‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি দিন দিন মামুলি হয়ে যাচ্ছে

মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি শুনলে একদিকে যেমন পিলে চমকে ওঠে, অন্যদিকে আবার মানবসভ্যতার সঙ্গে এর সম্পৃক্ততার কথাটাও ভোলা যায় না। ভোলা যায় না বলেই হয়তো এ ষড়যন্ত্রকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’। ‘মানবসভ্যতার শুরু থেকে, আরও পরিষ্কার করে বললে, মানুষ যেদিন বন-জঙ্গল-গুহা থেকে বেরিয়ে এসে সমাজে বাস করা শুরু করল সেদিন থেকে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক যেসব ঐতিহাসিক বিষয় ও ঘটনা আমাদের সভ্যতাকে আজকের এ অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে, তার অনেকগুলোই মীমাংসিত আর অনেকগুলো রহস্যের চাদরে মোড়ানো।
মীমাংসিত বিষয়ের অনেকগুলোরই আবার ভিন্ন মতবাদ আছে, আর অমীমাংসিত ব্যাপারগুলোর তো কথাই নেই। এ ভিন্নমতের ক্ষেত্রেই আসলে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আবির্ভাব হয়’ (মো. ঈশা তারেক, bn.quora.com)। ‘ষড়যন্ত্র’কে নিন্দার চোখে দেখা হয় এ কারণে যে, এর মাধ্যমে অসৎ উপায়ে এবং ক্ষতিকর পন্থায় একটি কায়েমি গোষ্ঠী তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস পায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা ইতিহাস ও সভ্যতার পরিপন্থী।
বাঙালি সমাজে ষড়যন্ত্রের কথা এলেই মনে পড়ে যায় পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস। পলাশী চক্রান্তের নায়ক মীর জাফর এবং তিনিই আসল বিশ্বাসঘাতক- এ ধারণা বহুল প্রচলিত। বাংলায় মীর জাফর নামটাই বিশ্বাসঘাতকের প্রতীক হয়ে গেছে- ওটা বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক শব্দ। এ ধরনের ধারণা সমাজে চলে আসছে এ বিশ্বাস থেকে যে, পলাশীর চক্রান্ত এবং পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের জন্য দায়ী মূলত মীর জাফর। সুতরাং মীর জাফর ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে যে ধারণা বহুদিন ধরে প্রচলিত তা কতটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য তার তথ্যভিত্তিক বিচার-বিশ্লেষণ খুবই প্রয়োজন (সুশীল চৌধুরী, পলাশীর অজানা কাহিনী, পৃষ্ঠা : ১১১)। আমরা জানি, মীর জাফরের সঙ্গে দেশীয় চক্রান্তকারীদের মধ্যে ছিলেন জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, খোজা ওয়াজিদ এবং ইংরেজদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন উইলিয়াম ওয়াটস, লিউক স্ক্র্যাফটন ও রবার্ট ক্লাইভ। সেক্ষেত্রে মীর জাফরকে আমরা নতুন করে আবিষ্কারের চেষ্টা করব না। মীর জাফর একমাত্র না হলেও প্রধান তো বটেই এবং এ ষড়যন্ত্রের মাশুল হিসেবে আমরা হারাই স্বাধীন বাংলা।
ষড়যন্ত্র শুধু যে ক্ষমতায় আরোহণের সঙ্গে সম্পর্কিত তা নয়, অনেক সময় কাউকে ক্ষমতায় যেতে না দেয়ার জন্য খোদ রাষ্ট্র বা সরকারও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে থাকে। তেমন একটি বিখ্যাত ষড়যন্ত্রের কথা বাঙালি জীবনে আজও অমলিন, যা হল ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। ১৯৬৮ সালের গোড়ায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মামলা করে। আইয়ুব সরকার অভিযোগ করে, বঙ্গবন্ধু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বসে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনষ্টের ষড়যন্ত্র করেছেন। মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং’ মামলা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরও ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে এ মামলাটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। এ অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে জনতা। প্রবল গণআন্দোলন তথা উত্তাল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সরকার পিছু হটতে শুরু করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যদের মুক্তির দাবি করেছিল। ফলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আইয়ুব খান সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব কারাবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ মামলার অভিযুক্তদের এক গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। একই দিনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল তাকে দেশের মানুষ মহান সম্মানে অধিষ্ঠিত করলেন আর আইয়ুব খান গদি ছাড়তে বাধ্য হলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে, এমনকি বাঙালি জীবনের সবচেয়ে আলোচিত, নিন্দিত, বীভৎস, কলঙ্কিত, মানবতাবিবর্জিত ষড়যন্ত্র হল ‘১৫ আগস্ট’ হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৫ সালের ওই দিনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের এ ঘৃণিত কাজটি রাজনৈতিক পরিধি ছাড়িয়ে যায়। কেননা বর্বরদের হাত থেকে সেদিন ১৩ বছরের নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেলও রেহাই পায়নি। বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা ফারুক, রশীদ, ডালিম ও অপরাপর ষড়যন্ত্রকারীদের ভেতর দিয়ে সবার সামনে চলে আসে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নাম। অনেকেই খন্দকার মোশতাককে পলাশীর মীর জাফর নামে অভিহিত করে থাকেন। এ ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন বাঙালির কিংবদন্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
উল্লেখিত তিনটি ষড়যন্ত্রের ভেতর কোনটা কত নিন্দিত তা বিবেচনার চেয়ে বড় কথা হল এ ষড়যন্ত্রগুলো সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক বড় আকারের প্রভাব ফেলেছে। এ কারণে আমরা ষড়যন্ত্র বলতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে আলোড়িত কোনো কিছুকে বুঝি। কিন্তু আজকাল তা অহরহ, কারণে-অকারণে ব্যবহার করা হচ্ছে। বছর দুই আগে শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনে মাঠে নামে তখন এটিকে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই তার সমাধান করেন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। কিছুদিন পর কিশোররা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে। কী অপূর্ব সে ‘দুরন্তপনা’! সরকার এখানেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছিল। দু’দিন বাদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই তার সমাধান করলেন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রীকে আবারও ধন্যবাদ। কিন্তু কথা হল, যে কাজকে নিজেই সমর্থন করা হচ্ছে, তার দাবিকে ষড়যন্ত্রের অংশ ভাবা কি ঠিক?
কিছুদিন আগে আমরা পরপর দুটি রেল দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি, যেখানে অনেকে হতাহত হয়েছেন। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু মনে হয় তা কথার কথা। কারণ রেল দুর্ঘটনা সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘একটা ঘটনা ঘটলে দেখা যায় এর পুনরাবৃত্তি ঘটে। সেটা কেন হয়, ভেবে দেখতে হবে। ট্রেন দুর্ঘটনার পেছনে অন্য কোনো দুরভিসন্ধি বা চক্রান্ত আছে কিনা, তা তদন্ত করা হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ কিন্তু একই বক্তৃতায় তিনিই বলেছেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে চালক কুয়াশার কারণে সিগন্যাল দেখতে পাননি। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে আছে। গতকাল রংপুর এক্সপ্রেস সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে। এতে কেউ নিহত হননি। কয়েকজন আহত হয়েছেন। শীত এলে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়, এ বিষয়ে কী করা যায়, সরকার তা দেখবে’ (প্রথম আলো, ১৫.১১.২০১৯)। তাহলে ‘চক্রান্ত’ বা ‘ষড়যন্ত্রে’র কথা এলো কেন?
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি থেকে একাধিক সিনিয়র নেতা পদত্যাগ করেছেন। অনেকে মনে করছেন, বিএনপির একজন শীর্ষ নেতার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে সিনিয়র নেতারা দল ছাড়ছেন। আবার এমনও হতে পারে, রাজনীতি করতে এসে যেসব সুবিধা পাবেন বলে মনে করেছিলেন তা পাচ্ছেন না বলে তারা দল ছেড়েছেন। সে যাই হোক, দলটি এ অবস্থাকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘বারবার বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের আগে থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এখন আবার নতুন করে ষড়যন্ত্রের আভাস শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কোনো কাজ হবে না। অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে; কিন্তু কোনোভাবেই তা সফল হয়নি।’
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক ষড়যন্ত্র প্রত্যাশিত কিনা? জবাবে বলতে হবে, অবশ্যই না। কেননা অন্ধকার পথের কোনো ঘৃণিত ফসল গ্রহণযোগ্য নয়। একইসঙ্গে প্রশ্ন আসে, কোনো প্রকাশ্য ও যৌক্তিক দাবি বা আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র বলা যাবে কিনা? এর উত্তরও নিশ্চয়ই ‘না’ সূচক হবে। তাই আমরা চাই ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটির যেন বেহুদা ব্যবহার না হয়। তাতে করে শব্দটির প্রতি মানুষের অনুভূতি মামুলি হয়ে যাবে। বড় পাপ আর ছোট পাপের মাঝে তফাৎ করা দায় হয়ে যাবে।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়