Logo
Logo
×

বাতায়ন

মিঠে কড়া সংলাপ

পরিবহন শ্রমিকদের শক্তির উৎস কী?

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পরিবহন শ্রমিকদের শক্তির উৎস কী?

দেশের পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকরা বেশি শক্তিশালী, নাকি দেশের আইন ও সরকার বেশি শক্তিশালী- এ প্রশ্নটি বর্তমানে দেশ ও জাতির সামনে মূর্ত হয়ে উঠেছে। কারণ এ ক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক একটি রায় ঘোষণার পর সরকারের পক্ষ থেকে তা বাস্তবায়নে নমনীয় নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। আর এ নমনীয় নীতি যুগ যুগ ধরে অব্যাহত রয়েছে।

মনে পড়ে, এরশাদ সরকারের আমলে শাহবাগ মোড়ে একটি বাস থেকে একজন সরকারি কর্মকর্তা (সম্ভবত একজন উপ-সচিব) নামতে চাইলে বাসটি না থামিয়েই হেলপার কর্তৃক ধাক্কা দিয়ে যাত্রীটিকে চাকার নিচে ফেলে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তখন দেশের মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠলে সরকারেরও টনক নড়ে।

পরিবহন শ্রমিকদের এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে সে সময়ের সরকার কঠোর আইন প্রণয়ন করলে বিরোধী দলগুলো তা সমর্থন না করে পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষাবলম্বন করে। অর্থাৎ এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে আইনটির বিরোধিতা করে।

আবার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পর বর্তমান সরকার সেই একই বিষয়ে ন্যূনতম শাস্তিসংক্রান্ত আদালতের একটি রায় বাস্তবায়নে ব্যাকফুটে চলে গেল। আর এভাবেই পরিবহন শ্রমিকরা বারবার আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে।

পরিবহন শ্রমিকদের কিছুতেই আইন মানতে বাধ্য করা যাচ্ছে না। দেশে একটি বৈধ, স্থিতিশীল ও শক্তিশালী সরকার থাকা সত্ত্বেও দেশের রাস্তাঘাট অবৈধ ও বেপরোয়া ড্রাইভারদের অভয়ারণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধভাবে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে যাত্রী হত্যাসহ রাস্তাঘাটে নানা অপকর্মের হোতা পরিবহন শ্রমিকরা একটি শক্তিশালী সরকারকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ থেকে সরে দাঁড়াতে সরকারকে বাধ্য করছেন।

আর এ ক্ষেত্রে সরকারের দোষ-ত্রুটিও তাদের সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে সরকারের দোষ-ত্রুটি বলতে বিআরটিএ, ট্রাফিক বিভাগসহ পুলিশ বিভাগকে বোঝানো হয়েছে। আর উপরোক্ত সরকারি বিভাগগুলোর দোষ-ত্রুটিকে সরকারি দোষ-ত্রুটি বলা ভুল হবে বলে মনে হয় না।

কারণ বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশের অধিকাংশ কর্মচারী-কর্মকর্তা আইন অমান্যকারী ওইসব বাস-ট্রাক ড্রাইভারের পকেটের টাকা হাতানোর তালে না থাকলে, অবৈধ বাস-ট্রাককে রাস্তায় চলাচলের অনুমতি না দিলে এবং ট্রাফিক পুলিশ সেসব সুযোগ ব্যবহার করে রাস্তাঘাটে চাঁদাবাজি না করলে বাস-ট্রাক ড্রাইভার তথা পরিবহন শ্রমিকরা এতটা বেপরোয়া হতে পারত না।

সরকারি আদেশ-নির্দেশ অমান্যসহ আদালতের রায় পর্যন্ত অমান্য করতে পারত না। আর সরকারকেও এভাবে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো অসহায়ত্ব প্রদর্শন করতে হতো না। আবার বিভিন্ন সময়ের সরকারে পরিবহন শ্রমিক নেতাদের মধ্য থেকে যাদের মন্ত্রী-এমপি বানানো হয়, তারাও সরকারে থেকে কলকাঠি নেড়ে পরিবহন শ্রমিকদের পায়াভারি করে দেন।

সময়ে সময়ে তাদের ভূমিকাও যে ওই শ্রেণির অবৈধ বাস-ট্রাক ড্রাইভার তথা পরিবহন শ্রমিকদের মাথায় তুলেছে সে কথাটিও অনস্বীকার্য। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাঁশকল ফেলে ওইসব পরিবহন শ্রমিক নেতা সংগঠনের নামে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে সেসব টাকার জোরে যে অনেক কিছু করে থাকেন সে কথাটিও ভুলে গেলে চলবে না।

কারণ, একশ্রেণির পরিবহন শ্রমিক নেতার ধর্ম ও কর্মই হল তাদের সাগরেদরা যত বড় অন্যায়ই করুক না কেন, অর্থ, সাংগঠনিক শক্তি এবং ব্যক্তিগত তৎপরতার মাধ্যমে তাদের সাতখুন মাফ করানো।

প্রায় সত্তর বছরের জীবনে এ ক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে যেসব ঘটনা দেখেছি, সেসব দৃশ্যও অকল্পনীয়। হানিফ পরিবহনের একটি বাস একবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রাইভেট কারকে এমনভাবে দুমড়ে-মুচড়ে দিল, যা দেখে বাসের ড্রাইভারকে সেদিন সাক্ষাৎ খুনির চেয়েও জঘন্য মনে হয়েছিল।

বেপরোয়া গতিতে সম্পূর্ণ উল্টো ও অবৈধ দিক থেকে এসে রাস্তায় থাকা একটি বাসকে ওভারটেক করে রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়ে আবার রাস্তায় উঠেও গতি নিয়ন্ত্রণ না করে প্রাইভেট কারটিকে যেভাবে চাপা দিয়ে চুরমার করে দিয়েছিল, বিচার হলে সে ঘটনায় ওই ড্রাইভারের ফাঁসি হতো। অথচ আশপাশ থেকে একজন পাতি পরিবহন নেতা এসে সেই খুনি ড্রাইভারকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন।

কেউ কেউ ‘পুলিশ পুলিশ’ করলেও সে অবস্থায় হাইওয়েতে পুলিশেরও দেখা পাওয়া যায়নি। আর এভাবেই সারা দেশে বাস-ট্রাক ড্রাইভারদের অন্যায়-অত্যাচার দেশের মানুষকে হজম করে চলতে হচ্ছে! আবার রাজধানী ঢাকা শহরের একটি দুর্ঘটনায় একবার দেখেছি, অপ্রাপ্তবয়স্ক একজন মিনিবাস ড্রাইভার একটি জিপ গাড়িকে পেছন থেকে আঘাত করার পর একজন ট্রাফিক পুলিশ এসে মিনিবাস চালকের লাইসেন্স দেখতে চাইলে কিশোর চালকটি নির্বিকারভাবে বলে দিল, ‘জানেনই তো লাইসেন্স নেই!’

এসব ঘটনা দেখেশুনে আমার অন্তত এটুকু মনে হয়েছে যে, পরিবহন শ্রমিকদের কাছে এ দেশের পুলিশও অসহায়। আবার দেখা যায়, এই শ্রেণির চালকরা পুলিশ সদস্যদেরও চাপা দিয়ে হত্যা করে থাকে এবং পত্রিকায় এমন সংবাদ মাঝেমধ্যেই আমাদের চোখে পড়ে।

এ অবস্থায় পরিবহন শ্রমিকদের হাত থেকে সাধারণ মানুষের বাঁচার উপায় আছে বলে মনে হয় না। কারণ সরকারই যখন বেপরোয়া পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে পেরে ওঠে না, সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের তো কথাই নেই। শুধু যখন বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণি ওই ধরনের বেপরোয়া ড্রাইভারের অপরাধের শিকার হন, কেবল তখনই সরকারকে একটু নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়। যেমন এরশাদ সরকারের সময় একজন উপ-সচিব নিহত হলে একটি আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল।

বলা বাহুল্য, সেদিনের সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে যত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যত আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, তার কোনোটিই যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। আর এর কারণও মনে হয় একটিই- প্রতিবার প্রত্যেক সরকারই মনে করেছে, এই বুঝি তাদের ক্ষমতা গেল, এক ঝাঁকুনিতেই পরিবহন শ্রমিকরা বুঝি সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়বেন! কিন্তু তাই বলে বর্তমান সরকারও সেই একই ভয়ে ভীত হবে, এ কথা বোধহয় দেশের মানুষ ভাবতে পারেননি।

রাস্তাঘাট, হাইওয়েতে পরিবহন শ্রমিকদের অন্যায়-অবৈধ কার্যকলাপের কারণে অবৈধ ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে অথবা তাদের গাফিলতি বা ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার জন্য একজন মানুষের মৃত্যু ঘটলে মাত্র পাঁচ বছরের জেলের বিধান রেখে যে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে, সেই আইনটি বাস্তবায়ন করতে গিয়েও বর্তমান সরকারকে পর্যন্ত হোঁচট খেতে হবে- দেশের মানুষ এ সরকারের কাছে এমনটি আশা করেনি। আর আমরাও এমনটি ভাবতে পারিনি।

অতঃপর তাহলে পরিবহন শ্রমিকরা যেভাবে বলবেন, সেভাবেই আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে, তাদের মর্জিমাফিকই সরকারকে চলতে হবে! এ অবস্থাই যদি বহাল থাকে তাহলে দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার, জনগণের সরকার আছে সে কথাই বা ধোপে টেকে কীভাবে? যদি সত্যিই বর্তমান সরকার জনগণের সরকার হয়ে থাকে, তাহলে পরিবহন শ্রমিকদের ভয়ে ভীত না হয়ে আদালতের রায় কার্যকর করবে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

এ বিষয়ে সরকারের উদ্দেশে আরও যা বলতে চাই তা হল, বিআরটিএ নামক সরকারি প্রতিষ্ঠানটি থেকেও ভূত তাড়ানো দরকার। বিআরটিএর মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে আইনানুগ লাইসেন্স দেয়া হয়, সেখানে যদি এমন সব ব্যক্তিকে প্রাইজ পোস্টিং দেয়া হয়, যারা সেখানে বসে অবৈধ যানবাহনের ছাড়পত্র দিয়ে, মানসিকভাবে বিকৃত, শারীরিকভাবে অযোগ্য ব্যক্তিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে ফিটনেস বাণিজ্য, লাইসেন্স বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা রোজগার করেন, তাহলে দেশের মানুষই বা কী করতে পারেন?

আবার সরকারের পুলিশ বিভাগের লোকজন, বিশেষ করে, ট্রাফিক পুলিশ যদি অবৈধ বা ভুয়া লাইসেন্সধারী গাড়ি চালকদের অবৈধ সুবিধা দিয়ে, যেখানে-সেখানে এমনকি রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড়ানোর সুবিধা দিয়ে ড্রাইভারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেন, সে ক্ষেত্রেই বা দেশের মানুষ কোথায় যাবেন? আর এভাবে সবাই যদি ওই শ্রেণির ড্রাইভার ও পরিবহন শ্রমিক নেতাদের পকেটে ঢুকে যান, তাহলে পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্যই বা থামাবে কে বা কারা?

তাই যদি না হবে, তাহলে বিআরটিএতে পোস্টিং পাওয়ার জন্য একশ্রেণির সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা অতি আগ্রহী হবেন কেন, ট্রাফিক পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পোস্টিংয়ের জন্য এত চেষ্টা-তদবির-ঘুষ-বাণিজ্য চলে কেন? এ অবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে এ কথাও বলা যায়, পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্যের জন্য পরিবহন শ্রমিকদের পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মচারী-কর্মকর্তারাও দায়ী।

অবৈধ সুবিধা দিয়ে, অবৈধ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে পরিবহন সেক্টরের সরকারি লোকজন ও নেতারাও যে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী সে কথাটিও কিন্তু ওপেন সিক্রেট। সুতরাং সরকারকে নিজের ঘর থেকেও যে ভূত তাড়াতে হবে, সে কথাটিও জনান্তিকে বলে রাখা হল।

পরিশেষে আরও বলা প্রয়োজন, আমাদের দেশে রাস্তাঘাটের কারণে গাড়ি চালকদের যে সমস্যা হয় না, তেমনটিও নয়। পথচারীদের অসাবধানতার জন্যও দুর্ঘটনা ঘটে। সেসব ক্ষেত্রে অবশ্যই গাড়ি চালকদের ছাড় পাওয়া উচিত। কিন্তু তাই বলে একেকটি বাস-ট্রাক মারমার কাটকাট করতে করতে দৈত্যের মতো অন্য একটি যানবাহনকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে একটি পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে দেবে, এমনটিও হওয়া উচিত নয়।

আর আমার মনে হয়, পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে এমন বিকৃত বা অসুস্থ মানসিকতার ড্রাইভারের অভাব নেই। এ অবস্থায় ওই শ্রেণির গাড়ি চালকদের শাস্তির বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান, তাদের বিবেককে জাগ্রত করাই আমার আজকের লেখাটির মূল উদ্দেশ্য। ওই শ্রেণির ড্রাইভারদের রুখতে না পারলে, শাস্তি দিতে না পারলে কে জানে একদিন তাদের পৃষ্ঠপোষকরাই আবার তাদের শিকারে পরিণত না হন! সুতরাং সাধু সাবধান!

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম