Logo
Logo
×

বাতায়ন

চুয়াত্তরের চক্রান্ত দুই হাজার উনিশে

Icon

ড. এম এ মাননান

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চুয়াত্তরের চক্রান্ত দুই হাজার উনিশে

বাংলাদেশে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয়নি, হয়েছিল খাদ্যসামগ্রীর সুষম বণ্টনের অভাবে। বিদেশ থেকে প্রচুর খাদ্য আমদানি করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার; কিন্তু চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ ইত্যাদি চলে গিয়েছিল মাটির তলার গুদামে। তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিম সংকট।

যারা এ কাজটি করেছিল, তারা তা করেছিল অত্যন্ত দক্ষতা ও চতুরতার সঙ্গে, যাতে জনসাধারণ বুঝতেই না পারে কোথা থেকে কী হচ্ছে। এমন একটা সময়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছিল যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠিত করার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট- সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের নবগঠিত সরকারকে দেশবাসীর কাছে অজনপ্রিয় ও ব্যর্থ প্রতিপন্ন করা।

মনুষ্যসৃষ্ট এ দুর্ভিক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। মার্চের দিকে শুরু হয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল দুর্ভিক্ষ। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে থেকে মাস্টার্স সমাপনী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এবং দুর্ভিক্ষের কশাঘাতের মধ্যেই মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সেশনজটের কারণে বাহাত্তরের নির্ধারিত পরীক্ষা চুয়াত্তরের জুলাই-আগস্টে শেষ হল। এ সময়টায় বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনসহ সারা দেশে দুর্ভিক্ষের বিষয়টি ছিল ‘টক অব দ্য টাউন’।

যা বলছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষের কথা বাবা-চাচার মুখে শুনেছি, বইপত্রেও পড়েছি। পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত সেই দুর্ভিক্ষ পুরো বাংলায় (পূর্ব ও পশ্চিম) বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের কালজয়ী লেখা থেকে জানতে পারি, সেই দুর্ভিক্ষটাও সংঘটিত হয়েছিল খাদ্যের অভাবে নয়, কতিপয় দেশপ্রেমহীন অর্থলোভী মানুষের মানবতাবিবর্জিত কর্মকাণ্ডের কারণে।

তারা সংঘবদ্ধভাবে সিন্ডিকেট বানিয়ে খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে বাজারে অল্প অল্প করে ছেড়ে মানুষকে নাকাল করে ছেড়েছে, হাজারে হাজারে লোকজন না খেয়ে মরেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে চুয়াত্তর সালেও এমনটি হয়েছিল। ঘটনার খলনায়করা একই ধরনের মনোবৃত্তিসম্পন্ন।

এরা ছিল মূলত স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি চক্র। ষড়যন্ত্র করে ঘটিয়েছিল দুর্ভিক্ষ। অতি সংগোপনে পরিচালিত পরিকল্পিত সরকারবিরোধী এ চক্রান্তে জড়িত ছিল অনেক রাঘববোয়াল; যা পরবর্তী সময়ে আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধী উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাসহ পাকিস্তানপন্থী আরও অনেকে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন ঘটানোর জন্য খাদ্যসামগ্রী মজুদ করে, কখনও কখনও রাতের আঁধারে নদীতে ফেলে দিয়ে খাদ্যসংকট তৈরি করে। ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য দেশের ভেতরে থাকা সত্ত্বেও দেখা দেয় আকাল। দেশের মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তোলার জন্য এ দুর্ভিক্ষ ছিল একটি বিশাল অস্ত্র।

২০১৯-এর শেষদিকে এসে আবারও শুরু হয়েছে চুয়াত্তরের মতো চক্রান্ত, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এবার প্রথমে নাটক সাজানো হয়েছে ভোলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরির অপচেষ্টা দিয়ে। এরপর শুরু ‘পেঁয়াজ সন্ত্রাস’। দু’মাস ধরে বাড়াতে বাড়াতে নভেম্বরের মাঝামাঝি এসে প্রতি কেজি ৩০ টাকায় কেনা পেঁয়াজের দাম উঠিয়ে দিয়েছে শহরে ২৫০ এবং গ্রামাঞ্চলে ২৮০ টাকায়। মসলাপ্রিয় বাঙালির কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটির চাহিদা সবসময় তুঙ্গে।

তাই জেনেবুঝে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে তাদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামিয়ে আনার এক সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত এ পেঁয়াজ সন্ত্রাস। কেউ হয়তো বলবেন, পেঁয়াজের সরবরাহ কম তাই দাম বেড়েছে; ডিমান্ড-সাপ্লাই সূত্র এখানে কাজ করছে বলে দাবি করবেন।

এতে আমি পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করব না; কিন্তু অবশ্যই বলব, সাপ্লাইটা এত বেশি-কম কিসে? পত্রিকার খবর থেকে যা জানতে পারি তা থেকে এটা স্পষ্ট- বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ এসেছে এবং আসছে। দেশের ভেতরেও প্রচুর পেঁয়াজ মজুদ আছে।

বাজারে দোকানে দোকানে পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পাইকারি মোকামে কেন তেলেসমাতি ঘটেছে? ওখানে কারা সক্রিয়? খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা কেন বস্তা বস্তা পেঁয়াজ পচিয়ে নদীতে ফেলে দিল? কুমিল্লার গৌরীপুরে সেতুর নিচে কারা বস্তা বস্তা পেঁয়াজ ফেলে দিয়ে সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল? এরাও পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের সদস্য।

সিন্ডিকেটের কারসাজিতে পচানো পেঁয়াজ ভাগাড়ে, অন্যদিকে রাস্তায় ক্রেতাদের পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। গুদামে কেন রেখে দেয়া হয়েছিল এত বেশি মজুদ, কেন পচে গেছে গুদামেই? কেন বাজারে ছাড়া হয়নি এতদিন? ষড়যন্ত্রের গন্ধ তো এখানেই।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে ঘুরে ঘুরে সারা দেশে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ অতি কৌশলে। ঘরে ঘরে মানুষ যেন ক্ষিপ্ত হয়, বদদোয়া দিতে থাকে সরকারকে, মূলত শেখ হাসিনাকে। কারণ শেখ হাসিনা তো বঙ্গবন্ধুরই কন্যা। বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে চুয়াত্তরে; তার কন্যাকেও সেভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে ২০১৯-এ। চুয়াত্তরের কুশীলবদেরই এরা বংশধর, যারা পেঁয়াজকাণ্ড ঘটিয়েছে।

কয়েক দিন ধরে হঠাৎই শুরু হয়েছে অন্য একটি ষড়যন্ত্র। এটি হল ‘চাল নিয়ে চালবাজি’। ‘বুলবুলে’র পর থেকেই ঝড়বৃষ্টির দোহাই দিয়ে শুরু করা হয়েছে চালের দাম বাড়ানোর খেলা। নতুন ধান ওঠার মৌসুম শুরু হবে কয়েকদিন পরই। অথচ বিনা কারণে অযৌক্তিকভাবে হঠাৎ করেই চালের মিল মালিকরা নেপথ্যে সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিয়েছে চালের দাম। একটি টিভির খবরে শুনলাম, মিল মালিকরা ধান গুদামজাত করে রেখে দিয়েছে আর এ কারণে চালের দাম বাড়তির দিকে।

অনেক সিন্ডিকেট এখন চালকলগুলোতে। মজুদ করছে তারা ধান-চাল। পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান-চাল মজুদ থাকা সত্ত্বেও চালের দাম অনবরত বাড়তির দিকে। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘সর্বকালের সর্বোচ্চ চাল মজুদ রয়েছে।’ কৃষি বিভাগও দাবি করছে, কুষ্টিয়াসহ সব চালের মিলে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান আর চাল মজুদ থাকা সত্ত্বেও দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, হঠাৎ করে চালের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কোনো কিছু থাকতে পারে না। সতর্ক না হলে ধান-চালকে পেঁয়াজের অবস্থা করে ছাড়বে ষড়যন্ত্রকারীরা।

যারা সিন্ডিকেট করে বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে তারা অতিশয় ধুরন্ধর। এরা শুধু সরকারকেই হেনস্থা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত নয়, দেশের জনগণকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় নিয়োজিত। বিষয়টাকে হালকাভাবে পণ্যের ঘাটতি মনে করে নেয়া একেবারেই ঠিক হবে না। অসৎ ব্যবসায়ীরা কৌশলে কাজ করছে আর প্রচার করছে দেশে পেঁয়াজ আর চালের ঘাটতি; তাই দাম বেড়ে গেছে। বিষয়টি ঠিক নয়। প্রচুর পেঁয়াজ আর চাল বাজারে।

কেনা দামের সঙ্গে যুক্তিসঙ্গত মুনাফা যোগ করে বিক্রি করতে সমস্যা কোথায়? তারা তো কেনা দামের রসিদ পর্যন্ত বাজার তদারককারীদের দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করছে। এর পেছনে কারণ কী? দুরভিসন্ধি ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? সরকারের কোনো উদ্যোগের প্রতি তারা কোনো ধরনের সম্মানই দেখাচ্ছে না, সহযোগিতা তো দূরের কথা। ফেব্রুয়ারি মাসে যে পেঁয়াজ কিনতে লাগত ২০ টাকা; প্রতি কেজি তা ২৫০ টাকার উপরে উঠে গিয়েছিল কেন? এমনটি কিন্তু ২০১৭ সালেও হয়েছিল।

সে বছরও সরকারকে বিব্রত করা হয়েছিল পেঁয়াজের কেজি প্রায় ১৫০ টাকায় উঠিয়ে। বিভিন্ন সেক্টরে যেভাবে সিন্ডিকেটগুলো অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, তাতে চলছে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস। সমানতালে চলছে কর্তাব্যক্তিদের আশ্বাস। আশ্বাসে কতটুকু কাজ হবে জানি না।

তবে মানুষ গ্রামে-গঞ্জে-শহরে বেশ ক্ষুব্ধ। প্রতিটি ঘরে গিন্নিরা ক্ষুব্ধ। সারা দেশে কত কোটি গিন্নি আছেন তার হিসাব আমার কাছে নেই। তবে তা যে বড় একটা অঙ্ক হবে (কয়েক কোটির ঘরে তো অবশ্যই) তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়। এরা ভোটের বাজারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা না হলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে এরূপ চক্রান্ত কখনও দূর করা যাবে না; বারবার সুযোগ বুঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে ষড়যন্ত্রকারীরা।

মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ইরানে চলছে সরকারবিরোধী আন্দোলন। বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন দিয়ে এতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র; যে দেশটি একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সুযোগ পেলে ঘৃতাহুতি দেয়ার লোকের অভাব এ দেশেও হবে না; অন্য কোনো দেশকেও তারা কাজে লাগাতে পারে। চলছে নীরব ষড়যন্ত্র।

দেশবাসী দেখেছে কীভাবে অতি সম্প্রতি ভোলায় ঘটানো হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা, রেলে একাধিক দুর্ঘটনা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা। সবকিছু মিলিয়ে একাত্তর-পরবর্তী সময়কালে যেভাবে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হয়েছে, ঠিক প্রায় একইভাবে ওদেরই উত্তরসূরিরা এমন ক্ষেত্রগুলো বেছে নিচ্ছে যেখানে জনগণ প্রতিক্রিয়া দেখায় বেশি এবং নাখোশ হয় সহজে।

একটি বিরোধী দল তো পেঁয়াজ-চালের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সামনে নিয়ে এসে বিক্ষোভের ডাকও দিয়েছে। সুযোগ পেয়েছে তাই দিয়েছে। অল্প কিছুতেই হাঁকডাক করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তো অনেকেই মুখিয়ে থাকে।

তাদের হাতে দাবার ঘুঁটি কেন তুলে দিতে হবে? দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা সুযোগ খুঁজছে ছোবল মারার। এদের সঙ্গে হয়তো যোগ দেবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে যারা ধরা খেয়েছে তারা এবং তাদের শাগরেদরা। এদের স্বার্থহানি হয়েছে; সুতরাং তারা চুপ করে বসে থাকবে এমনটি আশা করার কোনো হেতু নেই। তাদের সবার লক্ষ্য হবে শেখ হাসিনার সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, সরকারের সাফল্যকে ম্লান করা এবং অগ্রগতির ধারাকে পিছিয়ে দেয়া। ভুলে গেলে চলবে না, তারা সংগঠিত অপশক্তি।

তারা সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন চায় না, ডেল্টা প্ল্যানের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ চেহারা পাল্টে দেয়ার পরিকল্পনা পছন্দ করে না। গ্রামে শহরের সযোগ-সুবিধা তৈরি করে সারা দেশের সব নাগরিকের জন্য উন্নয়নের সুফল সমানভাবে ভোগ করার সরকারি সুযোগ বিনষ্ট করতে তারা সদা উদগ্রীব। তারা জনগণের ভালো কখনও চায়নি, এখনও চায় না। তারা চাইবে যে কোনো প্রকারে পঁচাত্তরের মতো অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এদের অপপ্রচার আর নোংরা ব্যক্তিগত আক্রমণ প্রমাণ করে তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

ড. এম এ মাননান : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম