প্রাথমিকে মডেল শিক্ষক নির্বাচন একটি শুভ উদ্যোগ

মাছুম বিল্লাহ
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতীকী ছবি
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে একটি নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের সেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্য থেকে যোগ্যতার বিচারে নির্বাচিত করা হবে ‘মডেল শিক্ষক’।
এই মডেল শিক্ষকরা সংশ্লিষ্ট উপজেলার অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া বিদ্যালয়গুলোর দুর্বল শিক্ষার্থীদের ক্লাস পরিচালনা করবেন। তারা বিশেষ করে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের ওপর বেশি নজর দেবেন।
এ সিদ্ধান্তের ফলে উপজেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে সরকার। এ ছাড়া গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা কাটাতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ জন্য ২ হাজার মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হচ্ছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে এটি করা হবে।
এ জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি চুক্তি সই হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য উপজেলা পর্যায়ে ফলের দিক দিয়ে সেরা বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্য থেকে নির্বাচন করা হবে ‘মডেল শিক্ষক’। এ মডেল শিক্ষকদের দ্বারা ওই উপজেলার যেসব বিদ্যালয়ের ফল ভালো নয়, সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য সুপারিশ করেছে এ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
তবে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চাইলেও মডেল শিক্ষক নিয়োগ করার বিষয়ে ধীরে চল নীতি অনুসরণ করছে মন্ত্রণালয়। কারণ এতে ভালো স্কুলগুলোর ক্ষতি হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। অনেক শিক্ষক মনে করেন, উদ্যোগটি ভালো; তবে তারচেয়েও প্রয়োজন শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ এবং দীর্ঘমেয়াদি বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব শিক্ষককে দক্ষ করে গড়ে তোলা।
আর একটি বিষয় হচ্ছে, বিদ্যালয়ের পিছিয়ে পড়া বা এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত হয় পরীক্ষার ফলের ওপর। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রচলিত পদ্ধতির পাবলিক পরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর করে একটি বিদ্যালয়ের পিছিয়ে পড়া বা এগিয়ে যাওয়া নির্ধারণ করা কতটা যৌক্তিক হবে।
পরীক্ষায় পাসের যেসব কসরত বা ইঞ্জিনিয়ারিং হয়, তার সঙ্গে শিক্ষকদের যোগ্যতা বা দক্ষতার ব্যাপার কতটা মানানসই, সেটি কিন্তু দেখার বিষয়।
মন্ত্রণালয় যে বিষয়টি বলতে চাচ্ছে, তা যুক্তিসঙ্গত। আগের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে নতুন জাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এক্সচেঞ্জ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কারণ নতুন জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের চেয়ে আগের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের যোগ্যতা ও দক্ষতায় বেশ তফাত লক্ষ করা যায়। তাই স্কুলগুলোতে আগের ও নতুন দুই ধরনের শিক্ষক থাকলে সেটি শিক্ষার্থীদের জন্য ও প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলজনক হবে। মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। মডেল স্কুলে সব ভালো শিক্ষককে ক্লাস করাতে অন্যত্র নিয়ে গেলে সেসব স্কুল চলবে কী করে?
তাছাড়া অধিকাংশ বিদ্যালয়েই পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। এক-দুজন শিক্ষক সবসময়ই ছুটিতে থাকেন, নারী শিক্ষকরা মাতৃত্বজনিত ছুটিতে থাকেন। তাই মন্ত্রণালয় থেকে মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, উপজেলার ভালো স্কুলগুলো ভিজিট করে ‘গুড প্র্যাকটিসগুলো’ নিয়ে দুর্বল স্কুলগুলোতে কাজে লাগাতে। এটিও একটি ভালো পরামর্শ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গণিত আর ইংরেজির দুর্বলতা কাটাতে শিক্ষকদের ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। গণিত বিষয়ে আটটি গণিত অলিম্পিয়াড থেকে দশজন করে নিয়ে আশিজন শিক্ষকের ওপর বর্তমানে পাইলটিং করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে এ সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। এ শিক্ষকরা উপজেলা পর্যায়ে গিয়ে অন্য শিক্ষকদের গণিতের ওপর প্রশিক্ষণ দেবেন।
একইভাবে ইংরেজিতে ২ হাজার মাস্টার ট্রেইনার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের পিটিআইগুলোতে ১০০ দিনের একটি বিশেষ কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহায়তায় সেখানে মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলবে। আইএলটিএসে পাঁচ অথবা সাড়ে পাঁচ পাওয়া ২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষককে বাছাই করা হবে।
তাদের ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রশিক্ষণ দেবে। ১০০ দিন পর এ প্রশিক্ষকরা উপজেলায় গিয়ে অন্য টিচারদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে তোলা হবে; যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে উপকৃত হবে।
কেউ কেউ বলেছেন, শিক্ষক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিভাগীয় পরীক্ষা গ্রহণ করতে। পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক বাছাই করা হোক। আবার কেউ কেউ বলেছেন, অগ্রগামী বিদ্যালয়ে পিছিয়ে পড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তিন বা চার মাস একটানা শিক্ষকতা করানোর মাধ্যমে তাদের হাতে-কলমে অনেক বিষয় শেখানোর কথা।
সেই অভিজ্ঞতা তারা নিজ নিজ বিদ্যালয়ে কাজে লাগাবেন। আবার কেউ কেউ ভয় পাচ্ছেন বিষয়টিতে লবিং ও দুর্নীতি ঢুকে যাবে। আবার এ ধরনের পরামর্শ এসেছে, মডেল শিক্ষক নির্বাচনে লিখিত, মৌখিক পরীক্ষা নিতে হবে, তাদের টিচিং কৌশল অবলোকন করতে হবে, তাদের বিষয়ের ওপর মৌলিক জ্ঞান যাচাই করতে হবে, দেখতে হবে তাদের কণ্ঠস্বর, অভিজ্ঞতা, পূর্ব-অভিজ্ঞতা এবং আনন্দঘন পরিবেশে কতটা ক্লাস নিতে পারেন।
এ বিষয়গুলো ‘মডেল শিক্ষক’ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রাথমিক শিক্ষায় একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের ভিত তৈরি করতে হয়, অন্যদিকে আনন্দের মাধ্যমে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করতে হয়। যেটি আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় ঘটছে না।
তাই আনন্দের বিষয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুধাবন করতে পেরেছে, দেশের উপজেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ স্কুলের পাঠদান নিুমানের। আর তাই মন্ত্রণালয় একটি নতুন উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অনেক সমস্যা আছে, তারপরও এখন অনেক মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষকতায় ঢুকছেন যেহেতু চাকরিটি সরকারি। বিসিএস কোয়ালিফাই করা নন-ক্যাডাররা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ঢুকছেন; এটি প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়।
তারপরও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তাই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি থেকে উত্তরণের জন্য মাঝে মধ্যে নতুন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে কিংবা করার চেষ্টা করে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ শুরু করে ২০০২ সালে, তখন বিপুলসংখ্যক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা, শিক্ষকদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো, শিক্ষকদের একঘেয়েমি দূর করে শিক্ষকতা জীবনে বৈচিত্র্য নিয়ে আসা, তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি প্রদান, তাদের যোগ্যতাকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া, সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে তাদের উপার্জন বৃদ্ধি করা ইত্যাদি লক্ষ সামনে রেখে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি প্রথম এ ‘মাস্টার ট্রেইনার’ উন্নয়নের কাজ শুরু করে।
বিষয়টিতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গিয়েছিল শিক্ষকদের কাছ থেকে, শত শত প্রতিষ্ঠান ও সরকারের পক্ষ থেকে। বিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে প্রায় পাঁচশ’ মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হয়েছিল। তারা নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। নিজেদের লুকায়িত দক্ষতা ও যোগ্যতা শানিত করার সুযোগ হয়েছিল তাদের। এ শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই কাজে উৎসাহ পেয়ে গ্রাজুয়েট থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কেউ কেউ ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির আন্তর্জাতিকমণ্ডলে কাজ করেছেন এশিয়া থেকে আফ্রিকায়।
অর্জন করেছেন বিশেষ ধরনের অভিজ্ঞতা। ৫৮ জন শিক্ষক যুক্তরাষ্ট্র ছয় সপ্তাহের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির সহায়তায়। মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে গঠিত যতগুলো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি উদ্ভাবিত এ মাস্টার ট্রেইনারদের ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ মাস্টার ট্রেইনারদের এটি এক ধরনের স্বীকৃতি। কাজেই প্রাথমিকেও এটি হতে পারে।
যে কোনো নতুন উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক না কেন তার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকবে। তবে, ভালো কোনো কিছু করতে হলে বেগ পেতেই হয়। মডেল শিক্ষক তৈরি করা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি ভালো উদ্যোগ। এখানে বেশি সমস্যা হতে পারে দু-একটি বিষয়ে।
যেমন- সরকারি প্রাথমিকে শিক্ষক সংখ্যা কম, তারপর দু-একজন নিয়মিত ছুটিতে থাকেন। দ্বিতীয়ত, মডেল শিক্ষক নির্বাচনের জন্য সঠিক শিক্ষক বাছাই করার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হতে পারে। সেটি হতে পারে, স্বজনপ্রিয়তা, ইজম, অর্থের লেনদেন বা ‘তৈলমর্দন’।
এ বিষয়গুলো তো সব জায়গায়ই আছে। তাই বলে একটি ভালো উদ্যোগের অযথা সমালোচনা করা যাবে না। বিষয়গুলোকে কীভাবে ম্যানেজ করা যাবে সেটি নিয়ে ভেবে কাজ করলে সমস্যার সমাধান অনেকটাই হবে। ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি মাস্টার ট্রেইনার নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণকালীন গ্রহণ করা প্রি-টেস্ট ও পোস্ট টেস্টের ফল, প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলো গভীরভাবে অবলোকন করা হতো।
তারপর ছিল মূল ট্রেইনারের সঙ্গে কয়েকদিন কো-ট্রেইনার হিসেবে কাজ করার নিয়ম, মূল ট্রেইনারের প্রতিবেদন ও প্রশিক্ষণার্থীদের মতামত। এসব অধ্যায়গুলো পার হয়ে আসার পর একজন শিক্ষক ‘মাস্টার ট্রেইনার’ হতেন।
একইভাবে প্রাথমিকের মডেল শিক্ষক হতে হলে শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতি ও কৌশল, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার আচরণ, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, জানা ও শেখার আগ্রহ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর প্রত্যক্ষ অবজারভেশন, প্রধান শিক্ষকের মতামত, ডেমনেস্ট্রেশন ক্লাস- বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
তাহলে বিষয়টি গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা পাবে। একজন শিক্ষক ‘মডেল শিক্ষক’ হলে তার শেখা ও জানার আগ্রহ বেড়ে যাবে, যা বর্তমানে অনেক শিক্ষকের মধ্যেই দেখা যায়। ফলে অন্য শিক্ষকদের মধ্যেও মডেল শিক্ষক হওয়ার জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হবে।
শিক্ষকদের শিক্ষাদান জীবনও আনন্দময় হবে; কারণ একই বিদ্যালয়ে দিনের পর দিন শুধু শিক্ষাদান করা সবসময় আনন্দদায়ক না হয়ে বিরক্তিকর হয়। মডেল শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষকদের জন্য হবে এক ধরনের রিলিফ; তাদের পেশায় নিয়ে আসবে এক ধরনের বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্য যে কোনো পেশাকে, মানুষের জীবনকে আনন্দময় ও অর্থবহ করে তোলে।
মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক
masumbillah65@gmail.com