দুর্নীতির শাস্তি তিরস্কার!
মো. ফিরোজ মিয়া
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির শাস্তি শুধুই তিরস্কার। বিশ্বাস হচ্ছে না? বিশ্বাস হওয়ার কথাও নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে দুর্নীতির মতো ঘৃণ্য অপরাধের জন্য তিরস্কারের মতো লঘুদণ্ডের বিধান আছে বলে জানা নেই; কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতিপরায়ণ হলে তাদের তিরস্কারের মতো লঘুদণ্ড আরোপ করে চাকরিতে বহাল রাখার বিধান রেখে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জারি করা হয়েছে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আচরণ) বিধিমালা।
সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত এ বিধিমালাটি জারির পর যথেষ্ট সমালোচনা হলেও তা সংশোধনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে ভুল ও অসঙ্গতিপূর্ণ নৈতিকতা পরিপন্থী বিধিমালাটির অধীনই সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।
যে কারণে জনমনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তবে কি সরকারি কর্মচারীরা সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির আওতাবহির্ভূত? ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া সরকারি কর্মচারীরা তাদের সুবিধাদি ছাড়তে চায় না, সেটি নৈতিক বা অনৈতিক যাই হোক না কেন।
প্রকৃতপক্ষে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নজরে না আসা পর্যন্ত এমন অনৈতিক বিধান বাতিল বা সংশোধন হবে বলেও মনে হয় না।
সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির শাস্তি তিরস্কার- এখানেই শেষ নয়, বিধিমালায় সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির পুনরাবৃত্তিরও সুযোগ রাখা হয়েছে এবং দুর্নীতির পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রেও একই শাস্তি তিরস্কার। অর্থাৎ চাকরিজীবনে যতবারই দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে প্রমাণিত হোক না কেন, ততবারই তিরস্কার বা অন্য কোনো লঘুদণ্ড আরোপ করে চাকরিতে বহাল রাখা যাবে।
সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির অপরাধের জন্য লঘুদণ্ড আরোপ এবং দুর্নীতির পুনরাবৃত্তির সুযোগের এরূপ বিধান দেখে মনে হয়, সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি এবং দুষ্টু ছেলের আম চুরি একই মাত্রার অপরাধ। দুষ্টু ছেলে আম চুরিতে ধরা পড়লে সামান্য ভর্ৎসনা ও কানমলা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়; কিন্তু দুষ্টু ছেলে আমের লোভ সামলাতে না পেরে আবারও চুরি করলে সেই একই শাস্তি ভর্ৎসনা ও কানমলা। ফলে দুষ্টু ছেলের আম চুরির পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে। লঘুদণ্ডের এরূপ বিধান একইভাবে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিরও পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকবে।
সব দেশে এবং সব সমাজেই দুর্নীতি ঘৃণিত ও নিন্দনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিকে কোনো সমাজই স্বাভাবিকভাবে নেয় না। যার কারণে কোনো দেশ বা সমাজই দুর্নীতির পুনরাবৃত্তির সুযোগ সৃষ্টি করে না। কারণ দুর্নীতির পুনরাবৃত্তির সুযোগ রাখার অর্থই হল কোনো ব্যক্তিকে বারবার দুর্নীতি করার সুযোগ দেয়া।
দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার পরও যদি কোনো সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রাখা হয় এবং দুর্নীতির পুনরাবৃত্তির সুযোগ দেয়া হয়, তা হলে সরকারি কর্মচারীদের প্রতি জনমনে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। সরকারি কর্মচারীদের সম্মান ও ভাবমূর্তি বজায় রাখার স্বার্থেই এ ধরনের অনৈতিক বিধান বাতিল বা সংশোধন হওয়া প্রয়োজন।
দুদকের কর্মকাণ্ড বর্তমানে অনেকটা প্রশংসনীয়। দুদক তার অস্তিত্ব জানান দিতে সক্ষম হয়েছে। দুদকের দায়িত্ব শুধু দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদানই নয়, গবেষণা পরিচালনাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্বও দুদকের।
দেশে বিদ্যমান বিধিবিধান দুর্নীতি প্রতিরোধের সহায়ক নাকি অন্তরায়, তা যাচাই করে প্রয়োজনীয় পরামর্শও দুদকের দায়িত্বের আওতাভুক্ত। দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই দুর্নীতি দমন কমিশন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে ওইসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও বিধিবিধান পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করে আসছে, যা নিশ্চয়ই ইতিবাচক।
কিন্তু ২০১৮ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালার বিধান যে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক নয়, বরঞ্চ দুর্নীতি প্রতিরোধের পরিপন্থী, তা দুদকের নজরে না আসাটা কি অস্বাভাবিক নয়? কেননা বিধিমালাটি দুদক কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এ ছাড়া জানামতে, গবেষণা সেল ছাড়াও দুদকে জুডিশিয়াল সার্ভিসের ব্যক্তিরা কর্মরত আছেন। তাদের পক্ষে বিধিমালাটির উল্লিখিত বিধানগুলো যে দুর্নীতি প্রতিরোধের সহায়ক নয়, তা সহজেই বুঝতে পারার কথা।
কোনো আইনের বিধান দুর্নীতি প্রতিরোধের সহায়ক না হলে বা দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার সম্ভাবনা থাকলে আইনের ওইসব বিধান সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করার দায়িত্ব কি দুদকের নয়?
দুদক এ বিধিমালাটির দুর্নীতি প্রতিরোধের পরিপন্থী বিধান সংশোধনের বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো সুপারিশ দাখিল করেছে কি না, জানা নেই। যদি না করে থাকে, তবে সেটি খুবই দুঃখজনক।
এ বিধিমালাটি জারির পূর্বে ১৯৮৫ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা প্রযোজ্য ছিল। ওই বিধিমালায় কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার ওপর বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত- এর চেয়ে লঘু কোনো দণ্ড আরোপের সুযোগ ছিল না।
অর্থাৎ দুর্নীতিপরায়ণ কোনো সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রাখার কোনো সুযোগই ছিল না। তবে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে অবসর সুবিধাদি প্রদানের সুযোগ ছিল। অবশ্য এ বিধানটিও ছিল পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সেন্ট্রাল সার্ভিসের কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য বিধানের চেয়ে অনেক নমনীয় ও শিথিল।
ভারতের সেন্ট্রাল সার্ভিস কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য বিধিমালায় দুর্নীতির জন্য কর্মচারীর ওপর চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত দণ্ড আরোপের বিধান বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করে অবসর সুবিধাদি প্রদানের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
অথচ আমাদের ২০১৮ সালে জারিকৃত বিধিমালায় সন্নিবেশিত বিধান ১৯৮৫ সালের বিধিমালার বিধানের চেয়ে অনেক নমনীয় ও শিথিল। বর্তমান বিধিমালায় দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগই শুধু রাখা হয়নি, বরং সসম্মানে অবসরে যাওয়ার এবং অবসর সুবিধাদি পাওয়ারও সুযোগ রাখা হয়েছে।
এমনকি বিধিমালায় দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ বারবার দুর্নীতি করারও সুযোগ রাখা হয়েছে; যা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
আরও অবাক করার বিষয়, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো কর্মচারী যদি বিভাগীয় মামলার প্রক্রিয়াকে কৌশলে বা প্রভাব খাটিয়ে প্রলম্বিত করে অবসর গ্রহণের বয়স পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে অথবা বিভাগীয় মামলা চলাকালীন স্বেচ্ছায় অবসরে যায়, তাহলে তার ওপর বর্তমান বিধিমালা অনুযায়ী কোনোরূপ দণ্ডই প্রয়োগ করা যাবে না।
অর্থাৎ দুর্নীতি করেও অবসর সুবিধাদিসহ নির্বিঘ্নে অবসরে যেতে পারবে। অথচ ষাট দিনের বেশি কোনো কর্মচারী কর্মে অনুপস্থিত থাকলে তার অবসর গ্রহণের পরও তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তসহ যে কোনো দণ্ড প্রদান করা যাবে। অর্থাৎ এ বিধিমালার বিধান অনুযায়ী দুর্নীতির চেয়ে গুরুতর অপরাধ কর্মে সাময়িক অনুপস্থিতি। এ ধরনের বিধান কি আদৌ সুস্থ চিন্তার পরিচায়ক?
বিধিমালাটি সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত হলেও এর প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত খসড়া বিধিমালাটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে, সরকারি কর্মকমিশনে বিবেচিত হয়েছে। অতঃপর লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষান্তে ভেটিং করেছে এবং ভেটিংকৃত খসড়াটি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষান্তে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর জারি করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অগোচরে বা ভুলে বা অজ্ঞতার কারণে এরূপ বিধান বিধিমালায় সন্নিবেশিত হয়েছে, তা বিশ্বাস করা কঠিন। কেননা যদি ওইসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অগোচরে বা ভুলে বা অজ্ঞতার কারণে এরূপ বিধান সন্নিবেশিত হয়ে থাকে, তবে তা তাদের দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং তাদের জ্ঞাতসারে হয়ে থাকলে তা তাদের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তবে যেভাবেই হোক দুর্নীতির সহায়ক এরূপ বিধানের সন্নিবেশ শুধু হতাশারই সৃষ্টি করে। এর চেয়েও বেশি হতাশার সৃষ্টি করে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতি সহায়ক এরূপ বিধানের সংশোধনের কোনোরূপ উদ্যোগ গ্রহণ না করা। সঠিক জবাবদিহিতার অভাবই হয়তো এ জন্য দায়ী।
যে দেশে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির জন্য লঘুদণ্ড আরোপের বিধান রাখা হয় এবং দুর্নীতির পুনরাবৃত্তির অর্থাৎ বারবার দুর্নীতি করার সুযোগ রাখা হয়, সে দেশে যত চেষ্টা করা হোক না কেন, দুর্নীতি প্রতিরোধ বা হ্রাস কোনোক্রমেই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইন সংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক