
প্রিন্ট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০৭ পিএম
রাস্তা পারাপারের শৃঙ্খলা আত্মস্থ করতে হবে

লে. কর্নেল মো. সাইফুল ইসলাম
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
একবার জাতিসংঘের লজিস্টিকস বেজ ইতালির ব্রিনডেসিতে একটি কোর্সে যোগদান করেছিলাম। অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর, জনসাধারণ অনেক মার্জিত। রাস্তায় যাতায়াতকারী জনসাধারণ একটি ক্রসিং পয়েন্টে একত্রিত হলে নিজ থেকেই চালকরা গাড়ি থামিয়ে জনসাধারণের পারাপারের সুযোগ করে দেন হাসিমুখে।
গাড়ির চালকরা একজন পরিচিত কাউকে দেখলেই একটু হাত নেড়ে হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। আমাদের দেশের বাস বা ট্রাক চালকদের মতো রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে গল্প জুড়ে দিয়ে, বিশাল যানজট করে, মানুষের ভোগান্তির কারণ কেউ হন না।
এমনকি আফ্রিকার বহু দেশে আমি ইতালির আদলে পথচারীর রাস্তা পারাপারে এবং চালকদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের একই প্রথা দেখেছি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের পথচারী ও চালকদের মধ্যে সে সৌজন্যবোধ ও শৃঙ্খলা গড়ে ওঠেনি।
একটি দেশের নাগরিক বা জনসাধারণ কতটা সুশৃঙ্খল তা বোঝার অনেক ইনডিকেটরের মধ্যে জনসাধারণের রাস্তা পারাপারের বিষয়টি নিঃসন্দেহে অন্যতম। বাঙালি জাতির ইতিহাস অনেক গৌরবের ও বীরত্বের হলেও বর্তমানে জনসাধারণের রাস্তা পারাপারে শৃঙ্খলার মান অত্যন্ত সাধারণ মানের বললেও ভুল হওয়ার নয়।
পরিবহন খাতে প্রতিবছর সরকার বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে; কিন্তু রাস্তা নির্মাণে অব্যবস্থাপনা, যান চলাচলের নেতিবাচক গতি-প্রকৃতি, চালকদের অদক্ষতা, সর্বোপরি জনসাধারণের চলাচলের শৃঙ্খলার অভাবে জনসাধারণের রাস্তা চলাচলের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যেন সুদূর পরাহত একটি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিটি দেশে জনসাধারণের রাস্তা পারাপারের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে- আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। এসব নিয়ম মেনে চললে যেমন নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে রাস্তা পারাপার হওয়া যায়, তেমনি নানাবিধ দুর্ঘটনারোধ, মূল্যবান জীবন ও যানবাহনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। একজন পথচারীর খামখেয়ালি পথ চলাচলকে কেন্দ্র করে ঘটে যেতে পারে যে কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা তা আমাদের কারও অজানা নয়।
মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে বিভিন্ন বয়সের মানুষের পথচলা হরহামেশাই আমাদের নজরে পড়ে। আর মোবাইলে কথা বলে পথচলার জন্য অন্য পথচারী বা গাড়ির চালকের অসুবিধা হলেও মোবাইল ব্যবহারকারীর সেদিকে দেখার, খেয়াল করার বা অনুশোচনার লেশমাত্র ভাব দেখা যায় না। এ যেন জেগে জেগে ঘুমন্ত কোনো লোকের সঙ্গে বসবাস, হাজার ডাকেও যার সাড়া পাওয়া ভার।
আমরা কি কখনও লক্ষ করেছি কতশত ভাবে আমরা রাস্তা পারাপার হচ্ছি? রাস্তার শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সড়ক ও জনপদ বিভাগ নানা ধরনের ফুটওভারব্রিজ, আন্ডারপাস, ডিভাইডার, কংক্রিটের ব্লক, তারের বেড়া, প্লাস্টিকের স্ট্যান্ড, জেব্রা ক্রসিং ইত্যাদি নির্মাণ করেছে। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সিগন্যাল লাইট পোস্ট এবং অসংখ্য পুলিশ কর্মকর্তা ও ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্বে নিয়োজিত করেছেন।
সিটি কর্পোরেশন রাস্তার উন্নতির পাশাপাশি জনসাধারণের রাস্তা পারাপার সহজ করতে নানাবিধ পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর পাশাপাশি রাস্তাসংলগ্ন বেশকিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব নিরাপত্তা প্রহরী ও গার্ড নিয়োজিত করেছে। তবুও রাস্তা পারাপারে আমাদের শৃঙ্খলা ধরে রাখা যাচ্ছে না। রাস্তা পারাপারের জেব্রা ক্রসিং দিয়ে অগণিত মানুষ পার হলেও এমন কোনো রাস্তা পাওয়া যাবে না, যে রাস্তার নির্দিষ্ট স্থান দিয়েই সব মানুষ পারাপার হচ্ছে।
মা ছেলেমেয়ের হাত ধরে ব্যস্ততম রাস্তার যে কোনো স্থান দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। কোনো কোনো রাস্তায় লোহার জাল ছিদ্র করে যুবকরা রাস্তা পার হচ্ছে অথবা কংক্রিটের ডিভাইডার ভেঙে তার মধ্য দিয়ে মা-ছেলে, বাবা-মেয়েকে নিয়ে, স্কুলের সহপাঠী ছেলে বা মেয়ের দল পার হচ্ছে।
এ জনস্রোত পারাপারের যে কোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। কোনো কোনো যুবক তার প্রশস্ত হাতের ইশারায় এমনভাবে চলন্ত সব গাড়িকে থামিয়ে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে যায়, দেখে মনে হবে তিনি এক মহাবীর। ফুটওভারব্রিজ কেউ ব্যবহার করছে, কেউ ফুটওভারব্রিজের নিচ দিয়ে, কেউ বা অন্যান্য শত উপায়ে রাস্তা পার হচ্ছে।
কোনো কোনো যুবক রাস্তার ডিভাইডারের ওপর দৌড়ে গিয়ে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে রইল রাস্তা পার হওয়ার জন্য; কখন কোন গাড়ির নিচে চাপা পড়ে তার প্রাণ যাবে বোঝা ভার। রাস্তা পারাপারের এ শৃঙ্খলা যেন ফেরার নয়।
আমরা অনেকেই প্রশস্ত রাস্তা মুহূর্তের মধ্যেই সরু করে ফেলি, কখনও অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পার্কিং, কখনও ভ্যানের ওপর ফেরিওয়ালা, আবার কখনও রাস্তার মধ্যেই ফেরিওয়ালা হাজারও মালামাল বিক্রি করছে। বিক্রি হচ্ছে ফুটপাতের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা অত্যন্ত চড়া দামে; দিনভিত্তিক বা মাসভিত্তিক যে কোনো বন্দোবস্তে।
অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড, টেম্পো স্ট্যান্ড ইত্যাদি রাস্তাকে সংকুচিত করে দীর্ঘ যানজটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অবৈধ স্থাপনা সরানোর ব্যাপারে সাবেক মেয়র আনিসুল হকের সাহসী পদক্ষেপের প্রশংসা এখনও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ব্যক্তিগত শৃঙ্খলায় হবে না, এর জন্য দরকার অন্যান্য সংস্থার কার্যকরী উদ্যোগ।
অনেকেই সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা, স্থানের অভাবের কথা তুলে ধরে অসহনীয় যানজটের দায় এড়িয়ে যেতে চান। কথা হল- সম্পদের সীমাবদ্ধতা সব দেশেই রয়েছে, আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। সরকার রাস্তার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বহু পদক্ষেপ নিয়েছে এবং বহু পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকার দৃশ্যমান অগ্রগতি করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এর প্রক্রিয়া চলমান আছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে- মা তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে রাস্তার স্টিলের বেড়ার ফাঁক দিয়ে, কংক্রিটের ব্লকের ভাঙার ভেতর দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন; তিনি তো তার নিজের শৃঙ্খলা মানছেনই না, উপরন্তু ছেলে ও মেয়ের শৃঙ্খলা শিশু বয়সেই বারোটা বাজিয়ে চলেছেন। যে যুবক প্রশস্ত হাতের ইশারায় বীরদর্পে সব গাড়ি থামিয়ে একটা রাস্তা পার হচ্ছেন তার শৃঙ্খলা কোথায় গিয়ে ঠেকছে তা বলা মুশকিল। স্বল্প সম্পদ নিয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে চললে যে কোনো দেশ দ্রুত উন্নতি পেতে পারে।
শুধু যানজটের কারণে প্রতিবছর আমাদের প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হয়। বর্তমানে প্রতিদিন রাস্তায় ৩৭১টি নতুন গাড়ি যোগ হয়ে যানজটকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। তাই একটু হেঁটে নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে রাস্তা পারাপার যে আমাদের সবার শৃঙ্খলাবোধকে জাগ্রত করতে পারে, শৃঙ্খলাবোধকে লালন করতে ও ভবিষ্যতে দেশ গড়তে সাহায্য করতে পারে, সে কথা যেন আমাদের কারও মনে করতে নেই। একটু হাঁটাহাঁটিতে শরীর সুস্থ থাকে, মন ও মানসিকতাও ভালো হয়- এ কথা এ দেশের কে কাকে বোঝাবে?
রাস্তা চলার শৃঙ্খলাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই বলেই আমার মনে হয়। পৃথিবীর বহু ধনী-গরিব ও উন্নত-অনুন্নত দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকেই আমার এমনটিই মনে হয়েছে। সেনাবাহিনীর কঠোর শৃঙ্খলার জীবনযাপনে আমরা শুরুতেই অভ্যস্ত ছিলাম না, একটু একটু করে আমাদের শৃঙ্খলাবোধকে দায়িত্বের আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
একটি দেশের রাস্তা পারাপারের দৃশ্য দেখে ভ্রমণকারীরা সহজেই বুঝতে পারেন, সে দেশের জনগণ কতটা সুশৃঙ্খল; তাই নিজের প্রয়োজনে, দেশের মানসম্মানের প্রয়োজনে রাস্তা পারাপারের শৃঙ্খলা বজায় রাখা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের শুরুতেই কোমলমতি শিশুদের শৃঙ্খলা ভেঙে পথ চলতে শেখানো কোনোমতেই কাম্য নয়। কেননা এ শৃঙ্খলা ভঙ্গের মধ্য দিয়েই তার রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ভঙ্গের সূত্রপাত ঘটে।
আর প্রতিটি শিশুই আজ শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে দিন দিন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, সে যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চালানোর দায়িত্ব পায় তখন সেখানকার সব শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সে সমানভাবে সচেষ্ট থাকে না।
বর্তমানে ঢাকার পুলিশ কমিশনার দায়িত্ব পেয়েই ঢাকার যানজট কমাতে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। প্রয়োজনে তিনি নিজে তার সহকর্মীদের নিয়ে রাস্তার জনগণের পাশে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। তার এ প্রত্যয় অবশ্যই ঢাকাবাসীর মনোযোগ কেড়েছে।
সরেজমিন পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার উপস্থিতি অবশ্যই ট্রাফিক পুলিশের মনোবল ও সাহস দুটোই জোগাবে এবং নিঃসন্দেহে ট্রাফিক পুলিশের সক্ষমতা বহু অংশে বাড়বে। এ পদক্ষেপের ফলে ঢাকা শহরের অসহনীয় যানজট কিছুটা হলেও কমবে বলে আশা করি। তাই আসুন আমরা পুলিশ কমিশনারের এ প্রত্যয়কে সাধুবাদ জানাই।
আসুন আমরা নিজ নিজ দায়িত্বে সড়ক পারাপারের শৃঙ্খলা মেনে চলি এবং আমাদের শিশুদেরও রাস্তা পারাপারে শৃঙ্খলা মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করি। এতে করে জীবনের পথ চলতে চলতে শৃঙ্খলা শিশুদের মনের গভীরে স্থান পাবে। এ শৃঙ্খলা আগামীতে তার পথ চলতে, জাতিকে নেতৃত্ব দিতে যথেষ্ট সহায়তা করবে। ট্রাফিক পুলিশ তো আপনাকে সাহায্য করার জন্য।
ট্রাফিক পুলিশকে যদি আপনার পথ চলার শৃঙ্খলা মানাতে বাধ্য করতে হয় তবে তো আপনার শৃঙ্খলার মধ্যে গলদ রয়েছে। ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গকারীকে ৫ থেকে ১০ মিনিটের একটি রাস্তা পারাপারের শিক্ষণীয় ভিডিও দেখার ব্যবস্থা ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে একটি ঘেরাযুক্ত পরিবেশে করা যেতে পারে। এতে লজ্জা-শরমের কারণেও যদি আমাদের রাস্তা পারাপারের কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরে আসে।
কেউ ট্রাফিক আইন না মানলে তাকে অবশ্যই ট্রাফিক আইন মানাতে ট্রাফিক পুলিশ বাধ্য করবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই পথচলা সহজ করতে প্রতিটি দেশবাসীর রাস্তা পারাপারে শৃঙ্খলা থাকতে হবে- এ শৃঙ্খলা থেকে কিছুটা হলেও আমাদের সবার সার্বিক শৃঙ্খলা বোধের উন্নতি হবে। দূর হোক আমাদের ভোগান্তির পথচলা আর পথচলা হোক আনন্দের, পথচলা হোক নিরাপদ, নিরাপদে ঘরে ফিরে আসুক প্রতিটি মায়ের সন্তান, কাজ শেষে মহা আনন্দে।
লে. কর্নেল মো. সাইফুল ইসলাম : সেনাসদর, কিউএমজির শাখা, এসটি পরিদফতর