বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায় কার
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে এ দেশের অধিকাংশ মানুষ হতাশ। তারা তাদের সন্তান ও পরিজনদের শিক্ষা-ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত। সাধারণ আয়ের মানুষের হাতে খুব বেশি বিকল্প নেই। প্রতিযোগিতার কঠিন যুদ্ধের পর যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, পরবর্তী বাস্তবতায় তারা মুষড়ে পড়ে।
ভর্তি হওয়া তরুণ শিক্ষার্থীরা স্নেহের বদলে ক্ষমতাবান ও বখাটে সিনিয়রদের দ্বারা নিগৃহীত হতে থাকে। অল্প কিছুসংখ্যক অমানবিক ও নষ্ট রুচির ছেলেমেয়ে সতীর্থ জুনিয়রদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। এভাবেই র্যাগিং নামে একটি বিজাতীয় সংস্কৃতি চালু করে ক্যাম্পাসের হলগুলোতে।
ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররা যাবতীয় অন্যায়ের পেছনে থাকে বলে এমন বিষাক্ত পরিবেশ অব্যাহত থাকে। নতুন শিক্ষার্থীদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথম হতাশ হয় প্রাথমিক স্বপ্নভঙ্গের কারণে। ওরা প্রায়ই দেখে, একাডেমিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অন্যতম ক্রীড়নক সম্মানিত শিক্ষকদের কেউ কেউ।
তারা প্রায়ই ক্লাস ফাঁকি দেন। ক্লাস রুটিন অনুসরণ করেন না। নিজেরা পড়ান না বলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার বৈতরণী পেরোনোর সহজ পথ দেখিয়ে দেন। এদের কারণে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সোনালি বাঁধনে ফাটল ধরে। দাপুটে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো সব সরকারের সময়েই বিষফোঁড়া। ছাত্রকল্যাণের কর্মসূচি কখনও এদের থাকে না।
এদের সুপথে আনার ক্ষমতা শিক্ষকদের বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেই। রিমোট কন্ট্রোল থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে। তাদের লক্ষ্য কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শিক্ষাসংক্রান্ত হয় না; হয় বিপক্ষের মাথায় মুগুর ভেঙে হলেও নিজেদের দাপট বজায় রাখা।
অনেক ক্ষমতাবান নেতা, আমলা আর ব্যবসায়ীরা এমন অবস্থা দর্শনে আতঙ্কিত থাকেন নিজ সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাই নিশ্চিন্ত হন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠিয়ে দিয়ে। ফলে ক্ষমতা থাকলেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তারা পালন করেন না।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের প্রতিযোগিতা ক্যাম্পাসেও দেখা যায়। তাই বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদলের দাপটের মুখে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ছাড়া হয়। আবার আওয়ামী লীগের আমলে ক্যাম্পাস ছাড়া থাকে ছাত্রদল। অন্যদিকে বাম দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লড়াইয়ের বাইরে বলে ক্যাম্পাসে সক্রিয় থাকতে পারে এ ধরনের দলের ছাত্র সংগঠন।
মাঝে মাঝে এসব দলের ছাত্ররা সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীর হাতে নিগ্রহের শিকার হলেও ক্যাম্পাসে থেকে স্লোগান দিতে পারে। এ দলগুলোও ভিসি বিতাড়ন ও কথিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান তুললেও ছাত্রকল্যাণ ও ছাত্র অধিকার নিয়ে কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তোলে না।
অর্থাৎ বর্তমানে আমাদের দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র অধিকারের মতো ‘ছোট’ বিষয় নিয়ে কথা বলার কোনো সংগঠন নেই। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠন ও হল সংসদ থাকলে এ দায়িত্ব এরা পালন করতে পারত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল পর যা-ও বা ডাকসু হল, তা-ও রাজনীতির ঘেরাটোপে পড়ে প্রকৃত ডাকসু হয়ে উঠতে পারল না। আর এ বাস্তবতা দেখার পর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সাহস পাচ্ছে না কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ গঠনের।
দু’দিন আগে শিক্ষক লাউঞ্জে চায়ের টেবিলে এক সহকর্মী যথার্থই বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার পেছনে সরকার কোনো না কোনোভাবে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে; কিন্তু এ সত্য আপনি মানাবেন কেমন করে।
সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা- তা যত মুক্তচিন্তা থেকেই বলুন, আপনি হয়ে যাবেন ‘বিএনপি-জামায়াত’ অথবা ‘সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টা বানচাল করার ষড়যন্ত্রকারী’। আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনি যে তিন দশকেরও বেশি শিক্ষকতায় দলনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে কথা বলে যাচ্ছেন, এ মূল্যায়ন কেউ করবে না।
সহকর্মীর কথায় আমার মন আর্দ্র হল। পরক্ষণেই সামলে উঠলাম। দুই দশক ধরে পত্রিকায় কলাম লেখার চেষ্টা করি। ই-মেইলে আর টেলিফোনে পাঠকের প্রশ্রয় যেমন পেয়েছি, বকাঝকাও হজম করেছি অনেক।
কোনো কোনো লেখার জন্য ‘বিএনপির দালাল’ বলে সমালোচিত হয়েছি। আবার ‘আওয়ামী তাঁবেদার’ বলে বকাও খেয়েছি। তবে ওসবে আনন্দ আছে। প্রতিক্রিয়া শুনে নিশ্চিত হওয়া যায় হুল যথার্থ জায়গায়ই ফুটেছে, এই ভেবে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে শিক্ষকতার দায় নিয়ে কথা না বলে উপায় কী আমার! আমি বিশ্বাস করি, বিশ্ববিদ্যালয়কে এর সম্মানের জায়গায় ধরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এবং সবচেয়ে বেশি শিক্ষকদের দায় রয়েছে। এক সময় সেই দায় পালন করার পরিবেশও ছিল। সত্তরের দশকের শেষদিকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম।
আশির দশকের প্রথমদিকে শিক্ষকতায় যুক্ত হই। তখন শিক্ষক রাজনীতির বাড়াবাড়ি রূপ প্রকাশ্য হয়নি। সর্বজনমান্য সম্ভ্রান্ত মুক্তচিন্তার পণ্ডিত ব্যক্তিদেরই ভিসি নিয়োগ করা হতো। ভিসি প্যানেল নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিরও সংস্পর্শ ছিল; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ও মর্যাদা তাতে চোখে পড়ার মতো খাটো হতো না।
ভালো ফলকারী মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষক হবেন এটিই ছিল অবধারিত। শিক্ষক হওয়ার জন্য মেধার চেয়ে দলীয় পরিচয় বড় হবে বা এর জন্য অর্থ-বাণিজ্য ভূমিকা রাখবে এটি ছিল অজানা।
প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ছাত্রছাত্রীকে বিভাগের শিক্ষকরা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উৎসাহিত করতেন শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করার জন্য। মেধাবী ছাত্রটি অন্য কোথাও চলে যাক এটি কেউ চাইতেন না। আমি নিজেকে দিয়েই তা প্রত্যক্ষ করেছি।
এরপর ধীরে ধীরে নষ্ট রাজনীতি গ্রাস করল বিশ্ববিদ্যালয়কে। সব রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে শক্ত ঘাঁটি মনে করতে লাগল। বিরোধী দল মনে করল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক লাঠিয়াল আর পেশিশক্তির লাঠিয়ালের চারণ ক্ষেত্র বানাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে। তাই তাদের রাজনীতির অশুভ ছায়া ফেলতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এভাবেই অশুভ রাজনীতিকরণ সম্পন্ন হল ক্যাম্পাসে।
এখনকার মেধাবী তরুণ-তরুণীরা আমাদের মতো সৌভাগ্যবান নন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষকরা মেধাবীদের পথ কুসুমাস্তীর্ণ করে রাখবেন। আমরা শিক্ষকতায় যোগ দেয়ার পর দলীয় রাজনীতিতে যোগ দেয়া না-দেয়া নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করিনি।
শিক্ষক থেকে স্বয়ং ভিসি পর্যন্ত শিক্ষা গবেষণায় আত্মনিয়োগ করতে বলতেন, উৎসাহ দিতেন। এখন ভোটার শিক্ষকদের শিক্ষকতার যাত্রা শুরুতেই ক্লাস ফেলে ছুটতে হয় দলীয় মিটিংয়ে যোগ দিতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্বাচনের আগে শপথ নিতে হয় ভিসির মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দেয়ার অঙ্গীকারে। ফলে এদের অনেকের আর প্রকৃত অর্থে শিক্ষক হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। এসব অনাচার এত প্রকাশ্য যে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর দায় এড়াতে পারে না।
এরপরও মানতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তা চর্চার জায়গা। ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় শিক্ষকদের একটি ছোট অংশ মাত্র। এর বাইরের নানা দল ও দলনিরপেক্ষ শিক্ষকের সংখ্যা অনেক বেশি।
তারা যখন দেখেন ভিসি এবং সরকারের দলীয় ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, শিক্ষা ও গবেষণার কাঠামো ভেঙে পড়ছে, তখন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিবাদ না করে পারেন না।
ভিসিবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এখান থেকেই। নানা যৌক্তিক ইস্যুতে ছাত্ররাও বিক্ষুব্ধ হয়। আবার ভিসির চেয়ারলোভী শিক্ষক, শিক্ষকগ্রুপও যে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে না তা নয়। তারাও অনেক সময় ভিসিবিরোধী আন্দোলন জমানোর চেষ্টায় মাঠে নামেন।
এমন স্বার্থকেন্দ্রিক আন্দোলনে যৌক্তিকতা তেমন থাকে না বলে সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের সমর্থন পান না তারা। তবুও আসুরিক দাপট দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করেন বারবার।
পাকিস্তান আমল থেকেই বামপন্থী ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রতি সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকের ভরসা ছিল। জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনেও বাম রাজনীতির প্রভাব ছিল। এখন তো জাতীয় রাজনীতিতে বাম দলগুলো নিষ্প্রভ। নির্বাচন করলে সাধারণত জামানত হারান।
স্লোগান দিতে দক্ষ বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী ছাত্র-শিক্ষকরা এখনও বাম দলের জীবনীশক্তি হয়ে টিকে আছে; কিন্তু বিভ্রান্ত এসব রাজনীতি এখন সরকারদলীয় ছাত্র রাজনীতির চরিত্র পাওয়ায় ক্যাম্পাসে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে।
সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন যেমন সরকারের বা সরকারদলীয় প্রশাসনের লাঠিয়াল, বাম ছাত্র-শিক্ষরাও তেমনি ভিসিপদলোভী ভিসিবিরোধী আন্দোলনকারীদের লাঠিয়ালে পরিণত হচ্ছে। এভাবে একাডেমিক শৃঙ্খলা ভাঙছে ক্রমাগত।
আমরা মনে করি, এমন বাস্তবতায় শেষ নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র সরকারের হাতে অবশিষ্ট থাকে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণ চিন্তা করলে শুরুতেই সরকার, বিশেষ করে, মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ হয়ে পড়ে অনিবার্য।
কলাম লেখক হিসেবে আমি দাবি করছি- উপরের চিত্রিত দৃশ্য আমার বোধ, সংশ্লিষ্টতা ও নির্মোহ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী শতভাগ সত্য। যদি মিথ্যা বিকৃত বলে প্রমাণ না করা যায় তবে মুক্তমনের পাঠক নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শৃঙ্খলা বিনষ্টে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারের যথাসময়ে ভূমিকা রাখতে না পারাটাই অন্যতম প্রধান কারণ।
অচলায়তনে বন্দি দলীয় সরকারগুলো অন্তত যদি সামান্য দেশপ্রেম দেখিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নিকৃষ্ট দলীয় রাজনীতির মুক্তি ঘটাতে পারতেন এবং অন্যায়ের প্রশ্রয় না দিতেন তবে বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয়ই স্বমহিমায় বিকশিত হতে পারত। আর এমন স্বস্তিময় বিকাশ ত্বরান্বিত হতো যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা দল-মতের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়- বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণ চিন্তায় এগিয়ে আসতেন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com