ইংরেজরা মোট ১৯০ বছর (১৭৫৭-১৯৪৭) এ উপমহাদেশ শাসন করেছে। আধুনিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের মতোই আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থারও গোড়াপত্তন হয় তাদেরই হাত দিয়ে। পলাশী যুদ্ধের পর একশ’ বছরের মাথায় তৈরি করে রেলপথ, শুরু হয় ট্রেন যোগাযোগ।
ইংরেজ বিদায়ের পর শুরু হয় পাকিস্তানি শাসন। আমরা অতিক্রম করে এসেছি ওদের ২৪ বছরের শোষণ-শাসনের অধ্যায়। আমাদের স্বাধীনতার বয়স এখন ৪৮। কিন্তু রেলসেবার মানের দিকে তাকালে মনে হয় আমরা সেকালেই রয়ে গেছি।
দু-চারটি সুন্দর-সুদৃশ্য ট্রেন, স্থাপনা, কর্মীদের পদ-পদবি-পদোন্নতি এবং বছর বছর বাজেটের কলেবর বৃদ্ধি ছাড়া উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন খুব একটা লক্ষ করা যায় না। মনে প্রশ্ন জাগে, দীর্ঘদিনের ইংরেজ ও পাকিস্তানি শাসনের পর ৪৮ বছরের স্বশাসনের মাথায় এসে রেল যোগাযোগ ও সেবার ক্ষেত্রে আমরা কতটা এগিয়েছি?
জায়গায় জায়গায় বলতে গেলে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে বিপত্তি, দুর্ঘটনা। সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে আসে এ সবকিছুর খবরাখবর। সব আবার প্রকাশও হয় না। দিনে দিনে সবকিছুই যেন আমাদের সহনীয় হয়ে পড়েছে। ১ ডিসেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল : ‘উনিশ থেকে বিশ হলেই আগুন। আয়ুষ্কালবিহীন ইঞ্জিন। বগিতে ঘটছে দুর্ঘটনা’।
উপশিরোনাম ছিল : ‘ইঞ্জিন বিকল নিত্যঘটনা। আতঙ্কে যাত্রীরা। বাড়ছে সিডিউল বিপর্যয়’। পত্রিকাটির তৃতীয় পাতায় তিন কলামের খবরটির সবিস্তার বর্ণনা করার আর প্রয়োজনবোধ করছি না। কারণ এমন সব খবরের সঙ্গে আমরা বহু আগে থেকেই কমবেশি পরিচিত এবং কোনো না কোনোভাবে ভুক্তভোগী।
১৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ সাল। সোমবার ২টা ৫০ মিনিটে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার একটি ক্লাস অনেকদিন ধরেই নির্ধারিত। কী একটা বিশেষ দরকারে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ সকালে জেলা সদর কিশোরগঞ্জে গিয়েছিলাম। মেয়েটি প্রথম শ্রেণির ছাত্রী আর ছেলেটি তখন কোলের শিশু। দুপুরে ফিরে আসার সময় ১২টা ৩০ মিনিটে আমাদের ট্রেনটি কিশোরগঞ্জ স্টেশন থেকে যথারীতি ছেড়ে আসে। আন্তঃনগর ট্রেন।
আমার হিসাবে কিশোরগঞ্জ থেকে এক ঘণ্টায় ট্রেনটি বাজিতপুর স্টেশনে আসবে আর ওখান থেকে রিকশায় ২০ বা বড়জোর ২৫ মিনিটে আমাদের বাসায় এসে পৌঁছা যাবে। অতএব সময়মতো শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করাটা আমার জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। ট্রেনের কামরায় আমরা সামনাসামনি আসনে বসা। পাশে বা আগে-পেছনের আসনগুলোতে বসা যাত্রীদের মধ্যে কাউকেই আমাদের পরিচিত বলে মনে হল না। তবে আমাদের লক্ষ করছেন কেউ কেউ।
ট্রেনটি যথাসময়ে মানিকখালী স্টেশনে এসে থামল। ছাড়তে বেশ দেরি হচ্ছে- এমনটি এ রুটে কখনও কখনও হয়েই থাকে, যে কারণে পাঁচ-দশ মিনিট লেট করার বিষয়টিকে যাত্রীরা খুব একটা আমলে নেন না। আমিও এতক্ষণ গা করিনি। এরই মাঝে শুনলাম, ইঞ্জিনে বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় যেন ভাঁজ পড়ে গেল। কারণ সারাক্ষণই মাথায় ‘২টা ৫০ মিনিট’-এর বিষয়টি কুরে কুরে খাচ্ছে। কী হবে আমার ক্লাসের! সাত-পাঁচ ভেবে বেশ অস্থির মন নিয়ে নামলাম।
অনেক যাত্রীই ট্রেন থেকে নামায় প্লাটফরমটি বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে আশপাশের কৌতূহলী লোকজনও এসে ভিড় জমায়। হঠাৎ আমার মাথায় এক বুদ্ধি এল। ক্লাসটির ব্যাপারে সহকর্মী তফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কেমন হয়। এ সময়টিতে তার অবসর এবং বাসায়ই থাকার কথা। তফাজ্জল সাহেবের মোবাইল ফোন আছে।
তখনও আমার নিজস্ব মোবাইল সেট হয়নি। খুব জরুরি প্রয়োজনে মোবাইলের দোকানে গিয়ে কথা বলতে হয়। তখন বন্যার প্রকোপে দেশের আনাচে-কানাচে থৈথৈ পানি। মানিকখালী স্টেশন লাগোয়া পেছনের রাস্তাটিতেও কাদা পানি। এরই মাঝে ট্রেন বিভ্রাটের আসল কারণটি জানা গেল।
ইঞ্জিনের চাকা ব্রেকের সঙ্গে লেগে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রেলকর্মীরা কাছের রিকশা মেরামতের দোকানে গিয়েছেন। ওখান থেকে রেঞ্জ এনে ঠিক করে ট্রেন সচল করা হবে- তারা জানান। এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রীকে বলে আমি ফোনের দোকানের সন্ধানে চলি। জুতাজোড়া ও মোজা খুলে এক হাতে এবং অন্য হাতে পরনের প্যান্ট উঁচিয়ে উঁচিয়ে যেতে যেতে বেশ দেরি হয়।
মোবাইলের দোকানের সন্ধানে হাঁটছি আর ভাবছি, আমার এখন কী করা উচিত- হাসা, নাকি কাদা! নিজের বিপত্তি যেমন-তেমন, একটি বিষয় মন থেকে কোনোভাবেই সরাতে পারছি না- আন্তঃনগর একটি ট্রেনের কয়েকশ’ যাত্রী দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। অনেকেরই সামনের সরারচর, বাজিতপুর ও কুলিয়ারচর স্টেশনে নেমে নির্ধারিত সময়ে লঞ্চ ধরার কথা।
এছাড়াও রয়েছে ভৈরববাজার জংশন থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট বা নোয়াখালীগামী সংযোগ ট্রেন ধরার বিষয়টিও। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, যাত্রী সাধারণের যার যার ব্যাপার। এদিকে অকুস্থল মানিকখালীতে কী হচ্ছে? চালক নামলেন। নামলেন ট্রেনের পরিচালকও। আর স্টেশনমাস্টার ও অন্যরা তো রয়েছেনই। তারা সবাই ক্রমে ব্যস্ত-ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। এটা-ওটা দেখে, নাড়াচাড়া করে অবশেষে রোগটি ধরতে পারলেন- ইঞ্জিনের চাকা ব্রেকের সঙ্গে লেগে যাওয়ায় বিপত্তিটির সৃষ্টি হয়েছে। সংগ্রহ করে রেঞ্জ আনা হল। ট্রেনও ছেড়ে গেল।
কিন্তু লেট (বিলম্ব) ঠিক এক ঘণ্টা (ষাট মিনিট)। যাত্রীরা বোধ করি এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নতুন করে সময়ের হিসাব কষছেন। আর এদিকে আমার বেলায়? ট্রেন ছাড়ার সংকেত দেখলাম নিজের চোখে, চালকের বাঁশির ফুঁ-ও শুনলাম নিজের কানেই। কেবল আমার সন্তান ও স্ত্রী নয়, মনে হল ট্রেনের সব যাত্রীই আমাকে লক্ষ করছেন, আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
কেউ কেউ হয়তো আমাকে বোকাসোকাও ভাবছেন মনে মনে। কিন্তু আমি গোবেচারা তখন একেবারেই নিরুপায়। মোবাইল ফোনে কথা সেরে কাদা ভেঙে কোনোরকমে প্লাটফরমে পৌঁছে চলন্ত ট্রেনের পেছন দিকটায় চেয়ে থাকি আর তা দেখতে দেখতে কেবল ছোট হতে থাকে।
এখানে আমি আমার জীবনে ট্রেন জার্নির একটি দিনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করলাম মাত্র। এ জার্নি বাই ট্রেন, জার্নি বাই বাস, জার্নি বাই বোট- স্কুলজীবনে বাংলা বা ইংরেজিতে এমন সব রচনা লেখার অভিজ্ঞতা বোধ করি সবারই আছে। রয়েছে এ নিয়ে একেকজনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। কারও কারও আমার চেয়ে ঢের বেশি বিড়ম্বনা, দুর্ভাগ্যজনক, এমনকি মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতাও রয়েছে।
কথা হচ্ছে, এত সবকিছুর প্রতিকার কী, করণীয়ই বা কী আমাদের? স্বাধীনতা লাভের ৪৮ বছর এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণা ও কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার এক দশক অতিবাহিত হতে চলেছে; কিন্তু কাজের কাজ কী হয়েছে? পরিতাপেরই বিষয় যে, এ দীর্ঘ সময়ে আমরা রেল যোগাযোগ ও সেবার ক্ষেত্রে, এমনকি ‘নটার ট্রেন কটায় ছাড়বে’- যুগ যুগ ধরে বহুল উচ্চারিত এমন প্রশ্নটিরও সমাধানে আসতে পারিনি!
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক