সালে প্রতি ৪ জনে ১ জন শিশু সাপের কামড়ে মারা যেত। এখন সেটা কমে প্রতি ৫০ জনে ১ জনের নিচে নেমে এসেছে। আমাদের দেশে এ হার কমিয়ে আনার জন্য দরকার নিরাপদ ও কার্যকরী অ্যান্টিভেনম এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত সরকারি-বেসরকারি সব ডাক্তারকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।
যেন সাপের প্রজাতি, কামড়ের ধরন বুঝে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা দিতে পারেন। কারণ যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে উচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরাও লাগসই চিকিৎসা দিতে অনেক সময় ব্যর্থ হন। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে ওইসব এলাকার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, স্কাউট, এনজিও ও মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাপেকাটা রোগী ব্যবস্থাপনার জন্য সব সময় প্রস্তুত ও তাদের কাছেও অ্যান্টিভেনম মজুদ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের দেশে সাপের কামড়ে সাধারণত কামড়ের স্থানের ওপর শক্ত করে কাপড় বা ফিতা দিয়ে বেঁধে, চুষে বা কেটে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের কাজ না করার জন্য যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস সতর্ক করেছে। ঘড়ি, অলংকার খুলে ফেলা ও কাপড়ের বাঁধন ঢিল করাসহ কামড়ের স্থান যতটা সম্ভব কম নাড়াচাড়া করার পরামর্শ দিয়েছে। সাপের কামড়ের ক্ষতির মাত্রা সাপটির প্রজাতির, বিষ প্রয়োগের পরিমাণ, যাকে কামড় দেয়া হয়েছে তার স্বাস্থ্যগত অবস্থা ও শরীরে কামড়ের স্থান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে সাপের কামড়ের পর অনুভূতি স্বাভাবিক রাখতে হবে।
সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে মানসিকভাবে অস্থির হয়ে যায়। বমি, পাতলা পায়খানা, মাথা ঘোরানো, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া অথবা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে। বিষের কারণে কিডনি অকার্যকর, প্রচুর রক্তক্ষরণ, শরীরের কোনো অঙ্গ নষ্ট ও অবশ হয়ে যাওয়াসহ অপরিবর্তনীয় টিস্যু ধ্বংস রোগীকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। অ্যান্টিভেনম আবিষ্কারের আগে বিষাক্ত সাপের কামড়ে মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ফরাসি চিকিৎসক আলবার্ট কেলমেট কর্তৃক ১৮৯৫ সালে অ্যান্টিভেনম আবিষ্কার সাপেকাটা লাখ লাখ রোগীকে নতুন জীবনের দিশা দিয়েছে।
দেশের সব জেলা-শহরের হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম মোটামুটি সরবরাহ করা গেলেও উপজেলা পর্যায়ে সব জায়গায় দেয়া যায়নি। বাংলাদেশে অ্যান্টিভেনম আনা হচ্ছে ভারত থেকে। কিন্তু ভারতের সাপের ধরন থেকে বাংলাদেশের সাপের ধরন কিছুটা ভিন্ন হওয়ায় সব ক্ষেত্রে কার্যকারিতা পাওয়া যায় না। সাধারণত কোনো এলাকায় যে ধরনের সাপের প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যায়, সে মোতাবেক অ্যান্টিভেনম তৈরি করার কথা। সংশ্লিষ্ট এলাকার চাহিদা মোতাবেক এর সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে বহু লোকের প্রাণ বাঁচানো যেত। এ জন্য এখন থেকে সাপের ধরনের কথা চিন্তা করে আমাদের অ্যান্টিভেনম তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। আশার কথা, প্রতিষেধক তৈরি ও শিক্ষার্থীদের গবেষণা সুবিধার্থে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেশে সাপের একমাত্র গবেষণাগার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, এখানে সাপ পালনের পাশাপাশি বিষ সংগ্রহ করা হবে। পরবর্তী সময়ে বিষ থেকে তৈরি হবে সাপের বিষের প্রতিষেধক। বিদেশ থেকে আনা সাপের বিষের প্রতিষেধক অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর না হওয়ায় এ গবেষণাগারের উদ্ভাবিত প্রতিষেধক আগামীতে কাজে লাগানো হবে।
আমাদের দেশে সাধারণত বর্ষায় সাপের উপদ্রব বাড়ে, তাই যেসব এলাকায় এ উপদ্রব বাড়ে, সেসব এলাকা চিহ্নিত করে সব রাস্তাঘাট, ক্ষেত-খামার, বাসবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা ও মানুষের চলাচলের রাস্তায় রাতের বেলা পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় সাপ বনজঙ্গল, গর্ত থেকে বসতবাড়ি বা ডাঙ্গায় আশ্রয় নেয়। তাই সার্বিক সতর্কতার অংশ হিসেবে কাঁচা ও মাটির বাড়ি, বাঁশ-কাঠের তৈরি সিলিং পরিষ্কার রাখা ও দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষের বাসাবাড়ির খড়-বাঁশের বেড়া, ছাউনি নিয়মিত রিপেয়ারে জিও-এনজিও সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বাসাবাড়ি, ক্ষেত-খামারে ইঁদুর ও অন্যান্য পোকামাকড় খাওয়ার জন্যও সাপ আসে, তাই স্থানীয় প্রশাসনকে ওইসব জায়গা ইঁদুরমুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
জেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বন অধিদফতর, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর ও বিভিন্ন এনজিও সমন্বয়ে সাপের প্রাদুর্ভাব বেশি এমন এলাকায় জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি ও করণীয় সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনের সুবিধা গ্রহণ ও গাইডলাইন তৈরি করে পুস্তিকা আকারে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রুত চিকিৎসা প্রদান ও বিষনাশক অ্যান্টিভেনম প্রয়োগই হল বিষধর সাপেকাটা রোগীকে বাঁচিয়ে তোলার একমাত্র পন্থা, এ কথাটি সবার মন-মগজে গেঁথে দিতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সাপে কামড়ের ঘটনাকে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার’ হিসেবে বিবেচনা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে সর্প দংশন ও প্রতিরোধের জন্য চারটি কর্মকৌশলের মাধ্যমে তিন ধাপে ২০৩০ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ মৃত্যু ও অক্ষমতা কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ কর্মযজ্ঞে সরকারি, বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী ও ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাসহ সবাইকে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। আমাদেরও সে যাত্রায় অতি দ্রুত শামিল হতে হবে। শীতকাল শুরু হচ্ছে, বর্ষা আসতে এখনও কয়েক মাস বাকি, তাই সাপের দংশন থেকে ভুক্তভোগী জনগণকে সুরক্ষার সর্বাত্মক প্রস্তুতির এখনই সময়।
সালাহ্ উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী
snagari2012@gmail.com