প্রয়োজন রাজনৈতিক উদারতা
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.)
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজনৈতিক উদারতা। প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে এত আলোচনা আর কখনও হয়নি। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও তদারকিতে বিপুল পরিসর থাকার পরও নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাবলি তদন্তে মানুষের বিশ্বাসের ওপর আঘাত এসেছে।
একে অপরের ওপর দোষারোপ না করে যদি আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি ব্যবস্থার সংস্কার করি তাহলে কি অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব? এতে রাজনৈতিক দলগুলোর উদারতার দরকার আছে। একটি দলের সুযোগ বুঝে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সদ্ব্যবহারের বিরূপ ও ভয়ানক ফল আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
আমরা এর পুনরাবৃত্তি আশা করি না। রাজনৈতিক দলের উত্থান, পরিচালন ও শ্রীবৃদ্ধি একটি দেশের জন্য কত দরকার, কত অত্যাবশ্যকীয়, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। দেশ পরিচালনায় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যে বাধ্যবাধকতায় থাকেন আর জবাবদিহিতার মধ্যে দিনাতিপাত করেন, তা আমাদের নিকট প্রতিবেশীদের মধ্যেই দেখতে পাই।
তদুপরি, দল ও সরকার যদি একাকার হয়ে যায় আর সরকারি বেতনভুক্ত কর্মচারীরা যদি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে রাজনৈতিক দলের সদস্যদের চেয়েও বেশি উৎসাহী ও উদ্যোগী হয়ে ওঠেন তবে তা দেশকে ভয়ানক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। তবে এটা সত্য- ক্ষণস্থায়ী একতরফা ক্ষমতা দেশকে ক্ষণস্থায়ী মঙ্গল এনে দিতে পারে।
রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা এবং নির্বাচন মেনিফেস্টো পূরণে কখনও কখনও বিরোধীহীন সরকার পরিচালনার আকাক্সক্ষায় ‘বেনোভোলেন্ট ডিক্টেটর’ বা ‘দরদি একনায়কতন্ত্রের তত্ত্ব’টির উদ্ভব ঘটেছিল।
রাজনৈতিক দলের একে অন্যকে চরমভাবে ঘৃণা করা, হরতাল-অবরোধে সাধারণের চলাচলসহ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে মানুষ সচরাচর ‘দরদি একনায়কের’ দিকে ধাবিত হয়। তবে দীর্ঘকালের জন্য এটি ক্ষতিকর। ক্ষতিকর গণতন্ত্রের জন্য, বাক-স্বাধীনতার জন্য, মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য ও সুসংহত উন্নয়নের জন্য।
আমাদের মতো দেশে এ অবস্থা নিজ দলের জন্যই ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসতে পারে; একজন জনপ্রিয় নেতাকেও চোর-ডাকাত-পাচারকারীদের নেতায় পরিণত করতে পারে। কেননা নিজ দলের স্বার্থরক্ষায় এরা বিরোধীদের চরম বিপদে ফেলতে পারে এবং যেহেতু সরকারি কর্মচারীরা এসব নির্বাচনে একটি দলকে সমর্থন করে, সেহেতু সে দলের কাউকে কিছু বলতে ও ধরতে অক্ষম হয়ে পড়ে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চিলি এসব ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে। একটি দল আবার যদি চরম জাতীয়তাবাদী স্লোগান তুলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে একত্র করতে পারে এবং দেখাতে পারে মাইনরিটিরা দেশের জন্য ক্ষতিকর তাহলেও অন্যরকম একরতফা নির্বাচনের সুযোগ থেকে যায়।
ভারত এ অবস্থার দিকে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারতের নোবেলজয়ী পণ্ডিত অমর্ত্য সেন, বিশ্ববিখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতি রায় প্রকাশ্যে বলছেন ভারতের সামনের বিপদের কথা; চরম জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় উগ্রতার প্রশ্রয়ে নির্বাচনের কথা।
বিপদের কথা- ভারতের শিক্ষিত শ্রেণি, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের মধ্যে ধর্মান্ধতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্র সুখকর। এখানকার শিক্ষিত, মার্জিত লোকজন দল নির্বিশেষে অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল।
শুধু নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের ব্যবহার যে নিষ্ঠুর পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তা চীনের উইঘুর, রাশিয়ার দাগেস্তান, ভারতের কাশ্মীর, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশে দেখা যাচ্ছে।
কাশ্মীরের রাজা হরি সিংয়ের নাতনি (যিনি এখনও জীবিত) বলেন, পাকিস্তানি উপজাতীয় আক্রমণকারীদের হাত থেকে কাশ্মীরকে রক্ষার জন্য রাজা হরি সিং ভারতের দ্বারস্থ হন ১৯৪৮ সালে। ভারত তখন একটি চুক্তি ছাড়া কাশ্মীরে সেনা পাঠাতে অক্ষমতা প্রকাশ করে।
হরি সিং সে চুক্তিতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক ও যোগাযোগ বিষয়টি ভারতের হাতে ছাড়তে চায়। ভারতও রাজি হয়ে সংবিধানের ৩৭০ ধারা সংযোগ করে। রাজা হরি সিংয়ের নাতনির মতে, ভারত যদি ৩৭০ ধারা বিলোপ করে তাহলে তো ভারতের ওই তিনটি বিষয়ে কাশ্মীরকে আর সহায়তার দরকার নেই অর্থাৎ কাশ্মীর পুনরায় ‘প্রিন্সলি স্টেটে’ পরিণত হল; যার অর্থ দাঁড়ায়, কাশ্মীরকে ছেড়ে দিল ভারত।
কাশ্মীর এখন স্বাধীন। এটি অবশ্য আলোচনা ও তর্কের বিষয়। তবে বিষয়টির গভীরে গেলে এর মর্মার্থ বোঝে ভারতীয় বিজ্ঞ পণ্ডিতরা আঁতকে ওঠেন। ভবিষ্যতে কী হয়, তা দেখার জন্য হয়তো আমরা বেঁচে থাকব না; তবে বিষয়টির ওপর বিশদ আলোচনা জাতিসংঘ পর্যন্ত গড়াতে পারে। এ জন্য সময়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
অবশ্য কাশ্মীরে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের পুনর্বাসন যৌক্তিক। কেননা, তাদের অমানবিকভাবে তাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বুলেট দিয়ে এক হাজারের অধিক কিশোর-যুবকের চোখের আলো চিরতরে নিভিয়ে দেয়া। তার মানে লক্ষাধিক সাধারণ মানুষ হত্যা নয়; কাশ্মীরকে একটি চিরস্থায়ী কারাগারে পরিণত করা নয়।
মিয়ানমার আর ভারতের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। যেমন ভারতের বর্তমান সরকার, বিশেষ করে, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রকাশ্যে বারবার বলছেন, ভারতে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান শিখদের ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে; বাকিদের ফেরত দেয়া হবে বাংলাদেশে।
আসামে বৃহৎ কারাগার বা নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে যারা নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ, তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে আছেন ভারতের সাবেক একজন রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যও। বিজেপি সরকার এরকম নাগরিকত্ব হিসাবের ফাঁকে পশ্চিমবঙ্গে ঝড় তুলছে। পরবর্তী নির্বাচনে এ ট্রাম্প কার্ডে তারা ক্ষমতাসীন হওয়ার আশা করছে।
অচিরেই যদি আমরা বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারে দেখি তাহলে তা আমাদের জন্য সমস্যাটি দ্বিগুণ করে তুলবে। কারণ অমিত শাহর নির্বাচনী প্রচারণায় তা প্রকাশিত ও প্রমাণিত। বিশেষ করে অমিত শাহ ভারতের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। কোনো অঘটন না ঘটলে মোদির পর তিনিই হবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ বিজেপির প্রতিনিধি।
দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার চাইবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিতে। এ জন্য মিয়ানমার এখন পর্যন্ত বিশ্ববিবেককে তোয়াক্কা করছে না। বাংলাদেশের হাজারও প্রচেষ্টা, বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব, কক্সবাজারের প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংস সারা বিশ্ব দেখছে; অথচ ভারত, চীন, রাশিয়া বলছে কী আর করছে কী!
আমরা কাদের কাছে যাব? জাতিসংঘ, ওআইসি, না ন্যাম? আসল কথা, নির্বাচিত সরকারই আমাদের ভরসা; এটা বুঝতে হবে। সরকারের বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপই কেবল সমস্যা সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে পারে। এ জন্য দরকার প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচন, যে নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের উদারতা, সহ্যগুণ ও নিজ দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
দলের সদস্যদের সুপথে রাখতে পিতামাতার ন্যায় কর্তব্য পালন করা উচিত। নয়তো সুসন্তানের বদলে কুসন্তানের আবির্ভাব ঘটলে নিজেরই ক্ষতি। কেননা, ক্ষমতা আর আধিপত্যের জন্য তারা নিজ দল ও নিজের ভাইকেও ছাড় দিচ্ছে না। আর নিজ সংসারের ক্ষতি যে চরম ক্ষতিকর, তা কে না বোঝে!
এ জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি (ডি ইন্ট মেথড) ছোটখাটো দলের অল্পসংখ্যক সদস্য হলেও সংসদে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। এ জন্য জেলাভিত্তিক আসন ও প্রাপ্ত ভোটের হিসাবের ওপর আসন প্রাপ্তি হিসাব করা যায়। বিষয়টি বেলজিয়ামের অঙ্কশাস্ত্রবিদ ডি ইন্ট এত স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, পৃথিবীর বহু দেশে তা অনুসরণ করা হচ্ছে।
এ পদ্ধতিতে নিজ দলের বিরোধী প্রার্থী তৈরি, প্রার্থিতার জন্য নিজ দলের বিরুদ্ধাচারণ, যে কোনো প্রকারে জেতার জন্য শক্তি, অর্থ, প্রশাসনের ব্যবহার অন্তত ৭৫ ভাগ কমে আসবে। এতে দলের সাংগঠনিক স্থিতি বজায় থাকে। তবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর উদারতা, সহিষ্ণুতা আর গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ততা। শুধু ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারণ মানুষকে তথা প্রার্থীদের কত ভয়ানক করতে পারে, তা বাংলাদেশের মানুষ ভালোই জানে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনে অর্জিত ‘কেয়ারটেকার সরকার’ নিয়ে বিএনপি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে সামনে রেখে যে নয়ছয় খেলা খেলেছিল, তার মাশুল জনগণ এখনও দিচ্ছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও উদারতা ছাড়া আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়তির ওপর সমর্পিত। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কে আমাদের রক্ষা করবেন!
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.) : তুরস্কে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সামরিক অ্যাটাশে