পার্বত্য শান্তি চুক্তির সুফল মিলছে

তাওহীদ মাহমুদ
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর পার্বত্য জেলায় দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান ও দেশের বিধিবিধান ও আইন যথাযথ অনুসরণ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বর্তমান সরকার বিগত বিশ বছরে শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। চুক্তির অবশিষ্ট ১৫টি ধারা আংশিক এবং ৯টি ধারা বর্তমানে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শান্তিচুক্তির আংশিক ও অবাস্তবায়িত ধারাগুলো বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য জেলায় শান্তি আনয়নের পাশাপাশি ওই এলাকায় অবকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধনের মাধ্যমে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানোন্নয়নে সরকার যথেষ্ট সচেষ্ট রয়েছে।
বর্তমান সরকারের শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ধারাগুলো দেখে নেয়া যাক:
১. ‘পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ এবং ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ গঠন করা হয়েছে।
২. ‘তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ’ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দফতর-সংস্থার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি হস্তান্তর করা হয়েছে।
৩. ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন।
৪. প্রত্যাগত ১২, ২২৩টি উপজাতি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
৫. শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা এবং ৭২৫ জনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
৬. শান্তিচুক্তির পরে ২৫২৪ জনের বিরুদ্ধে ৯৯৯টি মামলার তালিকার মধ্যে ৮৪৪টি মামলা যাচাই-বাছাই এবং এর মধ্যে ৭২০টি মামলা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া চলছে।
৭. একটি পদাতিক ব্রিগেডসহ ২৩৮টি নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে।
৮. সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে।
৯. পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে।
১০. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১১. বিভিন্ন দফতরে চাকরির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নির্ধারিত কোটা অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে।
১২. বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চরম প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
১৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় পদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।
১৪. পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মাননীয় সংসদ সদস্যকে প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদায় নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।
১৫. ১৯৯৮ সালে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে।
১৬. ১৯৭৬ সালে জারিকৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০১৪ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্থসামাজিকভাবেও অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ভূমিবিষয়ক আইন ও বিধিমালা ছিল না। এখন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০০১ প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়েছে যা চলমান রয়েছে। শান্তিচুক্তির পূর্বে যেখানে এডিপিভুক্ত প্রকল্প ছিল ১টি, এখন সেখানে ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। বর্তমানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন বাজেট দেয়া হয়েছে ৯১৫.৮৩ কোটি টাকা আগে (১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে) যা ছিল ৫০.৫৭ কোটি টাকা। ঢাকার বেইলি রোডে ১.৯৪ একর জমির ওপর ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স। শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলের জেলাগুলোয় স্বাস্থ্য খাতে দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে। পূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে কোনো মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ট্রেনিং ইন্সটিটিউট ও কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল না। বর্তমানে ট্রাইবাল স্বাস্থ্য কর্মসূচি ২০১১-১৬ মেয়াদে তিন পার্বত্য জেলায় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। শান্তিচুক্তির পূর্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম ছিল। শান্তিচুক্তির পর ১৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে উপজাতি ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ কোটার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতিবছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩২৫ জন উপজাতি ছাত্রছাত্রী বিশেষ কোটায় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। পাবলিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়েছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও বিশেষ কোটার ব্যবস্থা রয়েছে পার্বত্য উপজাতিদের জন্য। তিন পার্বত্য জেলায় ৮৭৯.৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদ্যুৎ বিতরণ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিন জেলায় এ পর্যন্ত ৫৬০ কিমি. (৩৩ কেভি), ৯৮৪ কিমি. (১১ কেভি), ১৩৫৫ কিমি. (৪ কেভি) বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব নয়, এরকম ৪৭ হাজার পরিবারের মধ্য থেকে ৫ হাজার ৫০০টি পরিবারকে সৌর বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদানের জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে; শান্তিচুক্তির পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যন্ত ছিল না। শান্তিচুক্তির পূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে মাত্র ২০০ কিলোমিটার রাস্তা ছিল। রুমা ও ধানচি উপজেলার সাঙ্গু নদীর ওপর কোনো সেতু ছিল না। এখন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাস্তা ও বিভিন্ন আকারের সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করছে। শান্তিচুক্তির পর ১৫৩২.০০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ১০৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে এবং প্রায় ৮৬০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের রয়েছে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের আওতা বৃদ্ধি এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা হয়েছে, যা শান্তিচুক্তির আগে ছিল না বললেই চলে। পূর্বাঞ্চলীয় সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রদর্শনী ক্ষেত্র স্থাপন কার্যক্রম এবং চাষী পর্যায়ে উন্নতমানের ধান-গম ও পাট বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের আওতায় প্রদর্শনী ক্ষেত্র স্থাপন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার উপজাতিদের নিজস্ব ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় চুক্তির আলোকে পার্বত্য জেলায় বেশকিছু এলাকা পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে, যা এখন দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের জায়গায় পরিণত হয়েছে।
তাওহীদ মাহমুদ : সাংবাদিক